Logo
Logo
×

সংবাদ

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এবার তিনগুণ!

Icon

ঢাকা অফিস

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৪, ০২:৩৮ এএম

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এবার তিনগুণ!

প্রতীকী ছবি

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১৫ মে এক দিনে ৩ জনের মৃত্যুর খবরে নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের হারও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে আজ বৃহস্পতিবার (১৬) পাঠানো সর্বশেষ বার্তায় বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ২৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এই সময়ে কেউ মারা যায়নি। আক্রান্তদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ১, ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশন বাদে) ৬, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ৬ এবং ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ৮ জন রয়েছে। 

গত বছরের মে মাসের প্রথম ১৫ দিনে যেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ১৩ জন; এবছর সেই সংখ্যা প্রায় তিনগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ জনে। আক্রান্ত এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে বহুগুণ। মে মাসের প্রথম ১৫ দিনে রাজধানীর সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে ৮৬৫ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩২ জনের। শুধু ১৫ মে একদিনেই  ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মারা গেছেন ৩ জন। এরমধ্যে চাঁদপুরের ১ জন, লক্ষ্মীপুরের ১ জন। অপর জন রাজধানী ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা। 

এছাড়া, ঢাকার ৭৭ টি সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে ১ মে থেকে ১৫ মে পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিলো ৮৮৫ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৭৮১ জন। ভর্তি আছেন ৬৩ জন। এই ১৫ দিনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ২১ জন।

ঢাকা বাইরে ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলায় ১৫ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪৪ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩৩১ জন। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৩ জন। এই বিভাগের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত নরসিংদী জেলায় ১০১ জন। 

ময়মনসিংহ বিভাগের ৪ জেলা এবং ময়মনসিংহ মহানগরীতে মে মাসের প্রথম ১৫ দিনে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৫০ জন। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪ জন। এর মধ্যে সরবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ময়মনসিংহ জেলায় ৩১ জন। 

চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ৭৫৪ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৭২৪ জন। চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৬ জন। হাসপাতালে মারা গেছেন ৪ জন। 

খুলনা বিভাগের ১১ জেলায় মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১১৬ জন। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন ১১৫ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ১ জন। 

রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪৭ জন। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন ৪৬ জন। সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১ জন। 

রংপুর বিভাগের ৯ জেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ জন। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন সবাই। নতুন আক্রান্তের খবর পাওয়া যায়নি। 

বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় আক্রান্ত সবচেয়ে বেশি। গত ১৫ দিনে এই বিভাগে মোট আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩৮ জনে। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩০৪ জন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের। এখনো হাসপাতালে ভর্তি ২৬ জন। এ বিভাগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন বরগুনা জেলায় ১৪৩ জন। এর পরপরই পিরোজপুর জেলায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ জন। 

সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় চলতি মে মাসের প্রথম ১৫ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ১০ জন। চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯ জন। একজন এখনো হাসপাতালে ভর্তি আছেন। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে গত ১৫ দিনে সারা দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ৫৪৫ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ২ হাজার ৩৭৭ জন। সারা দেশে ১৩৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী এখনো দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আর মৃত্যু হয়েছে ৩২ জনের।  

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে দেশের ইতিহাসে সব রেকর্ড ভেঙে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ১ হাজার ৭০৫ জন। ২০২২ সালে ২৮১ জন মারা যান এবং ওই বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৬২ হাজার ৩৮২ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০২১ সালে সারাদেশে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে মারা যান ১০৫ জন। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বাংলা আউটলুককে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান ঠিক আছে। তবে, তথ্যগত ভুল আছে। কারণ, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে একটি বড় অংশ ঢাকায় চিকিৎসা নিতে আসেন। আর ঢাকার অধিকাংশ সরকারি বেসরকারি হাসপাতালই মহানগরীর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায়। ফলে এসব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু রোগীদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। মূলত দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার চিত্র এতটা ভয়াবহ নয়। 

তিনি বলেন, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডের কমিশনার ও সাধারণ মানুষদের সমন্বয়ে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ সিটির ওয়ার্ডগুলোকে ১০ ভাগে ভাগ করে চালানো হচ্ছে সচেতনতামূলক প্রচারণা। স্কুল কলেজ এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলোতেও চালানো হচ্ছে প্রচারণা। 

তিনি জানান, আগামী ২১ মে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে একটি অ্যাডভোকেসি সভা করা হবে। পর্যায়ক্রমে চালানো হবে ভ্রাম্যমাল আদালতসহ বিভিন্ন অভিযান। 

তিনি জানান, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মশক নিধন বিভাগের প্রধানের পদটি খালি রয়েছে। তবে, ১ হাজার ৫০ জন কর্মীর সমন্বয়ে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অধীনে কাজ চলছে। 

ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, উদ্যোগ থাকলেই তো কাজ হবে না। পর্যপ্ত অর্থায়নও থাকতে হবে। সিটি কর্পোরেশনকে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া আছে মশক নিধনে, তাতে মশা নিধন সম্ভব নয়। আর পুরোনো পেস্টিসাইড দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সম্ভব নয়। মশার রেজিস্ট্যান্সও বেড়েছে। পুরোনো ওষুধে মশার লার্ভা নষ্ট হয় না। এ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। শুধু ওষুধ দিলেই চলবে না।

 এদিকে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ইনসেক্ট কন্ট্রোল বিভাগে কোনো কর্মকর্তা নেই। সেখানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। 

কবিরুল বাশারের সঙ্গে মোবাইলে বাংলা আউটলুক যোগাযোগ করলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে আর ফোন ধরেননি। 

এদিকে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ‌্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বাংলা আউটলুককে বলেন, স্থানীয় সরকার বা সিটি কর্পোরেশন যে সকল উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো কার্যকর হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বড় ধরনের একটি ঘাটতি রয়েছে। প্রচার-প্রচারণা বা জনসচেতনতা এ ধরনের রোগ প্রতিরোধে যথেষ্ট নয়। 

তিনি বলেন, কার্যত ২০০০ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও, গত ২৪ বছরে আমাদের সকল উদ্যোগ অকার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। শুধু সচেতনতা নয়, ডেঙ্গু প্রতিরোধে, ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকাতে যেভাবে কারিগরি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সে ধরনের জনবল আমাদের নেই।  

ডেঙ্গু ঠেকাতে সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের এন্টোমোলজিস্ট, এন্টোমোলজি ল্যাব, ল্যাব এসিস্ট্যান্টসহ যে কারিগরি দক্ষতা সম্পন্ন জনবল সৃষ্টি করবার কথা ছিল তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে মশা নিধন করতে শুধুমাত্র স্প্রে বা ফগার মেশিন দিয়ে কেরোসিন ধোয়া দিয়ে ডেঙ্গু দূর করা যাবে না-যোগ করেন তিনি। 

বেনজির আহমেদ বলেন, জনসচেতনতা বা প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোর পাশাপাশি এগুলো কার্যকর করবার জন্য সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। যেহেতু স্থানীয় সরকার ফেল করেছে,  স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকেই দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামতে হবে।  তাহলে হয়তো আগামী ৮-১০ বছর পর ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমতে পারে।  না হলে দিন যত এগোবে ডেঙ্গুও ততো ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে।

এসব ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা শামন্ত লাল সেন বাংলা আউটলুককে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সাধারণত বছরের এই সময়ে মশার উপদ্রপ বাড়ে। বর্ষা মৌসুমের শেষ পর্যন্তই প্রকোপ চলে। যেহেতু শুরুতেই আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। সুতরাং আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সরকারের একার পক্ষে এটি মোকাবিলা করা সম্ভব না। নাগরিক সচতেনতা জরুরি বলেও মনে করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।  

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন