পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক শেষ কথা বলেন ডোনাল্ড লু। ছবি: বাংলা আউটলুক
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র সফর নিয়ে রাজনীতিতে বেশ আলোচনা ছিলো। নির্বাচন নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সরকারের তিক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ায় রাজনৈতিক মহলে তার এ সফর নিয়ে মৃদু গুঞ্জন ছিলো। তবে শেষ পর্যন্ত তার এ সফরকে ‘ঠান্ডা’ বলছে কূটনীতিক মহল।
বুধবার (১৫ মে) পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সেখানে কোনো কথা বলেননি মার্কিন এ কূটনীতিক। তবে বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত শেষে মিডিয়ার মুখোমুখি হন তিনি।
এসময় ডোনাল্ড লু’ বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ঢাকার সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে ‘অনেক টেনশন’ তৈরি হয়েছিল। এসব সরিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সামনে তাকাতে চায়, পেছনে নয়।
ডোনাল্ড লু বলেন, বাংলাদেশ সফরে এসে গত দুই দিনে আমি দুই দেশের জনগণের মাঝে পুনরায় আস্থা স্থাপনের চেষ্টা করছি। আমরা জানি, গত বছর বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অনেক টেনশন ছিল। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন (বাংলাদেশে) অনুষ্ঠানে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম। এতে কিছু টেনশন তৈরি হয়েছিল। আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক। এখন আমরা সামনে তাকাতে চাই, পেছনে নয়। আমরা সম্পর্ক জোরদারের উপায় খুঁজে বের করতে চাই।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে ডোনাল্ড লু বলেন, আমাদের সম্পর্কের পথে অনেকগুলো কঠিন বিষয় রয়েছে, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার ও ব্যবসার পরিবেশের উন্নয়ন। তাকে বলেছি কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হলে ইতিবাচক সহযোগিতার ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে হবে।
পরে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর, বিস্তৃত করার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। আমাদের বহুমাত্রিক সহযোগিতার ক্ষেত্র রয়েছে এবং একইসঙ্গে গত ৫৩ বছরের আমাদের অভিযাত্রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
তিনি বলেন, পঞ্চমবারের মতো সরকার গঠন করার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সম্পর্ককে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। সেই ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ায় অভিপ্রায়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবেই বাংলাদেশে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি সফরে এসেছেন এবং সেই লক্ষ্যেই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সিঙ্গেল কান্ট্রি হিসেবে সবচেয়ে বড় ডেস্টিনেশন। বিনিয়োগের দিক থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় দেশ।
ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আমরা বাংলাদেশে ৪০টি আইটি ভিলেজ করার যে পরিকল্পনা করেছি সেখানে যাতে তারা বিনিয়োগ করে। কিছু বিনিয়োগ ইতোমধ্যেই আছে। এছাড়া আমাদের বিশেষ অর্থনৈতিক জোনের মধ্যে যাতে বেশি করে বিনিয়োগ করে, আরও যাতে বিনিয়োগ আসে তা নিয়ে কাজ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছি। তাকে অনুরোধ করেছি।
তিনি বলেন, যে জিএসপি সুবিধা আমরা আগে ভোগ করতাম এখন করি না সেটি তারা ফিরিয়ে দিতে চায়। তবে সেক্ষেত্রে আমাদের লেবার পলিসিটা আরও একটু রিভিউ করতে হবে। যেটা আমরা রিভিউ করছি। এটি নিয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমাদের রিজার্ভ তথা আমাদের আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করার জন্য তাদের ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে সেখান থেকে তারা অর্থায়ন করতে চায়। সেটিও তিনি জানিয়েছন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের কয়েক কোটি মানুষ ট্যাক্স দেওয়ার উপযুক্ত হলেও তারা সবাই ট্যাক্স দেয় না। তারা আমাদের ট্যাক্সসেশন সিস্টেমটা পজিটিভ করার জন্য সহযোগিতা করতে চায়।
এছাড়া বাংলাদেশি ছাত্ররা যাতে আরও ব্যাপকভাবে তাদের দেশে যেতে পারে সেটি তারা চায়। সেক্ষেত্রে আমি তাদের একটি একচেঞ্জ প্রোগ্রাম করার প্রস্তাব দিয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বলিষ্ঠ করতে চায় এবং তিনি এসেছেন এ সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে- যোগ করেন হাছান মাহমুদ।
এদিকে মঙ্গলবার ঢাকার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই বৈঠকে অংশ গ্রহণকারী একটি সূত্র বাংলা আউটলুককে বলেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে মনোভাব তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে ওই বৈঠকে বিষয়টি সেভাবে খোলামেলা আলোচনা হয়নি। তারা নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে আমাদের কাছে জানতে চেয়েছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি, পোশাকখাতে শ্রমিক হয়রানিসহ অন্যান্য স্পর্শকাতর বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। গত নির্বাচনের পর এসব ক্ষেত্রে সরকারের হয়রানি কমেনি বলে তাদের মূল্যায়ন উঠে এসেছে আলোচনায়।
ওই সূত্রটির মতে, নির্বাচনের আগে পোশাক শ্রমিক হত্যার বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। মামলাগুলোতে হাজার হাজার আসামির বিষয়টিও তাদের অজানা নয়। এসব বিষয়ে তাদের ভেতরে অস্বস্তি রয়েছে। তবে যেহেতু এজেন্ডা আকারে উপস্থাপিত হয়নি তাই এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মন্তব্য না করাই ভালো।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতিও ঘোষণা করেছিল ওয়াশিংটন। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া হবে না।
এরপর বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা হিসেবে বাংলাদেশ সফরে এসে সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নেওয়ার কথা বললেন ডোনাল্ড লু।