বাংলা আউটলুককে এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেন রশিদ
আমরা রোজা আছি বলায় সোমালিয়ান দস্যুরা আমাদের মারেনি
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৪, ০৮:০৫ পিএম
সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে এসআর শিপিংয়ের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ প্রায় এক মাস পর আজ মঙ্গলবার (১৪ মে) দুপুরে ২৩ নাবিক নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছাবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং কেএসআরএম এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ২৩ নাবিককে সংবর্ধনা দেবে।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের মাস্টার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বলেন, কুতুবদিয়ায় নোঙর করার কারণ হলো, এত বড় জাহাজ বন্দর জেটিতে ভেড়ানোর সুযোগ নেই। জাহাজটিতে ৫৬ হাজার ৩৯১ টন চুনাপাথর রয়েছে। এতে জাহাজটির ড্রাফট (পানির নিচের অংশের দৈর্ঘ্য) বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১২ মিটার, যা চারতলার সমান। ফলে বন্দর জেটিতে এটি ভেড়ানো সম্ভব হবে না।
কুতুবদিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে রওনা দেওয়ার পরপরই বাংলা আউটলুকের সাথে কথা হয় ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদের। তিনি বলেন, বাড়ি ফিরছি; দস্যুদের কবলে যখন পড়ি তখন ভেবেছিলাম, হয়তো বাড়ি ফেরা হবে না। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বাড়ির পথে আছি। স্বজনেরা অপেক্ষায় আছে। সবাই খোঁজখবর নিচ্ছেন। জীবন কতটা মধুর তা এখন টের পাচ্ছি।
ক্যাপ্টেন রশিদ বলেন, গত ৪ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে কয়লা নিয়ে যাত্রা করি। ১৯ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাতের হারমিয়া বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। এর মধ্যে ১২ মার্চ দুপুর দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে যাই।
তিনি বলেন, দুপুর দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরে হঠাৎই জলদস্যুদের কবলে পরি আমরা। বুঝতেই পারিনি। উচ্চ গতির স্পিড বোট নিয়ে জাহাজের পাশে চলে আসে সোমালিয়ান জলদস্যুরা। জাহাজের সাথে হুক লাগিয়ে রশি বেয়ে উঠে পড়ে জলদস্যুরা। ওদের হাতে বন্দুক ছিল। ফায়ার করতে করতে ব্রিজে চলে আসে। জাহাজের সেকেন্ড অফিসারকে জিম্মি করে ফেলে দস্যুরা। সেকেন্ড অফিসার চিৎকার দিয়ে আমাকে বলতে লাগলেন, “স্যার আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান স্যার।” দ্রুত আমি ছুটে গেলাম, সদ্যুরা আমাদের সবাইকে আটকে ফেললো, আমরা ২৩ জনই আটকে গেলাম ওদের হাতে।”
তিনি বলেন, মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে আমাদের সবাইকে একটি কেবিনের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে তারা। শুধুমাত্র একবারই আমরা আমাদের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছি। পরিবারের সাথে প্রথম কিছু সময় কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। এরপর আমাদের মোবাইল ফোনসহ সব কিছু ওদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এরপর ওরা যেভাবে বলেছে, সেভাবেই আমরা জাহাজ চালাতে বাধ্য হয়েছিলাম, উল্লেখ করেন আবদুর রশিদ। তিনি বলেন, ওদের কমান্ডার দোভাষীর মাধ্যমে নির্দেশনা দিয়েছিল, সেভাবেই আমিই জাহাজ চালিয়ে সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছাই।
রমজান মাস চলছিল, চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময়ই প্রায় ১৫ লাখ টাকার খাদ্য সামগ্রী কিনে নিয়েছিলাম। এছাড়া পণ্য বোঝাই করে মাবুতো বন্দর ছাড়ার আগেও আমরা ১০০ টন খাবার পানি, ফল, সবজি, জুস, দুধ কিনে নিয়েছিলাম। ফলে খাদ্য সংকটে পড়তে হয়নি।এছাড়া দস্যুদেরকে আটকের সাথে সাথেই আমি (রশিদ) বলেছি, “উই আর বাংলাদেশি মুসলিম, দিস ইজ রমাদান, উই আর ফ্যস্টিং( আমরা রোজা আছি)”। বলার পর দোভাষীর মাধ্যমে আমাদেরকে ইফতার ও সেহরি করার সুযোগ দিয়েছে। অবশ্য প্রথম দিন আমাদের সাথে কিছু দুর্ব্যবহারও করেছে। জাহাজের সেকেন্ড অফিসারকে ধরে ধাক্কা দিয়েছিল।
আবদুর রশিদ বলেন, আমরা মুসলিম এবং রোজ আছি এটা বলায় ওরা আমাদেরকে শারীরিকভাবে কোনো নির্যাতন করেনি। না হলে পায়ে বা শরীরের অন্য স্থানে গুলি করতো হয়তো। সেটা ওরা চেয়েছিলও।
ক্যাপ্টেন রশিদ আরো বলেন, দ্বিতীয় দিন ভোর রাতে সেহেরি বানানোর জন্য আমি যখন ক্রুকে নির্দেশ দিলাম, তখন দস্যুরা আমাকে ধমক দিয়েছিল। কিন্তু আমি ওদেরকে বুঝিয়ে বলি, ওরা রাজি হয়। ওরাও আমাদের সাথে খেয়েছে। অবশ্য দস্যুরা আমাদের ২৩ জনকেই একটি কেবিনের মধ্যে আটকে রাখে, সেখানে একটি বাথরুম ছিল, কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু সমস্যা হয়নি।
১২ মার্চ থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে নাবিকেরা সরাসরি কারো সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছিল কী না প্রশ্নের জবাবে ক্যাপ্টেন রশিদ বলেন, না। দেন দরবার বা কোনো প্রক্রিয়ার ভেতরে দস্যুরা আমাদের জাহাজের কোনো নাবিককে যুক্ত করেনি। আমরা টেরও পাইনি কীভাবে ওরা আমাদের কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেছে। তবে, ওদের আচরণ ছিল সব সময়ই ভীতিকর। আমরা সবাই-ই ভয়ে ছিলাম। তবে, সাহসও পেয়েছি। ওরা কয়েকবারই বলেছে, আমাদেরকে ছেড়ে দেবে।
তিনি বলেন, আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, বিদেশি নৌবাহিনীর জাহাজ আমাদেরকে উদ্ধার করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল। কারণ ওদের নিজেদের মধ্যে আলোচনায় আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, ওরাও এক ধরনের নিরাপত্তা হীনতার মধ্যে আছে। নিয়মিত রুটিন করে পুরো জাহাজ ওরা পাহারা দিত। আমাদেরকে কখনোই কেবিনের বাইরে বের হতে দেয়নি। পরিবারের সবার কথাই মনে পড়তো, আমাদের মধ্যে দু-একজন ক্রু মন খারাপও করতো। কিন্তু ক্যাপ্টেন হিসেবে ওদেরকে আমি সব সময়ই সাহস দিয়েছি উল্লেখ করেন আবদুর রশিদ।
নানা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার পর ১৩ এপ্রিল রাত ৩টার দিকে আমাদের মুক্তি দেয় দস্যুরা। আমাদের উদ্ধারে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সরকারসহ বিদেশি কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ না থাকলে হয়তো বেঁচে ফিরতে পারতাম না উল্লেখ করে আবদুর রশিদ বলেন, আমরা কৃতজ্ঞ। সরকারের প্রতি, কেএসআরএম এবং নৌবাহিনীর প্রতি। তাদের উদ্যোগেই এক ধরনের নতুন জীবন পেলাম, বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখতে পারলাম। প্রিয়জনদের সাথে দেখা করার সুযোগ পেলাম, জীবন আসলেই অনেক মধুর, বেঁচে থাকার আনন্দ কতটা, তা এখন বুঝতে পেরেছি। জীবন আসলে কতটা দামি, তাও বুঝলাম। শুকরিয়া মহান আল্লাহর প্রতি উল্লেখ করেন এমভি আব্দুল্লাহর প্রধান নাবিক ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ।
এর আগে সোমবার (১৩ মে) বিকেলে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেলে এসে পৌঁছায় বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। আর কুতুবদিয়ায় কিছু মালামাল খালাস শেষে বুধবার এমভি আবদুল্লাহ চট্টগ্রাম বন্দরের সদরঘাটে পৌঁছাবে। জেটিতে বরণ করার পর কেএসআরএমের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বেঁচে ফেরা ২৩ নাবিককে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন।
এসময় নাবিকদের স্বজনরাও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। নানা শঙ্কা, দীর্ঘ অপেক্ষা আর ভয়কে জয় করে প্রিয়জনকে ফিরে পেয়ে এসময় আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন স্বজনরা।
উল্লেখ্য, মুক্তিপণের বিনিময়ে গত ১৩ এপ্রিল মুক্তির পর জাহাজটি দুবাইয়ের উদ্দেশে রওনা দেয়। ২১ এপ্রিল বিকাল সাড়ে ৪টা নাগাদ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের আল হারমিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছায়। জাহাজে থাকা ৫৫ হাজার টন কয়লা সেখানে খালাস করা হয়। পরে আমিরাতের মিনা সাকার বন্দর থেকে ৫৬ হাজার টন চুনাপাথর নিয়ে স্বদেশের পথে রওনা দেয় এমভি আবদুল্লাহ।