ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ নামল ১৩ বিলিয়ান ডলারে
আমদানিকারকদের জরিমানা গুনতে হবে?
বৈদেশিক
মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে সরকার আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে বেশ
কিছু পদক্ষেপ নিলেও থামেনি অব্যাহত পতন। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতি মাসেই রিজার্ভ আগের মাসের তুলনায় কমছে। তিন মাসের আমদানি খরচ পরিশোধ করতে না পারলে বাংলাদেশের
ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র খুলতে গেলেই আন্তর্জাতিকভাবে জরিমানার মুখে পড়বে।
ডলার
সংকটের সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স
প্রবাহ কম থাকায় দেশে
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দুই বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে কমছে। এরই মধ্যে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল বাবদ ১৬৩ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে এক দশকের মধ্যে
সর্বনিম্ন।
আইএমএফর হিসাবে,
ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ
এখন ১৩ বিলিয়ন ডলার।
আর
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২৩ দশমিক ৭২
বিলিয়ন ডলার। কারণ তারা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ
করা ডলার ও আরও কয়েক বিলিয়ন ডলার যা শিগগির ব্যয় হবে তা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে যা
আইএমএফ করে না।
আইএমএফের
হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালের
শুরুর দিকে রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারের
ঘর ছাড়ানোর পর কখনও এর নিচে নামেনি। ২০২১
সালের আগস্টে রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন (৪ হাজার
৮০০ কোটি) ডলারে উঠেছিল।
চলতি
বছরের শুরু থেকে মে পর্যন্ত রিজার্ভের
পরিমাণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জানুয়ারি মাস থেকে খুবই দ্রুতগতিতে রির্জাভ কমতে শুরু করে।
আমদানি বিল পরিশোধের সামর্থ্য
এখন যে রিজার্ভ
আছে, প্রতি মাসে
৫ বিলিয়ন ডলার হিসেবে এ রিজার্ভ দিয়ে
তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে না। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই মানদন্ডে বাংলাদেশ এখন শেষ প্রান্তে রয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ।
রিজার্ভ
কমে গেলে কোনো দেশই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা করতে আসবে না।
কিভাবে তৈরি
হয়
রিজার্ভ
রেমিট্যান্স,
রপ্তানি আয়, বিদেশি বিনিয়োগ, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা
থেকে পাওয়া ঋণ
দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়। আর আমদানি ব্যয়,
ঋণের সুদ বা কিস্তি পরিশোধ,
বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা, বিদেশে পর্যটন বা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনাসহ
বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় হয়
তার মাধ্যমে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। এভাবে আয় ও ব্যয়ের
পর যে ডলার থাকে
সেটাই রিজার্ভ। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে রিজার্ভ কমে যায়।
আন্তর্জাতিক
বাজারে জ্বালানি তেল ও বিভিন্ন পণ্যের
দাম বেশি থাকায় আমদানি ব্যয় কমেনি। এছাড়া করোনার পর বৈশ্বিক বাণিজ্য
আগের অবস্থায় ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বাংলাদেশে। পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে দেশে ডলার-সংকট প্রকট আকার ধারণ করে, যা এখনো অব্যাহত
আছে। এ সংকট দিন
দিন বাড়ছে। বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার চলে যাচ্ছে।
২০২৩
সালের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ
বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে।
এ সময় কিছু নীতি সংস্কারসহ বেশ কিছু শর্ত দেয় তারা। ঋণ কর্মসূচি শুরুর
পর দুই কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি পেয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় কিস্তিতে ৭০ কোটি ডলার
পাওয়ার কথা আগামী মাসে। তার আগে পর্যালোচনা বৈঠক করতে ঢাকায় এসেছিল আইএমএফের ১০ সদস্যের প্রতিনিধি
দল।
আইএমএফ
বাংলাদেশকে যে ঋণ দিয়েছে,
তার অন্যতম শর্ত হলো তাদের লক্ষ্য অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ সংরক্ষণ করা। সেই অনুযায়ী গত মার্চ মাস
শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রকৃত রিজার্ভ থাকার কথা ১ হাজার ৯২৬
কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু ওই সময় প্রকৃত
রিজার্ভ ছিল ১ হাজার ৫০০
কোটি ডলারের কম। এছাড়া আগামী জুন নাগাদ লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ২ হাজার ১০
কোটি ডলার। লক্ষ্য পূরণে বার বার ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের আবেদনের প্রেক্ষিতে রিজার্ভ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে শর্ত কিছুটা শিথিল করেছে আইএমএফ।
আইএমএফ
বুধবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, আগামী জুনের মধ্যে প্রকৃত রিজার্ভ ১৪ দশমকি ৭৬
বিলিয়ন ডলারে রাখতে হবে।
রিজার্ভের ঘাটতি
কিভাবে
পূরণ
করা
যায়
অর্থনীতিবিদরা
বলেছেন, রিজার্ভের পরিমাণ গড়ে প্রতি মাসে এক বিলিয়ন ডলারের
বেশি করে কমার কারণ হচ্ছে ডলারের আয় ও ডলারের
ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা। পর্যাপ্ত যোগান না থাকার কারণে
আমদানি কমালেও তা রিজার্ভ ধরে
রাখতে সহায়ক হয়নি। এখন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার দুটো উপায়আছে।
প্রথমটা
হচ্ছে, ডলারের বিনিময় হার বাজারের কাছে ছেড়ে দেয়া। এখন অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক তাই করেছে। বিনিময় হার যে পর্যায়ে উঠলে
চাহিদা কমবে, সেটিকে সে পর্যায়ে উঠতে
দিতে হবে। এতে ডলারের দাম বেড়ে গেলে ডলার কেনার প্রবণতা কমবে। আর আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে
বেশি দাম পেলে প্রবাসী ও রপ্তানি আয়
বাড়বে। সব মিলিয়ে চাহিদা
কমে যোগান বাড়বে। এটাই ডলার সংকট সামাল দেয়ার সবচেয়ে টেকসই উপায় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল
হক।
আর
দ্বিতীয় উপায়টি হচ্ছে, ডলারের যোগান বিভিন্ন উৎস থেকে বাড়ানো যা বাংলাদেশ বর্তমানে
চেষ্টা করছে।
রিজার্ভ থেকে
ডলার
বিক্রি
বাজারে
ডলার সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিকভাবে বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে আমদানি
ব্যয় মেটাতে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার
বিক্রি করেছে বাংলাদেম ব্যাংক। এর আগে গত
২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয়
ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩ দশমিক ৫৮
বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে। তার আগের অর্থবছর বিক্রি করে ৭ দশমিক ৬২
বিলিয়ন ডলার।