
ছবি: বাংলা আউটলুক
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে স্থানীয় ঠিকাদারদের মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে টাকার অংকে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। মূলত আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই নেতার হস্তক্ষেপে রেলে একের পর এক প্রকল্প বাগিয়ে নিয়েছে ম্যাক্স। টেন্ডার প্রক্রিয়ার কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে একচেটিয়া দরপত্র পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সময়টা ২০১১ সাল। তখন খুঁড়িয়ে চলছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ওই সময়ে মাত্র ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার ছোট ছোট নির্মাণ কাজ করতো প্রতিষ্ঠানটি। তাও টেনেটুনে শেষ করতে হতো। ব্যাংক লোন নিয়ে চলতো প্রকল্পের কাজ। তখন এককভাবে মাত্র ১৬.৭০ কোটি টাকার রেললাইন প্রকল্প নির্মাণের অভিজ্ঞতা ছিলো ম্যাক্সের। তাও কাজের মান ছিল নিম্ন। কিন্তু আওয়াম লীগের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও মির্জা আজমের সহায়তায় রাতারাতি বদলে যায় ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। মন্ত্রীর সহায়তায় দরপত্রে ১৫ নম্বরে থেকেও ২০৯ কোটি টাকার চিনকি আস্তানা হতে আশুগঞ্জ রিনিউয়াল রেল প্রকল্পের কাজ পেয়ে যায় ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার।
ওই প্রকল্প পেতেও জালিয়াতি করে ম্যাক্স। মাত্র ১৬ কোটি টাকার একটি কাজের সঙ্গে আরও দুটি চলমান প্রকল্প ৫০ ও ৯৬ কোটি টাকার যোগ্যতা একসঙ্গে দেখিয়ে চিকনি প্রকল্পের দরপত্রে অংশগ্রহণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। পরে মন্ত্রীর লিখিত সুপারিশে কাজও পেয়ে যান।
মূলত সেখান থেকেই ম্যাক্সের উথান শুরু। তারপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরে শেখ হাসিনা সরকারের নির্মাণ খাতের মাফিয়া খ্যাত দুই প্রভাবশালী নেতার সরাসরি হস্তক্ষেপে রেলে একের পর এক বড় বড় প্রকল্পের কাজ পেতে থাকে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এই দুই নেতার প্রভাব খাঁটিয়ে রেলের সব প্রকল্প একাই গিলে খেয়েছে গ্রুপটি। গত ১৫ বছরে উন্নয়ন খাতের অন্তত ৬০ হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার, যা দেশের উন্নয়ন খাতে নজিরবিহীন ঘটনা।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরে এখনো রেল সিন্ডিকেট ধরে রেখেছে ম্যাক্স গ্রুপ। চিকনি আস্তানার পরে কাশিয়ানি-গোপালগঞ্জ রেল প্রকল্পের একাধিক অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নের কাজ পায় ম্যাক্স। এখনও রেলের বড় দুটি প্রকল্পেও কাজ করছে গ্রুপটি।
কিভাবে পূর্ব অভিজ্ঞাতা ছাড়াই ২০৯ কোটি কাটার চিকনি আস্তানা ক্ষয়প্রাপ্ত রেল প্রকল্প, ২০১১ সালে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার লাকসাম-চিনকি আস্তানা রেল প্রকল্প, ২০১৫ সালে ৬ হাজার কোটি টাকার আখাউড়া লাকসাম রেলপথ প্রকল্প, ২০১৬ সালে ১৮ হাজার কোটি টাকার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পেলো ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ৪ নম্বর গ্রেডের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হয়েও তারা কিভাবে রেলের এতোবড় প্রকল্প বাগিয়ে নিলো?
এতো অল্প সময়ে কোন শক্তির জোরে যোগাযোগ খাতে মাফিয়া হলে উঠলো প্রতিষ্ঠানটি? কোন ক্ষমতার বলে এমন একচেটিয়া আধিপত্য করতে পারলো ম্যাক্স। ১৬ কোটি টাকার কাজ পাওয়ার যোগ্য প্রতিষ্ঠান কিভাবে ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পেলো তা নিয়ে রেল খাতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তবে দরপত্রে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই নেতা জড়িত থাকায় ম্যাক্সের তেলেসমাতি কাণ্ড নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। অনুসন্ধানের ম্যাক্স গ্রুপের জাল জালিয়াতি ও ক্ষমতার পেছনে কারা তা বেরিয়ে এসেছে।
ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর। নিজেকে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম দাতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে দুর্নীতির দায়ে জেলও খেটেছেন। এখনও দুর্নীতির মামলা চলমান আছে। বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া ঠিকাদারদের মধ্যে অন্যতম এই আলমগীর।
রেলওয়ে ছাড়াও সম্প্রতি ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ পেয়েছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। চীনের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে সড়কটির একাংশের নির্মাণকাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রেলের আরেক শীর্ষ ঠিকাদার তমা কনস্ট্রাকশন। দোহাজারী-কক্সবাজার ও আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ৬ হাজার ১৬১ কোটি টাকার কাজ করছে তমা। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আতাউর রহমান ভূঁইয়া। একসময় নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে পরাজিত হন তিনি। তমা কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে তিনি সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠজন বলেই যে প্রকল্পের কাজ চেয়েছে তাই-ই পেয়েছেন ম্যাক্স লিমিটেড।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মালিক গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মির্জা আজমের বন্ধু। আওয়ামী লীগের একটি উপকমিটিতেও নাম রয়েছে এই আলমগীরের। সেই সুবাদে মির্জা আজমের সহায়তায় রেলের সব প্রকল্পে একচ্ছত্র আধিপত্য দেখাতেন ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। দরপত্রে যোগ্যতার মাপকঠিতে ১০ নম্বরে থেকেও রেলের একের পর এক প্রকল্পের কাজ পেয়েছেন ম্যাক্স লিমিটেড। একপ্রকার প্রতিযোগিতাহীনভাবে রেলের ৯০ শতাংশ প্রকল্পের কাজ পেয়েছে ম্যাক্স গ্রুপ। ৩০ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে তিনি কাজ পেতেন বলে রেল সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
মির্জা আজমের একটি ঘনিষ্ট সূত্র বলছে, গত ১৫ বছরে রেলের ৭০ হাজার কোটি টাকার কাজ একাই নিয়ন্ত্রণ করেছেন মির্জা আজম। শেখ রেহানা সিন্ডিকেটের প্রধান হয়ে কাজ করেছেন মির্জা আজম। এসব প্রকল্প দুটি তৃতীয় সারির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। তাদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের কমিশন নিয়েই এসব কাজ তাদের দেওয়া হয়েছে। মির্জা আজম শুধুমাত্র মিডিয়া, পুরো টাকা চলে গেছে শেখ রেহানার কাছে। ম্যাক্সের মালিক আলমগীরের সঙ্গেও শেখ রেহানার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল।
যেভাবে প্রতারণা করেছে ম্যাক্স
ঠিকাদারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক দরপত্রে জয়েন্ট ভেঞ্চারের শর্ত মোতাবেক, শুধু পার্টনার হিসেবে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে হলে ওই প্রকল্পের মোট মূল্যের অন্তত ২৬ শতাংশ মূল্যমানের কাজ করার অতীত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু ম্যাক্সের ২ শতাংশ কাজ করার অভিজ্ঞতাও ছিল না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের দরপত্র বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী দরপত্র দলিল দাখিলের সময় ম্যাক্স তাদের দেওয়া অতীত অভিজ্ঞতার সপক্ষে যে আইনগত পরিচয় ও কাজের কথা (লাকসাম-চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প) উল্লেখ করেছে, তা ছিলো অস্পষ্ট ও জালিয়াতিতে পরিপূর্ণ। এজন্য তারা যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছে তাতে তারা বিদেশি লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে প্রথমত ওই কাজে তাদের অংশ নেওয়ার সুযোগ করে নিয়েছে। পরে ওই কাজের পুরো অভিজ্ঞতাকেই নিজের বলে দাবি করে চালিয়ে দিয়েছেন, যা রেল খাতের একটি ভয়ঙ্কর জালিয়াতি ছিলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের এক কর্মকর্তা বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের কাজটি মূল প্রকল্প দলিল ডিপিপি ও সংশোধিত প্রকল্প দলিল আরডিপিপি মোতাবেক একক কাজ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। যোগ্যতার মানদন্ডে অতীত অভিজ্ঞতায় আর্থিক মূল্যমানের সীমারেখা বিবেচনায় ম্যাক্সকে ওই প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য এই একক কাজকে তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান ও মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন; যেটি লট-১ ও লট-২ প্যাকেজ নামে পরিচিত। লট-২ প্যাকেজের কাজ ম্যাক্স লিমিটেড নিয়েছিলো একটি চাইনিজ ঠিকাদারে সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার করে।
সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পরিবেশ,পাহাড় ও জীববৈচিত্রের ধংস করে শেখ হাসিনার রেল সিন্ডিকেট তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মাধ্যমে রেললাইন নির্মাণের কাজ দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় রেল সেক্টরে সর্ববৃহৎ দুর্নীতির মহোৎসবের আয়োজন হয়। ভয়াবহ অনিয়ম বুঝতে পেরে এই প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেন মূল্যায়ন কাজের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসিব মোহাম্মদ আহসান। এডিবির সরাসরি ইন্ধন ও অন্তর্ভুক্তিতে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সরাসরি সহযোগিতায় এই সেক্টরে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের এক মহোৎসব সম্পন্ন করা হয়েছে। ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে সম্পাদিত ওইসব ক্রয় চুক্তির মহোৎসবে যে সব দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তাতে তৎকালীন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন, সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, নাজনীনা আরা কেয়া, লিয়াকত আলী খান, মফিজুর রহমান ও আবুল কালাম চৌধুরী।
এছাড়া ৭২ কিলোমিটার লম্বা আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন রেল নির্মাণ কাজের চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৫ জুন ২০১৫ সালে ৬৫০৪ কোটি টাকায়। বাস্তবায়নকারী সিটিএম চায়না রেলওয়ে গ্রুপ, তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, ম্যাক্স লিমিটেড। যৌথভাবে ওই প্রকল্পের কাজ সম্পাদন করেছে। এই চায়না রেলওয়ে গ্রুপ কক্সবাজার প্রকল্পে তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে যুক্ত। আর প্রকল্প পরিচালক সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী ছিলেন এই সিন্ডিকেটের আলোচিত অন্যতম সদস্য। কক্সবাজার প্রকল্পের পরিচালক মফিজ যাচাই ছাড়া এবং টিবিইআর সদস্যদের মতামত ব্যতিরেখে এডিবিতে পাঠিয়ে অনুমোদন করান। আর এর মাধ্যমেই এক বিশাল দুর্নীতির প্রয়াসের সফল সমাপ্তি হয়। এভাবেই রেলওয়ের কতিপয় কর্মকর্তা, অযোগ্য দুই ঠিকাদার এবং এডিবি'র সরাসরি ইন্ধন ও অন্তর্ভুক্তিতে রেলওয়ে খাতে দুর্নীতির টাকা লুটপাটের মহোৎসব চালু হয়।
রিকোয়ারমেন্টে যা বলা হয়েছে
এই প্রকল্পের দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য ঠিকাদারদের অতীত অভিজ্ঞতার সপক্ষে বিগত ১০ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ১টি কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে যার মূল্যমান ২৭০ মিলিয়ন ডলার; যা ২২৬৮ কোটি টাকা এবং ট্র্যাক, ব্রিজ, ইমব্যাংকমেন্ট, স্টেশন বিল্ডিং, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। যদি প্রতিষ্ঠানটি জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার করে তাহলে লিড পার্টনারের জন্য কাজের বৈশিষ্ট এবং মূল্যমানের ক্ষেত্রে পুরো অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পার্টনারদের ক্ষেত্রেও ঐরূপ অভিজ্ঞতা ও বৈশিষ্ট থাকতে হবে তবে সেটা মূল্যমানের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ থাকলেই চলবে। অর্থাৎ ২২০৮ কোটি টাকার ২৫ শতাংশ যা ৫৬৭ কোটি টাকা। ম্যাক্স যে কাজের অভিজ্ঞতার সনদ দিয়েছে সে কাজে ম্যাক্সের আইনগত অন্তর্ভুক্তির বিষয়টা কেমন ছিলো? টিএসসির মতামতগুলো প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান মাধ্যমে টেকনিক্যাল বিড ইভালুয়েশন রিপোর্ট এড়িয়ে গিয়ে কিভাবে প্রভিয়াসলি কমপ্লাইড স্টাটাসকে কমপ্লাইড করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে সেই রিপোর্ট এডিবিতে গেলে পরবর্তীতে সেই জবাব হুবহু উল্লেখ করে প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান ম্যাক্সের জবাবকে বৈধতা দিয়ে সুপারিশসহ এডিবির কাছে পাঠিয়ে দুর্নীতির ষোল কলাপূর্ণ করে। লাকসাম চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে ক্রয়চুক্তি সম্পাদিত হয় সিআরএম জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে। ম্যাক্স এখানে শুধু পার্টনার। কাজের সফল সমাপ্তিতে লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্টকে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রকল্প পরিচালক কর্তৃক অভিজ্ঞতার যে সনদ দেওয়া হবে তাতে পার্টনার হিসেবে ম্যাক্স এর নামও উল্লেখ থাকবে। ম্যাক্স এই অভিজ্ঞতার ক্রেডিনশিয়ালিটি পাবে জয়েন্ট ভেঞ্চার এসোশিয়েশন করার সময় ওই এসোসিয়েশনে তার অন্তর্ভুক্তির পার্সেন্ট হিসেবে।
পদে পদে জালিয়াতি করে ম্যাক্স
২০১১ সালের ১৭ অক্টোবর বাংলাদেশ রেলওয়ের সাথে সিআরএম জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার অ্যাসোসিয়েশনের চুক্তিপত্র সম্পাদিত হওয়ার মাত্র দেড় মাস পর ওই জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার অ্যাসোশিয়েশনে অঙ্গীভূত ৩টি প্রতিষ্ঠানের যৌথ স্বাক্ষরে প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলীর নিকট এই বলে পত্র দেয় যে, তাদের জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার অ্যাসোসিয়েশনে যে দুটি চাইনিজ কোম্পানি আছে লিড পার্টনারের একটি চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট, আরেকটি পার্টনার চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। তারা অনিবার্য কারণবশত এই প্রকল্পের কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, জনশক্তি, যন্ত্রপাতি ও অর্থ চায়না থেকে দ্রুত আনতে পারবে না। তাই তাদের লোকাল পার্টনার ম্যাক্স এই প্রকল্পের ১০০ শতাংশ কাজ একাই সম্পন্ন করবে। কাজ শেষ ১০০ শতাংশ যোগ্যতার সনদ ম্যাক্সই পাবে। পরবর্তীতে জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার অ্যাসোসিয়েশনের পার্টনারদের মধ্যে সম্পাদিত বোঝাপড়ায় স্বত প্রণোদিতভাবে ক্ষমতাবান হয়ে সিআরএম জয়েন্ট ভ্যাঞ্চারের পক্ষে ম্যাক্স ওই বছর ডিসেম্বরে প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর আরেকটি চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে ম্যাক্স দাবি করেন তাদের দ্রুত কাজ শুরু করতে হবে যাতে ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল এই ৫ মাস সময় তারা কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু এই সময়ে লিড পার্টনার দুই বিদেশি প্রতিষ্ঠান দ্রুত তাদের সরঞ্জাম আনতে পারবে না। চুক্তির শর্ত অনুসারে চুক্তিকৃত কাজ সম্পাদন ও বাস্তবায়নে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান সবাই যৌথভাবে ও পৃথকভাবে দায়বদ্ধ। তাই অংশীদারদের মধ্যে কেউ যদি তাদের অংশের কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তবে অপর অংশীদার তাদের ফেলে রাখা বাকি কাজ শেষ করবে। সেই শর্তানুসারে এটা ম্যাক্সের দায়িত্ব জয়েন্ট ভ্যাঞ্চারের পক্ষে একাই সব কাজ শেষ করা।
সিআরএম জয়েন্ট ভ্যাঞ্চারের পক্ষে ম্যাক্স ইতিমধ্যেই ১০ শতাংশ পারফরম্যান্স গ্যারান্টি জমা দিয়েছে। চাইনিজ দুটি প্রতিষ্ঠান লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট এবং পার্টনার চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন সম্মত আছে, যে ম্যাক্স তার নিজস্ব যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম দ্বারা ১০০ শতাংশ কাজ শেষ করবে। এটা নিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে। এরকম একটা অনৈতিক, অযৌক্তিক, ক্রয় চুক্তি বহির্ভূত, ক্রয় আইন পরিপন্থী এবং সর্বোপরি একটা খোঁড়া প্রেক্ষাপট তৈরির পর ম্যাক্স বলেন এ অবস্থায় এত বড় একটা প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংক থেকে তাদের বড় অংকের লোন গ্রহণ করা প্রয়োজন। ব্যাংক বলছে তারা ম্যাক্সকে লোন দিবে যদি ক্রয়কারী বাংলাদেশ রেলওয়ে ম্যাক্সকে ১০০ শতাংশ কাজ করার অনুমতি দেয়। পরে ওই প্রকল্পের পুরো কাজ একাই শেষ অনুমতি চান। ম্যাক্স দাবি করেন, কাজ শেষের পর বাংলাদেশ রেলওয়ে হতে ম্যাক্সের নামে ১০০ শতাংশ প্রতিযোগীতা সনদ ইস্যু করতে হবে। এটাই হলো ম্যাক্সের সবচেয়ে বড় চাওয়া ও কৌশল। এর মাধ্যমে ১৬.৭ কোটি টাকার কাজে অভিজ্ঞ ঠিকাদার ম্যাক্স লিমিটেড ১৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প কাজ পাওয়ার যোগ্য হয়ে যায়। যেটা পরবর্তীতে ১৮ হাজার কোটি টাকায় কক্সবাজার প্রকল্পের কাজ পেতে সহায়তা করে।
এখন প্রশ্ন? দুটি চীনা কোম্পানির সঙ্গে ম্যাক্স লিমিটেড জয়েন্ট ভ্যাঞ্চারে লাকসাম চিনকি আস্তানা প্রকল্পের কাজ পাওয়ার পরই কেন এরকম অবান্তর প্রস্তাবনা উপস্থাপন করলো যেখানে জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার দুটি কোম্পানিকে বাদ দিয়ে ম্যাক্সকে দিয়ে কাজ করাবে এবং ম্যাক্সের নামে অভিজ্ঞতার সনদ জারি করাবে। এটা তাদের পূর্ব কৌশল ছিল। এই প্রস্তাবনা পুরো ক্রয় আইন, বিধি ও চুক্তির শর্তবহিভূত। কাজ পাওয়ার পূর্বে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক আবশ্যিকভাবে লিড পার্টনার হিসেবে চায়না রেলওয়ের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়িত করেই চায়না রেলওয়ের সঙ্গে পার্টনারদের অন্তর্ভুক্তিতে গঠিত চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট, চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড ও ম্যাক্স লিমিটেড (সিআরএম) এই তিন জয়েন্ট ভ্যাঞ্চার কোম্পানিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে কাজ দেন। ম্যাক্স লিমিটেড একটি প্রকল্পে জয়েন্ট ভ্যাঞ্চারের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে পরে নিজ নামে অভিজ্ঞতার সনদ পেতে পারে না। বিষয়টা আইনে সমর্থিত নয়। মূলত ১৬ কোটি টাকা কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ম্যাক্সকে ১৮০০ কোটি টাকার কাজের অভিজ্ঞতার যোগ্য করা না গেলে পরে কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ১৮ হাজার কোটি টাকার কাজ দেওয়া সম্ভব নয় বলেও এসব জালিয়াতি করা হয়।
যেভাবে অভিজ্ঞতা সনদ নেন ম্যাক্স
ম্যাক্স বলেছে চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট ও চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড তাদের রিসোর্সেস এদেশে আনতে পারবে না। নির্মাণ কাজের মূল কম্পনেন্ট সরবরাহ করেছে লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট। বাংলাদেশ রেলওয়ে প্যাডে এই সার্টিফিকেট দিয়েছে ওই প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকল্প পরিচালক নিজে। যৌথ কাজের লিড পার্টনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কারিগরি বিনির্দেশ মোতাবেক সময়মত সরঞ্জাম সরবরাহ সম্পন্ন করেছে। তাহলে ম্যাক্স যে প্রস্তাব দিয়েছিলো, সেটা মিথ্যা ছিল। চীনা কোম্পানি দুটি নিজেদেরকে সরিয়ে নিয়ে শুধু ম্যাক্সের অনুকূলে অভিজ্ঞতার সনদ দেওয়ার মিথ্যা কথা বলেছিল। কিন্তু তারাই রেলপথ নির্মাণের মূল উপাদান রেল সরবরাহ করেছিল। যার পরিমাণ ছিল ৭ হাজার টন। প্রশ্ন উঠে যে কিভাবে লিড পাটনার চায়না রেলওয়ে মেটারিয়াল ইম্পটেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট ও পার্টনার চেঙ্গু রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড ওই প্রকল্পের কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকেও নিজেদেরকে সম্পৃক্তহীন ঘোষণা দিয়ে ১০০ শতাংশ অভিজ্ঞতার সনদ ম্যাক্সকে দেওয়ার শর্তকে সমর্থন করলো। আবার সেই শর্তকে প্রকল্পের পিডি ও ডিজি অনুমোদন দিলো। এতে প্রমাণিত হয় কক্সবাজার প্রকল্পের সুযোগ পাওয়ার জন্য ম্যাক্স যাতে ওই প্রকল্প কাজের টেন্ডারে অংশ নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ করতে পারে সেজন্যই এগুলো করা হয়েছিল। পরিষ্কারভাবে লাকসাম চিনকি আস্তানা দ্বৈত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ পেয়েছিল চীনা কোম্পানি দুটি। তারা চুক্তি সম্পাদন করেছিলো এবং যৌথভাবে কাজ শেষ করেছিল। অভিজ্ঞতার সনদ জারি হওয়ার কথা ছিলো এই তিন কোম্পানির নামে। কোনো অবস্থায় ম্যাক্সের নামে নয়। ম্যাক্সকে সার্টিফিকেট দেওয়ার সময় চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও পিডি শব্দগত ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছিল। তার তথ্য প্রমাণ এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া ২০১১ থেকে ২০১৬ সালে হওয়া ক্রয় চুক্তিতে কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন তৎকালীন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন, সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, নাজনীনা আরা কেয়া, লিয়াকত আলী খান, মফিজুর রহমান ও আবুল কালাম চৌধুরী।
ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। বিস্তারিত বলার পরে লিখিত আকারে বক্তব্য দেবেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান ম্যাক্সের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশ ম্যানেজার ইব্রাহিম খালিদ পলাশ। পরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ম্যাক্সের কেউ আর সাড়া দেননি।