Logo
Logo
×

অনুসন্ধান

ফ্যাসিবাদের দোসর জসীমে ধূসর পররাষ্ট্রের কার্যক্রম, আওয়ামীপন্থিদের নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয় ও গুরুত্বপূর্ণ মিশন

জুলকারনাইন সায়ের

জুলকারনাইন সায়ের

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:২৪ পিএম

ফ্যাসিবাদের দোসর জসীমে ধূসর পররাষ্ট্রের কার্যক্রম, আওয়ামীপন্থিদের নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয় ও গুরুত্বপূর্ণ মিশন

ছবি: বাংলা আউটলুক

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের আশীর্বাদে ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন মো. জসীম উদ্দিন। আর ২০১৮ সালে পেয়েছিলেন জনপ্রশাসন পদক। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের সুবিধাভোগী সেই জসীমকে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তার খেসারতও অবশ্য এখন দিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। 

জানা যায়, কট্টর আওয়ামী সমর্থক ছাড়া কাউকেই জনপ্রশাসন পদক দেওয়া হতো না। ফ্যাসিবাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় জসীমকে আওয়ামী সরকার প্রথমে গ্রিস, তারপর কাতার এবং সর্বশেষে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার চীনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়। 

জুলাই গণআন্দোলন যখন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছিল, ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ দমনে স্বৈরাচারী হাসিনা যখন নির্মম হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল, তখনো জসীম ফ্যাসিবাদী সরকারকে তোষণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছিলেন। পুরো দেশ যখন অগ্নিগর্ভ, উচ্চাভিলাসী ও সুবিধাভোগী জসীম তখনও হাসিনা সরকারের প্রতি ছিলেন অনুগত। তারপরও অন্তর্বর্তী সরকারে তাকেই পররাষ্ট্র সচিবের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যিনি গত ছয় মাসেও ভারতে কাউকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেননি। হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে এবং দিল্লিতে বসে হাসিনার বাংলাদেশ বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধের ব্যাপারে ভারতের ওপর সামান্যতম চাপ সৃষ্টি করতে পারেননি। অথচ ফ্যাসিবাদের দোসরদের বহাল তবিয়তে রেখে এবং তাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন তিনি।  

শেখ হাসিনার হাত থেকে জনপ্রশাসন পদক নিচ্ছেন জসীম। 

শুধু তাই নয়, ফ্যাসিস্টদের গণহত্যার বিপক্ষে এবং ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষে সমর্থন আদায়েও বিভিন্ন দেশে থাকা মিশনসমূহ কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে কোনো উদ্যোগ বা পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমূর্তি পুনর্গঠনেও বাস্তব কোনো পরিকল্পনা নেই।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিউইয়র্কে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি দূতাবাস বর্তমানে আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী সরকারের সাবেক মন্ত্রী দীপু মনির সুপারিশে টাকার বিনিময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত তার নিজ এলাকার প্রায় ৩০ জন কর্মচারী বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি করছেন। এরমধ্যে একজন হলেন ইতালির মিলানে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে কর্মরত মোক্তার আহমদ। দীপু মনির ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছিলেন মোক্তার আহমদ। দীপু মনির সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সেই মোক্তার টানা প্রায় ১০ বছরেরও বেশি সময় মিলানে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে বহাল তবিয়তে আছেন। মোক্তার তার ফেসবুকে নিয়মিত সরকারবিরোধী পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন।

আর পলাতক সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম রাজশাহীর নিজের নির্বাচনী এলাকা থেকে অস্থায়ী ভিত্তিতে প্রায় ৯০ জনকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এখন সেসব কর্মচারীকে অবৈধভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি স্থায়ীকরণে ষড়যন্ত্র চলছে। 

জসীমের বিরুদ্ধে গুরুতর যত অভিযোগ 

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হলেন মাজেদা রফিকুন্নেছা। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের দোসর রাষ্ট্রদূত মাজেদা রফিকুন্নেছার নাম বঞ্চিত কর্মকর্তা হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। দুর্নীতিবাজ হিসেবেও পরিচিত মাজেদা রফিকুন্নেছা। অর্থ আত্মসাৎ এবং দুর্নীতির অভিযোগে ২০১২ সালে তিনিসহ তার  পরিবারের বিরুদ্ধে দুদক অভিযোগ গঠন করে। তারপরও জসীমের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গোপনে বঞ্চিত হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানোর ঘটনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকলেই এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ। জসীমের এই আচরণে ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা কর্মচারীরা অবিলম্বে তার অপসারণের দাবি করেছেন।

ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের পদোন্নতি না হওয়া এবং আওয়ামী লীগের হয়ে কাজের অভিযোগ

জসীমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসাদ আলম সিয়াম। সম্প্রতি নেতিবাচক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের কারণে তিনি সচিব পদে পদোন্নতি পাননি। তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে দীর্ঘদিন চিফ অব প্রটোকল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তারাই প্রটোকল প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেতেন যারা শতভাগ আওয়ামী মনোভাবাপন্ন এবং সরকারের অনুগত ও আস্থাভাজন। 

এছাড়া সিয়াম ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় অষ্ট্রিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফ্যাসিবাদীদের দোসর হওয়ার অভিযোগ এবং এ অভিযোগে সচিব পদে তার পদোন্নতি না হওয়ার ঘটনা অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করে ফেলে। এই পরিস্থিতির জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই ফ্যাসিবাদের দোসর জসীমকে দায়ী করছেন।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সামিয়াকে লস এঞ্জেলেসে কনসাল জেনারেল হিসেবে বহালে ষড়যন্ত্র

গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার পরও সচিব জসীমের প্রশ্রয়ে গণঅভ্যুত্থানের ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও সামিয়া আনজুম লস এঞ্জেলসের কনসাল জেনারেলের দায়িত্বে আছেন। সামিয়া পলাতক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং মোমেনের স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সামিয়ার সঙ্গে মোমেন এবং আওয়ামী ঘরানার বিভিন্ন কর্মকর্তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। মোমেনের স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে সামিয়ার আশ্রয়ে ছিলেন বলেও বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। 

আরও অভিযোগ রয়েছে, মোমেন যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মূলত সামিয়াই চালাত। পদায়ন, নিয়োগ, স্পর্শকাতর সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতেন সামিয়া। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের শেষ পাঁচ বছরে সব অনাচার এবং বৈষম্যের হোতাও তিনি। জাতিসংঘ অনুবিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে ববি সিদ্দিকীর সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ফ্যাসিস্ট সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, গুম ও খুনের পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলে লবিং করা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে লবিস্ট নিয়োগের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।

এছাড়া ড. ইউনুস, গ্রামীণ ব্যাংক, আদিলুর রহমান ও অধিকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রোপাগান্ডা প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন সামিয়া। পুরস্কার হিসেবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার ও মোমেন তাকে লস এঞ্জেলেসে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সরকারের বিভিন্ন মহলে বিষয়টি ব্যাপক সমালোচিত হলেও জসীম এখনো সামিয়াকে বহাল তবিয়তে রেখেছেন। 

পলাতক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন ও তার স্ত্রীর সঙ্গে সামিয়া।

জসীমের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, পলাতক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের স্ত্রীর নির্দেশে সামিয়াকে ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছেন জসীম । সংশ্লিষ্টদের দাবি, ফ্যাসিবাদের দোসর ও নানা অপকর্মের হোতা সামিয়াকে অপসারণ করে আইনের আওতায় আনা জরুরি।

ফ্যাসিবাদের কট্টর সমর্থক আবিদাকে লন্ডনে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ

সম্প্রতি ফ্যাসিস্ট সরকারের কট্টর সমর্থক আবিদা ইসলামকে লন্ডনে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। লন্ডনের হাইকমিশনার হিসেবে তার নিয়োগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন উঠলেও জসীমের সহায়তায় তিনি ওই দায়িত্ব পান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অবস্থান, আবার সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, হাছান মাহমুদ, আব্দুর রহমান, নওফেলের মতো ফ্যাসিস্ট সরকারের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদদের অবস্থান, দুর্নীতির অভিযোগে সদ্য পদত্যাগী ব্রিটিশমন্ত্রী ও পলাতক শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকি ইস্যু, বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা, বিশ্ব রাজনীতিতে ব্রিটেনের প্রভাব এবং ব্রিটেন-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নসহ বিভিন্ন কারণে লন্ডন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আবিদার কট্টর আওয়ামী সমর্থনের বিষয়টি জানা সত্ত্বেও জসীম কেন তাকে লন্ডনে হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিলেন তা খোদ মন্ত্রণালয়ের কারোরই বোধগম্য নয়। জসীমের এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছেন।

আওয়ামী দোসর তৌফিক হাসানকে অস্ট্রিয়ায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ

সম্প্রতি আওয়ামী দোসর ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তা তৌফিক হাসানকে অস্ট্রিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। তৌফিক হাসানের স্ত্রী ফারহানা কাদেরের আপন বড় ভাই এজেডএম শফিউদ্দিন শামীম ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রহসনের নির্বাচনে কুমিল্লা ৮ আসনে বিনা ভোটে আওয়ামী লীগের এমপি হন। স্ত্রী ফারহানা কাদেরের প্রভাব বলয় কাজে লাগিয়ে একেবারেই সাধারণ মানের কর্মকর্তা তৌফিক হাসান ইতোপূর্বে গুরুত্বপূর্ণ ওয়াশিংটন, জেনেভায় বাংলাদেশ মিশনে গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হিসেবে এবং কলকাতায় মিশন  প্রধান হিসেবে পোস্টিং বাগিয়ে নেন বলে অভিযোগ আছে। 

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও আওয়ামী দোসর পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হকের সঙ্গে তৌফিকের ঘনিষ্ঠতা ছিল। কলকাতায় ৫ বছর ডেপুটি হাইকমিশনার থাকাকালীন তৌফিক কলকাতায় শেখ মুজিবের মূর্তি, মুজিবের টেরাকোটা ও মুজিব কর্নার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুজিব বন্দনার ব্যবস্থা করেছিলেন। 

এছাড়াও গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর  বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক দি  ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসে  কলকাতাস্থ  বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের ভিসা আউটসোর্স বিষয়ে ব্যাপক দুর্নীতির নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই ভিসা আউট সোর্স কন্ট্রাক্ট পেতে এভিএফএস গ্লোবালের মতো অভিজ্ঞ কোম্পানি আবেদন করেছিল। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে এবং কোনরকম উন্মুক্ত টেন্ডার আহ্বান না করেই সদ্য নিবন্ধিত ডিইউ ডিজিটাল নামের একটি বিতর্কিত ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এই কর্মকাণ্ডে তৌফিক হাসানের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে জানা সত্ত্বেও জসীম তাকে গুরুত্বপূর্ণ মিশনে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেন।

চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশ মিশন উপপ্রধান মোজাম্মেলকে ড. ইউনূসের একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ বাতিলের ষড়যন্ত্র

গত বছরের ২৬ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক অফিস আদেশের মাধ্যমে চিনে নিযুক্ত বাংলাদেশ মিশনের উপপ্রধান মোজাম্মেল হককে প্রফেসর ড. ইউনূসের একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মোজাম্মেল সরকারি নির্দেশ মোতাবেক বেইজিংয়ে তার দায়িত্ব হস্তান্তর করে ঢাকা আসেন। জসীম তখন দুবাইতে অবস্থান করছিলেন। জসীম পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনকে একাধিকবার ফোন করে মোজাম্মেলের নিয়োগ বাতিলের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। জসীম পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে বলেন মোজাম্মেল একান্ত সচিব হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে যোগ দিলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জসীমের অনুরোধে আলী ইমাম মজুমদারকে ফোন করে মোজাম্মেলের নিয়োগ বাতিলের অনুরোধ করেন। এতে মাত্র একদিনের মাথায় ২৭ অক্টোবর মোজাম্মেলের সেই নিয়োগ বাতিল হয়। 

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, জসীমের ষড়যন্ত্রেই মোজাম্মেলের ওই নিয়োগ বাতিল হয়। মোজাম্মেল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন বঞ্চিত কর্মকর্তা। বিগত ১৫ বছর তাকে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের জুলাইয়ে হাসিনার চীন সফরের সময় মোজাম্মেলকে নিরাপত্তার হুমকি অজুহাতে সপরিবারে ঢাকায় নিয়ে এসে হেন্তো করা হয়। একজন কর্মকর্তা কিভাবে প্রধানমন্ত্রীর জন্য হুমকি হতে পারে তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারোরই বোধগম্য নয়। এই হয়রানি ও ষড়যন্ত্রের পেছনে জসীমের হাত ছিল বলে অভিযোগ। 

মোজাম্মেল হক। 

উল্লেখ্য, গত বছরের জুলাইয়ে চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন বর্তমান পররাষ্ট্রসচিব জসীম। মোজাম্মেলের মতো একজন ফ্যাসিস্ট সরকারবিরোধী বঞ্চিত কর্মকর্তাকে প্রধান উপদেষ্টার একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগে বাধা দেওয়ার ষড়যন্ত্রের ঘটনায় জসীমের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

শাবাব বিন আহমেদকে কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব

শাবাব বিন আহমেদকে কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। তার বাবা ১৯৭৩ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা এবং কট্টর আওয়ামী সমর্থক। শাবাবের বোন ফারাহ নিঝুম ২৪ বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং আওয়ামী সরকারের সময়ে ঝালকাঠির ডিসি হিসেবে কাজ করেছেন। শাবাবের বোনের বিরুদ্ধে আওয়ামী সরকারের সময় ভোট ডাকাতিতে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে তাকে ঝালকাঠি থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। শাবাবের ছোট ভাই সেনাবাহিনীতে কর্মরত এবং বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় দুই দফায় ডিজিএফআইতে কর্মরত ছিলেন। 

ইতোপূর্বে শাবাব আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাফরুল্লাহ চৌধুরীর স্ত্রী নিলুফার জাফরুল্লাহর পিএস হিসেবে সংসদে কাজ করেছেন। শাবাব বর্তমানে নেদারল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত এবং সেখানে মাত্র এক বছর ৯ মাস কাজের পর তাকে কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে পদায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।  একটি পোস্টিংয়ে সচরাচর তিন বছর থাকার কথা থাকলেও জসীমের ষড়যন্ত্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক শাবাবকে কলকাতায় নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করেছেন। 

গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগে লন্ডন মিশন থেকে পালানো কূটনৈতিক মনজুরুলকে প্রথমে রাশিয়ায় এবং পরে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ

কাজের মেয়েকে নির্যাতনের অভিযোগে লন্ডন মিশন থেকে পালিয়ে যাওয়া বিতর্কিত কূটনৈতিক মনজুরুল করিম খান চৌধুরীকে প্রথমে রাশিয়ায় ও পরে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দেন জসীম । 

মনজুরুল করিম ২০১২ সালে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় কাজের মেয়েকে নির্যাতনের অভিযোগে মনজুরুল এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে লন্ডন পুলিশ। পরে বিচারের মুখোমুখি হতে বলা হলে Diplomatic Immunity সুযোগ নিয়ে তিনি বিচার ব্যবস্থা এড়িয়ে সপরিবারে লন্ডন থেকে পালিয়ে যান।

মনজুরুলের পালিয়ে যাবার পর তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ (William Hague) তার ফৌজদারি অপরাধের বিষয়টি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তুলে ধরেন। তাতে ব্রিটেনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভুলণ্ঠিত হয়। 

ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী নাজমুল হককে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রাখা 

গণঅভ্যুত্থানের ছয় মাস পার হলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে বহাল আছেন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের কট্টর সমর্থক নাজমুল হক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের স্পর্শকাতর বদলি প্রমোশন এবং পদায়ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ফ্যাসিস্ট সহযোগী এই নাজমুল। তাকে মহাপরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন গণহত্যার সহযোগী এবং অপসারিত পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ মোমেন। নাজমুল এর আগে আওয়ামী সরকারের সময়েই পরিচালক (সংস্থাপন), গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় এসএসএ শাখায় কর্মরত ছিলেন। তিনি তার কর্মজীবনে দ্বিপাক্ষিক ও বহু পাক্ষিক কূটনীতিতে কোনো প্রকার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসে আওয়ামী লীগ সরকারের বদান্যতায় কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বার্মিংহাম ও জেদ্দায় বাংলাদেশের কনসাল্ জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নাজমুলের বিরুদ্ধে জেদ্দায় কনসাল জেনারেল থাকাকালীন দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ আছে।

নাজমুল হক ও তার স্ত্রী রাশেদা রওনক ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী। তার স্ত্রী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রী হয়েও আওয়ামী সরকারের লেজুড় বৃত্তির কারণে ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের এই শিক্ষক বিভিন্ন টকশোতে ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করে এর সরাসরি বিরোধিতা করেন। নাজমুলের আপন বড় ভাই ২০ তম ব্যাচে পুলিশ কর্মকর্তা জিয়াউল হক ব্যাপক দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে বিগত বিএনপি সরকারের সময়ে চাকুরিচ্যুত হয়। কট্টর আওয়ামী সমর্থক এই পুলিশ কর্মকর্তা ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে পুনরায় চাকরি ফিরে পান। বর্তমানে এই পুলিশ কর্মকর্তা পলাতক রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। মহাপরিচালক প্রশাসনের মতো সংবেদনশীল পদে নাজমুলকে চাকরিতে সচিব জসীম বহাল রেখেছেন। 

জুলাই গণহত্যার সহযোগী নাঈম উদ্দিনকে পুরস্কৃত করা

জুলাই গণহত্যার সমর্থক ও হাসিনার বিশ্বস্ত  নাঈম উদ্দিনকে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিস্মিত হয়েছেন। এই নিয়োগও দিয়েছেন জসীম। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাধ্যমে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামসহ এই অঞ্চলে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন বিষয়ে দেখভাল করা হয়। জসীম হাসিনার বিশ্বস্ত সাবেক চিফ অব প্রটোকল নাঈমকে বিভিন্নভাবে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

হাসিনার স্নেহভাজন, পলাতক সাবেক এসএসএফ প্রধান জেনারেল মুজিবের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ নাঈম গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে অভিহিত করে এবং সরাসরি এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে বিভিন্ন পোস্ট দেয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে শিবির-ছাত্রদলের নাশকতা হিসেবে উল্লেখ করেন। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাঈম উদ্দিন হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

 অনেকের কাছি তিনি হুন্ডি নাঈম হিসেবে পরিচিত। রাস্ট্রাচার প্রধান থাকার সময় পলাতক হাসিনার সঙ্গে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন এবং অবৈধভাবে প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার করেন তিনি। আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে তিনি পোস্টিং পলিসির ব্যত্যয় ঘটিয়ে একাধারে ওয়াশিংটন, কানাডার অটোয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে এবং টরেন্টোতে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে কনসাল জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার অবৈধ প্রভাব এবং স্বেচ্ছাচারিতার কারণে মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী ক্ষতিগ্রস্ত হন বলে অভিযোগ আছে। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে এই কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রাখার যেকোনো প্রচেষ্টা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রতিহত করবেন।

উল্লেখ্য, নাঈমের বাবা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন ছিলেন ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চের অন্যতম সংগঠক, হাসিনার অন্যতম সহযোগী এবং তার কার্যালয়ের মহাপরিচালক। নাঈম ফ্যাসিস্ট সরকারের আশীর্বাদে প্রথমে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস, পরবর্তীতে অটোয়াতে এবং পরে টরেন্টোতে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। 

ফ্যাসিবাদের দোসর এমদাদুল চৌধুরী নিউইয়র্কে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে বহাল তবিয়তে

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এযাবৎকালের সবচাইতে সুবিধাভোগী কর্মকর্তা এমদাদুল ইসলাম চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক আইনবিষয়ক সম্পাদক এমদাদুল সব পলিসির ব্যত্যয় ঘটিয়ে ওয়াশিংটন ও জেনেভায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি করার পর, বর্তমানে নিউইয়র্কে অবস্থিত বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে কর্মরত। দলবাজি করে একসঙ্গে এতগুলো ভালো মিশনে চাকরি করার অভিজ্ঞতা কোনো কর্মকর্তার আছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জানা নেই। 

এমদাদুল ইসলাম চৌধুরী

এমদাদুল সর্বশেষ পলাতক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্বৈরাচারের দোসর সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং সিআরআইয়ের উপদেষ্টা শহিদুল হকের সঙ্গে এমদাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মন্ত্রণালয়ের গোপনীয় ও স্পর্শকাতর সাইফার মেসেজ ফাঁসের অভিযোগ এবং তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলেও সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এমদাদ নিউইয়র্কে পাড়ি জমান। এতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সব স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। 

দুবাইয়ে প্রবাসীদের বিপাকে ফেলা গোপালগঞ্জের বি এম জামাল হোসেনকে পুরস্কৃত

জুলাই আন্দোলনের সময় বিক্ষোভের কারণে দুবাইতে ১৮৮ জন প্রবাসী গ্রেপ্তার হন এবং জেলে যান। সেসময় দুবাইয়ের কনসাল জেনারেল ছিলেন গোপালগঞ্জের সন্তান বি এম জামাল হোসেন। তিনি দুবাই সরকারকে চিঠি দিয়েছিলেন এসব প্রবাসীদের বিরুদ্ধে যাতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। 

সম্প্রতি দুবাই থেকে ফেরত আসা প্রবাসী শ্রমিকরা প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে দেখা করে জামালের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ দেন। ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে জামালের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। যদিও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো পুরস্কার হিসেবে তাকে বর্তমানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা অনুবিভাগের প্রধান করা হয়েছে। 

বি এম জামাল হোসেনের বিরুদ্ধে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিঠি 

এছাড়া জামালের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বাংলাদেশ মিশনে কাজ করার সময় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। গ্রিসে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করার সময় দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তিনি প্রায় ১০ হাজার ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বাধ্য হন। যদিও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসর জামাল বিগত ১৫ বছর মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক দাপটের সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। জামালের আরেক পরিচয় হলো, তার স্ত্রী যশোরের আওয়ামী এমপি শাহীন চাকলাদারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।

বহাল তবিয়তে আওয়ামী দোসর ফারুকুল ইসলাম ও ফাহমিদা হায়াত

জসীমের সহায়তায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের সহযোগী ফারুকুল ইসলাম বর্তমানেটরেন্টোতে বাংলাদেশের কনসাল্ জেনারেল হিসেবে কর্মরত আছেন। ২৪ ব্যাচের এই কর্মকর্তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যতম সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত। সামিয়া সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য এই ফারুক। মোমেনের সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রমোশন, পোস্টিংসহ স্পর্শকাতর সব বিষয়ে ফারুকের ভূমিকা ছিল লক্ষণীয়। এই ফারুককে আওয়ামী সরকার সকল পলিসির ব্যত্যয় ঘটিয়ে তিনবার নিউইয়র্কে পোস্টিং করেছে। আওয়ামী লীগ ও মোমেনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সিঙ্গাপুরে পোস্টিং শেষ করার কয়েক মাসের মধ্যেই ফারুককে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্টের অফিসে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করা হয়। কথা ছিল জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্টের অফিসে দায়িত্ব পালন শেষে ফারুক দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু তাকে পুনরায় বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে পদায়ন করা হয়। আবার সব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের দায়িত্ব শেষেই সরাসরি টরেন্টোতে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন। সামিয়া সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ফারুককে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জোর দাবি জানিয়েছে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

টরেন্টোস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে আরও কর্মরত আছেন ফাহমিদা হায়াত। তিনি প্রশাসন ক্যাডারের ২১ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক ডিসি, আওয়ামী ভোট ডাকাতির সহযোগী এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের একান্ত সচিব হায়াতউদ্দৌলার স্ত্রী। হায়াতউদ্দৌলা মোমেনের পিএস থাকাকালীন ফাহমিদা প্রভাব খাটিয়ে এই পোস্টিং বাগিয়ে নেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি হায়াতউদ্দৌলাকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন অভিযোগে প্রত্যাহার করা হলেও, ফাহমিদা এখনো বহাল তবিয়তে টরোন্টোর বাংলাদেশ কনস্যুলেটে নিয়োজিত আছেন। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ মিশনে তিনি বহাল তবিয়তে থাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। কিন্তু জসীম নির্বিকার।

চিকিৎসার জন্য তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরে অসহযোগিতা

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য লন্ডন সফরের সময় বিএনপি নেত্রী ও তার সফর সঙ্গীদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ব্যাপারে দলটির পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে জসীমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। অভিযোগ আছে, জসীম বিএনপি নেত্রী এবং তার সফরসঙ্গীদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট ইস্যু করার ক্ষেত্রে অসহযোগিতা করেন। তার এমন আচরণে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দলটির তরফ থেকে পরবর্তীতে জসীমের কাছে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে চিঠি দেওয়া হয়। বিএনপি নেত্রীর চিকিৎসাকে বাধাগ্রস্ত করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েই জসীমের ব্যাপক সমালোচনা করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

কনসালটেশনের নামে গুরুত্বহীন দেশ ভ্রমণ এবং সরকারি অর্থের অপচয়

জসীম গত বছর ডিসেম্বরে কনসালটেশন করার জন্য চেক প্রজাতন্ত্র এবং বসনিয়ায় সফর করেন। কনসালটেশনের নামে গুরুত্বহীন দেশ ভ্রমণ করে অহেতুক সরকারি অর্থ অপচয়ের অভিযোগ ওঠেছে তার বিরুদ্ধে। আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে যখন হামলার ঘটনা ঘটে তখন তিনি চেক প্রজাতন্ত্র ও বসনিয়ার সঙ্গে কনসালটেশনে ব্যস্ত ছিলেন। অথচ দেশ দুটোতে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই এবং দেশ দু’টোর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক নেই। 

এর আগে তিনি কনসালটেশনের জন্য হাঙ্গেরিতে ভ্রমণ করেছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে তিনি কনসালটেশনের জন্য গুরুত্বহীন দেশ আলজেরিয়া ও মিশর সফর করছেন বলে জানা গেছে। চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রভাবশালী দেশসমূহ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক ও সম্প্রসারণের সম্ভাবনাময় দেশসমূহ—সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার এবং মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার সম্প্রসারণের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে অহেতুক তিনি গুরুত্বহীন দেশ কেন ভ্রমণ করছেন এ বিষয়ে খোদ মন্ত্রণালয়ের অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের বর্তমানে জসীম প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ । প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলের বিষয়ে কোনো ভূমিকা না নেওয়ায় অনেকেই এটাকে জসীমের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন।

নিয়ম বহির্ভূতভাবে সরকারি বাসভবন ব্যবহার এবং আর্থিক সুবিধা গ্রহণ

পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে নিয়োগের পর জসীম চীন থেকে বাংলাদেশে আসার পরও তার স্ত্রী ও সন্তানরা প্রায় দেড় মাস নিয়ম বহির্ভূতভাবে সরকারি বাসভবন ব্যবহার করেছে। ছয় দিনের যোগদানকালীন সময় সরকারি বাসভবনে না থাকার নিয়ম থাকলেও জসীম ও তার পরিবার সরকারি বাসভবনে অবস্থান করে এবং তিনি প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ভাতা নিয়ম বহির্ভূতভাবে উত্তোলন করেছেন। এ ধরনের আরও বেশকিছু বিষয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক অনিয়মের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে জসীমের বিরুদ্ধে। 

এদিকে, জসীমের সকল অপকর্মের সহযোগী তার পরিচালক ‘কলেজ পাস’ মাহবুর রহমান। বর্তমানে এই মাহবুর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে অব্যাহতভাবে অসদাচরণ করে চলেছেন। আওয়ামী দালাল ও অযোগ্য এই কর্মকর্তা জসীমের সঙ্গে কাতারে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন বলে জানা যায়। মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে মাহবুর অযাচিত হস্তক্ষেপ করে চলেছেন। 

মাহাবুর ইতোপূর্বে অপসারিত পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ মোমেনের অপকর্মের সহযোগী পরিচালক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জোবায়দ হোসেনকে ম্যানচেস্টারে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগে ভূমিকা রাখেন। এছাড়াও মাহাবুরের ব্যাচমেট, সাবেক ডিপুটি চিফ অব প্রটোকল এবং সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শফিউল আজমকে ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি হিসেবে নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান। মাহাবুরের মূল অ্যাজেন্ডা হচ্ছে মন্ত্রণালয়ে পতিত স্বৈরাচারকে পুনর্বাসন এবং আওয়ামী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। 

এই মাহাবুর পরিচালক (জাতিসংঘ) থাকাকালীন সময়ে গণহত্যাকে সমর্থন জানিয়ে প্রতিনিয়ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিবৃতি প্রকাশ করত এবং ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালাতেন। 

সংশ্লিষ্টদের দাবি, অবিলম্বে জসীমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। বৈষম্যের শিকার অফিসাররা পররাষ্ট্র সচিবের বৈষম্যমূলক আচরণ ও সামিয়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হচ্ছেন। বৈষম্যের অবসান না হলে যেকোনো সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়ে বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সকলের ধারণা।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন