বাবা-মায়ের নামে ফাউন্ডেশন করে ৫৬০ কোটি টাকা কামান শহীদুল

গ্রাফিক্স: বাংলা আউটলুক
বাবা-মায়ের নামে গড়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৫৬০ (প্রায় ৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) কোটি টাকারও বেশি লেনদেন করেছেন বাংলাদেশের সাবেক পুলিশপ্রধান (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক তদন্ত প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহীদুলের প্রতিষ্ঠিত মজিদ-জরিনা ফাউন্ডেশনটি মূলত অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে চালু করা হয়েছিল। আর এই ফাউন্ডেশন সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৫৬০ কোটি টাকার বেশি অর্থের লেনদেন করা হয়। পরবর্তীতে তার পরিবার এই ফাউন্ডেশনকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করে। উল্লেখ্য, জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এক আন্দোলনকারী হত্যার ঘটনায় শহীদুল বর্তমানে কারাগারে আছেন।
ফাউন্ডেশনের দ্বৈত ভূমিকা : আর্থিক অনিয়ম ঢাকতে শিক্ষাকে সামনে রাখা
স্কুল ও কলেজ পরিচালনার জন্য শরীয়তপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত ওই ফাউন্ডেশনটি সারা বাংলাদেশে ৭২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করত। বিএফআইইউর তদন্তকারীদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই ৭২টি অ্যাকাউন্টে ২০০৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৬০ কোটি টাকা জমা পড়ে। মূলত পোশাক প্রস্তুতকারক, নির্মাণ সংস্থা, ডেভেলপার এবং বীমা কোম্পানির মাধ্যমে এসব টাকা জমা হয়। ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ওই বিপুল তহবিল শহীদুলের পারিবারিক মালিকানাধীন নির্মাণ সংস্থা ইরা বিল্ডার্স এবং তার আত্মীয়দের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিতে পাঠানো হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএফআইইউর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে সিলেট, কুষ্টিয়া এবং যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা জমা হতো। বিষয়টি উদ্বেগজনক। সম্পর্কহীন খাত থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আসার বিষয়টি পুলিশপ্রধান হিসেবে শহীদুলের প্রভাবকে কাজে লাগানোর ইঙ্গিত দেয়। তবে তদন্তের সময় পর্যন্ত ফাউন্ডেশনের অ্যাকাউন্টে মাত্র ১০ কোটি টাকা জমা ছিল।
পারিবারিক বিত্তবৈভব ও ভুয়া কোম্পানি
শহীদুলের স্ত্রী শামসুন নাহার রহমান একজন ব্যবসায়ী এবং ‘এ কিউব এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। শামসুন নাহার কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় ২,৩৫,০০০ ডলার পেয়েছিলেন এবং এর মধ্য থেকে তিনি ১,৬৫,০০০ ডলার তুলেও নিয়েছিলেন— তদন্ত প্রতিবেদনে সেটিও বলা হয়েছে। তার অ্যাকাউন্টে এখনও ৭০,৫৮১ ডলার জমা আছে—যা একজন সরকারি কর্মচারীর পরিবারের জন্য ‘খুবই অস্বাভাবিক’ বলে মনে করা হয়।
এদিকে, পরিবারের বিশাল আর্থিক অবস্থান থাকা সত্ত্বেও, অবসর-পরবর্তী শহীদুলের ব্যবসায়ীক উদ্যোগ সারাস শিপিং লাইন লিমিটেডের মাসিক আয় ৪ লাখ টাকা বলে ঘোষণা করা হয়।
ফ্ল্যাট উপহার এবং ব্যাংক জমা
শহীদুল হকের ব্যক্তিগত হিসাবের দিকে নজর দিলে আরও অসঙ্গতি সামনে আসে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের লেনদেনের তথ্যানুযায়ী, তিনি সোয়া দুই কোটি টাকা মূল্যের ৪,৫৭১ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট উপহার পেয়েছিলেন। নিয়মিত আয়ের জন্য তিনি ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়েছিলেন। আর পদ্মা ব্যাংক থাকা তার একটি অ্যাকাউন্টে ১৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা জমা পড়ে। পরবর্তীতে ইরা বিল্ডার্সে স্থানান্তরসহ মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ১৪ কোটি টাকা সেই হিসাব থেকে উত্তোলন করা হয়েছিল।
আইনি কার্যক্রম এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক
শহীদুল হক ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট তিনি গ্রেপ্তার হন। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নৌকার মনোনয়ন সংগ্রহ করেছিলেন শহীদুল হক। তার এই আর্থিক অনিয়মের বিষয়গুলো মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর অধীনে অধিকতর তদন্তের জন্য বিএফআইইউ নিজেদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠিয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক উদ্বেগ
বিএফআইইউ প্রতিবেদনে পদ্ধতিগত দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে উল্লেখ করেছে, শিক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল আইনি ও নৈতিক মূল্যবোধ উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছিল। দুদক এখন তদন্তের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সংস্থাটির দায়িত্ব হলো এসব অনিয়মের জেরে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হবে কিনা তা নির্ধারণ করা।
এদিকে, বিএফআইইউর অনুসন্ধানে পাওয়া অনিয়মগুলো ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারি পদের অপব্যবহারের অভিযোগের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। শুধু তাই নয়, এই অনিয়ম অস্বচ্ছ আর্থিক যোগসূত্রগুলোকেও সামনে নিয়ে আসে—যা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভোগাচ্ছে। দুদক এখন অধিকতর তদন্তের দায়িত্বে আছে। তাই সময়ই বলে দেবে এই ধরনের ক্ষমতাশীল কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে কিনা।