মাইকেল চাকমা নিখোঁজে র্যাবের সংশ্লিষ্টতার নতুন তথ্য
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) সংগঠক মাইকেল চাকমার নিখোঁজের পেছনে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সংশ্লিষ্টতার নতুন তথ্য সামনে এসেছে। এর মাধ্যমে মাইকেল চাকমার নিখোঁজ ঘটনার কোনো এক পর্যায়ে যে র্যাব জড়িত ছিল তার ইঙ্গিত মেলে।
গত ৫ আগস্ট সহস্রাধিক মানুষ নিহতের পর প্রবল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর ৭ আগস্ট রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২৫৯ কিলোমিটার দূরের বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা চট্টগ্রামের একটি সেগুন বন থেকে মাইকেল চাকমাকে উদ্ধার করা হয়।
মুক্ত হওয়ার পর মাইকেল চাকমা জানান, তিনি জানতেন না হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন এবং দুইদিন আগে ভারতে পালিয়ে গেছেন। তিনি যখন বাসে ছিলেন তখন পত্রিকার শিরোনাম পড়ে হাসিনার পতনের খবর জানতে পারেন।
মাইকেল চাকমা নিখোঁজের পর তার দল ও সমর্থকরা অভিযোগ করে আসছিল, তিনি নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চনপুর আসার পর সেখানকার কোনো একটি স্থান থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে গেছে। তবে মাইকেল চাকমা নিশ্চিত করেছেন, তাকে ২০১৯ সালের ১৯ এপ্রিল সাদা পোশাকের একটি দল ঢাকার কল্যাণপুর থেকে মাইক্রোবাসে করে অপহরণ করেছিল।
একদল লোক অজ্ঞাত স্থান থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যে জঙ্গলে মাইকেল চাকমাকে চোখ বেঁধে ফেলে গিয়েছিল, সেখানে কয়েকজন অনুসারীসহ গত ১৯ আগস্ট মাইকেল চাকমা গিয়েছিলেন। ৭ আগস্ট তাকে ফেলে যাওয়ার সময় কাপড়ের দুটি টুকরাও রেখে গিয়েছিল ওই দল। ১৯ আগস্ট গিয়ে সেই টুকরা দুটি পান মাইকেল চাকমা।
সম্প্রতি মাইকেল চাকমা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করেছেন।তিনি বাংলা আউটলুককে বলেন, কাপড়ের ওই টুকরা দুটি ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সংরক্ষণ করেছেন।
চট্টগ্রামে তাকে ছেড়ে দেওয়ার সময় পাওয়া কাপড়ের টুকরা দুটির একটি হলো কালো স্কার্ফ। এই ধরনের কালে স্কার্ফ অভিযান পরিচালনা বা নিয়মিত টহলের সময় র্যাব সদস্যরা মাথায় পরেন।
কালো ওই স্কার্ফ হাতে নিয়ে মাইকেল চাকমা স্মৃতিচারণ করে বলেন, গোপন স্থান থেকে গাড়িতে তোলার আগে ওই কালো কাপড়ের টুকরা আমার চোখ বাঁধার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।
ওই কালো কাপড়টি গত ১৯ আগস্ট চট্টগ্রাম বনাঞ্চলের করেরহাট বিট এলাকায়— যেখানে তাকে চোখ বেঁধে ফেলে যাওয়া হয়েছিল সেখান থেকে পান তিনি। একদল সাদা পোশাকের লোক সেখানে তাকে ফেলে যায় এবং তাকে চোখ খুলতে নিষেধ করেছিল। বলেছিল অনথ্যায় তাকে হত্যা করা হবে। এ ছাড়া কাপড়ের অন্য টুকরাটি ছিল একটি পরিত্যক্ত তোয়ালে।
উদ্ধার হওয়া স্কার্ফটি স্বতন্ত্রভাবে বৈজ্ঞানিকভাবে যাছাই করতে পারেনি বাংলা আউটলুক। তবে স্কার্ফটির সঙ্গে র্যাবের স্ফার্ফের মিল পাওয়া গেছে।
মাইকেল চাকমা নিখোঁজের কোনো এক পর্যায়ে র্যাবের সংশ্লিষ্টতা ছিল কিনা এমন প্রশ্নে সংস্থাটির সদরদপ্তরের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনিম ফেরদৌস বাংলা আউটলুককে বলেন, এটি তদন্ত সাপেক্ষ ব্যাপার। আমার কাছে এমন কোনো তথ্য নেই।
গত ৭ আগস্ট তখনো দিনের আলো ফুটনি, ছোট্ট যে সেলে মাইকেলকে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে অপহরণকারীরা তাকে ডেকে তুলে এবং হাতকড়া ও চোখ বেঁধে একটি গাড়িতে তুলে। তিনি ভেবেছিলেন তাকে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু তারা তাকে গভীর জঙ্গলে ফেলে যায়।
গোপন কারাগারে প্রতিদিন যারা দায়িত্ব পালন করতেন তাদের মধ্যে কয়েকজন মাইকেলকে বলেছিল, তিনি সবচেয়ে দেশের প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) তরফ থেকে সেখানে আছেন। মাইকেল এনফোর্সড গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনে লেখা চিঠিতে বিস্তারিত লিখে বিচার চেয়েছেন।
২০২১ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর তথ্যানুসারে ২০০৯ সালের পর থেকে প্রায় ৬০০ লোক নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে জোরপূর্বক ‘গুমের’ শিকার হয়েছেন।
প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, তারা এইরকম ৮৬টি গুমের ঘটনা যাছাই করেছেন যেখানে ভুক্তভোগীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানা যায়নি। অন্যদের কাউকে কাউকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, কাউকে গ্রেপ্তারে দেখানো হয়েছে বা কাউকে কাউকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।
মানবাধিকার গোষ্ঠী ও কর্মীরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা বন্দিশালায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের রাখা হয়েছিল এবং সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী বা পুলিশের যেকোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা অন্তর্বর্তী সরকারের তদন্তে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে সহায়তায় গঠিত সংগঠন ‘মায়ের ডাক’–এর প্রতিষ্ঠাতা সানজিদা ইসলাম তার ভাইয়ের মুক্তির জন্য এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। তিনি বলেন, হাসিনার পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর গোপন বন্দিশালা থেকে তিনজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
মাইকেল চাকমা ছাড়াও হাসিনার শাসনামলে গুমের শিকার হওয়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমদ বিন কাসেম আরমান এবং আব্দুল্লাহিল আমান আজমী (বহিষ্কৃত সেনা কর্মকর্তা) ছাড়া পেয়েছেন।
এর আগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশে ‘শত শত মানুষ’ জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন।
গত ৬ আগস্ট অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, যে কোনো নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করা যাবে না। তাকে অবশ্যই ‘সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের রক্ষা করতে হবে।
পুলিশের তদন্তে মাইকেল চাকমার মুঠোফোনের সর্বশেষ অবস্থান দেখা গেছে ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরের কাছে। ২০১৯ সালের মে মাসে অ্যামনেস্টি মাইকেল চাকমাকে মুক্তি দিতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে কথা বলেছিল।
গত ৫ নভেম্বর গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন বলেছে, তারা ঢাকায় আটটি ‘গোপন আটক কেন্দ্রের’ সন্ধান পেয়েছে। এছাড়া ৩১ অক্টোবর থেকে তারা ১৬০০-এর বেশি গুমের অভিযোগ পেয়েছেন যেখানে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জড়িতের কথা বলা হয়েছে।
কমিশন এসব অভিযোগের ৪০০টি খতিয়ে দেখেছে এবং প্রায় ১৪০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। কমিশন এসব অভিযোগে ডিজিএফআই, র্যাব, গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি), ক্রিমিন্যাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেনন্ট (সিআইডি) এবং সাধারণ পুলিশের সংশ্লিষ্টা পেয়েছে।
নিরাপত্তা সংস্থার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অভিযোগের মধ্যে ১৭২টি র্যাবের বিরুদ্ধে, ৫৫টি ডিবি, ৩৭টি সিটিটিসি, ২৬টি ডিজিএফআই এবং ২৫টি পুলিশের বিরুদ্ধে করা হয়েছে।