সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যসহ নানা অনিয়মে জেরবার ঢাকা মেডিকেল
সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যসহ নানা অনিয়মে জেরবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ফলে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত রোগীরা প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
অধিকাংশ সময়ই হাসপাতালে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী থাকে।
বিভিন্ন বিভাগের প্রতিবেদনে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে¬।¬ নোংরা পরিবেশ, নিম্নমানের খাবার, জনবলের ঘাটতি এবং অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে হাসপাতালের করিডোরে হাঁটাচলাও কঠিন।
এসব অভিযোগ দিন দিন বেড়ে চলেছে বলে স্বীকার করেছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান খান।
তিনি বলেন, 'আমরা এসব সমস্যা সম্পর্কে জানি এবং এগুলো সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’
একজন রোগী জানান, হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ পেতে নানা অসুবিধার মুখে পড়তে হয়। অধিকাংশ প্রয়োজনীয় ওষুধই এখানে পাওয়া যায় না। বাইরের ফার্মেসি থেকে বেশি দামে এগুলো কেনা ছাড়া উপায় থাকে না।
হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে বলা হয়, ওষুধ নেই, অথচ বাইরের ফার্মেসিগুলোতে ঠিকই পাওয়া যায়। এ কারণে ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দেয়।
গ্রাম থেকে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা এক নারীকে দেখা যায় পাশের একটি ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে যেতে। তার সঙ্গে আরেক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার আত্মীয় নন।
তাকে ফার্মেসিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওই ব্যক্তি কমিশন পাচ্ছেন কি না জানতে চাইলে তিনি উত্তর এড়িয়ে যান।
ওষুধের ঘাটতির বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান খান বলেন,সরবরাহের ঘাটতির কারণে সমস্যা রয়েছে।
তিনি বলেন, সরকার প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ না করলে আমরা কী করতে পারি? অনেক আইটেম আমাদের দরকার, অথচ সরবরাহ করা হচ্ছে না।
এছাড়া কিছু সংখ্যক রোগী অভিযোগ করেছেন, তারা কয়েক দিন ধরে মাত্র এক ধরনের ওষুধ পাচ্ছেন। বাইরের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হওয়ায় রোগীদের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ তৈরি হয়।
একজন হাসপাতালকর্মী বললেন, সরকার থেকে আমরা ওষুধ পাচ্ছি না। বাজেটের ঘাটতির কারণে সব ধরনের ওষুধ সরবরাহ সব সময় সম্ভব হয় না। সম্পূর্ণ চাহিদা পূরণ করতে বাজেট বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে হবে।
সিন্ডিকেট ও ঘুষের অভিযোগ
হাসপাতালের অভ্যন্তরে ঘুষ ও দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে উঠেছে।
হাসপাতালের কর্মচারী ও ওয়ার্ড সহকারীরা হুইলচেয়ার সরবরাহ এবং বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দাবি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন রোগী। এ ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপ রোগীদের খরচ বাড়িয়ে তুলছে।
হাসপাতালে দেখা গেল, এক রোগীকে সহযোগিতা করছিলেন এক একজন অনিবন্ধিত কর্মী। এই সহযোগিতার জন্য তিনি টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমরা কাউকে জোর করি না। কিন্তু যদি তারা দেয়, তাহলে তা আমাদের সহায়ক হয়।
এই ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপের কথা স্বীকার করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামান খান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসব সমস্যার সমাধানে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে বলেও তিনি জানান।
পরিচালক বলেন, দুই পক্ষই এ সমস্যার জন্য দায়ী। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা কয়েকজনকে বরখাস্ত করেছি এবং এমন কার্যকলাপ বন্ধে কাজ করছি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে স্বাস্থ্যখাতে সিন্ডিকেটের ব্যাপক প্রভাব নিয়ে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
এসব সিন্ডিকেটকে ‘জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে’ বলেও মন্তব্য করে আদালত। তাদের বিরুদ্ধে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করে মুনাফা অর্জনের অভিযোগ তোলেন আদালত।
এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে এবং গরিব রোগীদের এ ধরনের শোষণমূলক কার্যকলাপ থেকে রক্ষা করতে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।
চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের সংকট
দেশের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ওষুধের সরবরাহ দীর্ঘদিন ধরে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।
২০২০ সালে একটি জরিপে জানা যায়, ৭২ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে ওষুধের ঘাটতি নিয়মিত। এটি রোগীদের চিকিৎসা গ্রহণের বাধা তৈরি করছে।
ওষুধের ঘাটতির জন্য বেশ কিছু কারণ দায়ী। এর মধ্যে বাজেট বরাদ্দের অপ্রতুলতা, সীমিত স্বাস্থ্য বিমা এবং রোগীর সংখ্যা অতিরিক্ত হওয়া অন্যতম।
স্বাস্থ্য খাতে গত ১২ বছরে দেশের জিডিপির ১ শতাংশের কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটি জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানে অপ্রতুল। স্বাস্থ্যবিমা না থাকায় অধিকাংশ রোগী নিজ খরচে চিকিৎসা করাতে বাধ্য হন।
এ ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, পরিস্থিতি উন্নত করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানান পরিচালক।
বিশ্বব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিচ্ছে, যার মধ্যে ছিল কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য ভ্যাকসিন, সিরিঞ্জ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করা।
সরকার জনস্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক ভর্তুকি দেয়, তবে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এই ভর্তুকি অপ্রতুল।
২০১৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সেখানে হাসপাতালের চিকিৎসা সরবরাহ ব্যবস্থায় আরও কিছু সমস্যার কথা উঠে আসে।
গবেষণাটি হাসপাতাল শপের কর্মীদের উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছিল। এতে দেখা যায়, অর্ধেকেরও বেশি ওষুধ ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে কেনা হয় এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ওষুধ সরাসরি ক্রয় ও দান হিসেবে আসে।
হাসপাতালের ফার্মেসিতে সঠিক সংরক্ষণ-সুবিধার অভাব রয়েছে। সেখানে এয়ার কন্ডিশনিং বা রেফ্রিজারেটর সুবিধা নেই।
ব্যবস্থাপনার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, স্টোরেজ সুবিধা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণ উন্নত করার আহ্বান জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।