৯ হিন্দুর মৃত্যু ঘটনা সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে—দাবি কতটা সত্য?
গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বলেছে, ছয় সপ্তাহ আগে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সহিংসতায় ৯ হিন্দু নিহতের ঘটনাটি দেশব্যাপী হওয়া হিন্দুবিরোধী ‘সাম্প্রদায়িক সহিংসতার’ অংশ ছিল।
কিন্তু সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই ৯টি হত্যাকাণ্ডের কোনোটিতেই ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যের স্পষ্ট কোনো ইঙ্গিত নেই। বরং ওই ৯ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৭টি ঘটনা ছিল রাজনৈতিক প্রতিশোধ, বিক্ষুব্ধ জনতার সহিংসতা এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ। কিছু ক্ষেত্রে যেসব সংবাদ প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি এবং নিজেদের তৃণমূল কর্মকর্তাদের বরাত দেওয়ায় ঐক্য পরিষদের মূল্যায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
নেত্র নিউজ অনুসন্ধানে সময় দুই ডজনের বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে তাদের প্রতিবেদনটি সাজিয়েছে। প্রতিবেদনটি করতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী, নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং সহযোগী, স্থানীয় সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা, সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট, পূর্বে অপ্রকাশিত সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকার এবং অসংখ্য সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা হয়।
সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে আক্রমণ বাংলাদেশে নতুন নয়। বিশেষ করে সরকার বদলের সময় এই ঘটনা ঘটে। যদিও হাসিনা সরকারের পতনের আগে এবং ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর নির্বিচারে ঘটা সহিংসতার ঘটনায় দেশের ১৬ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। ঐক্য পরিষদের প্রতিবদেনে হাসিনা সরকারের পতনের ওই সময়ে দেড় শতাধিক ব্যক্তি—যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের কর্মী এবং পুলিশের সদস্য প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে নিহত হওয়ার তথ্য উঠে আসে। আর এসব হত্যাকাণ্ড হাসিনা সরকার ছাত্র আন্দোলনকে নৃশংসভাবে মোকাবিলা করতে গিয়ে সাত শতাধিক হত্যার পরে ঘটে।
সরকারি নথি এবং সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের আগে এবং পরে আনুমানিক ১০০০ মানুষ নিহত হয়। এর মধ্যে তিন ডজনের কম হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী যা মোট নিহতের প্রায় ৩ শতাংশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮ শতাংশ সনাতন ধর্মালম্বীর অনুপাতে নিহতের এই সংখ্যা অনেক কম। যদিও ঐক্য পরিষদ নিহতদের মধ্যে ৯জনের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রসূত বলে বিশেষভাবে ইঙ্গিত করেছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে হিন্দু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর এবং জীবিকাকে লক্ষ্য করে বিক্ষিপ্ত আক্রমণের ঘটনাগুলো নিয়ে প্রতিবেদন দেখা গেছে। যা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর ভীতি ও আতঙ্কের অনুভূতি তৈরি করেছে এবং যা ঐতিহাসিকভাবে হাসিনার আওয়ামী লীগ দলের সমর্থনের একটি প্রধান উৎস। যদিও সমন্বিত মুসলিম গোষ্ঠী দ্বারা সংগঠিত নিয়মতান্ত্রিক হিন্দু-বিরোধী নৃশংসতার প্রমাণ খুব সামান্যই পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঐক্য পরিষদের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো বার্তা ব্যাপক নজর কাড়ে। নেত্র নিউজের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬ আগস্ট থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ঐক্য পরিষদের বিবৃতি মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্সে সমন্বিতভাবে ১১ মিলিয়েনের বেশি শেয়ার হয়েছে। আর আগস্ট থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত গুগল নিউজ ইনডেক্সে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে ঐক্য পরিষদ নিয়ে রয়টার্স, অ্যাসোসিয়েট প্রেস ও আল জাজিরায়সহ ইংরেজিতে অন্তত ১৩৩টি নিউউ আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সম্পর্কিত কার্যালয়ের দুই কর্মী জানিয়েছেন, ঐক্য পরিষদের কর্মীরা এবং এর সহযোগীরা দেশটির ওয়াশিংটন ডিসির কংগ্রেস কার্যালয়েও চিঠি পাঠিয়েছে। আর নিউইয়র্কে ঐক্য পরিষদের যুক্তরাষ্ট্র শাখা থেকে ডিজিটাল বিলবোর্ডের মাধ্যমে ‘এই হত্যাকাণ্ড’ থামানোর আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশ সরকারের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঐক্য পরিষদের এসব প্রচার প্রচারনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এসবের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের সময় ঐক্য পরিষদের ওই তথ্যগুলো উল্লেখ করেছে। গত ১৬ অক্টোবর ইলিনয়স থেকে নির্বাচিত কংগ্রেসম্যান রাজা কৃষ্ণমূর্তি ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদন উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেনকে চিঠি লিখেন।
প্রতিটি হত্যার ঘটনায় পাওয়া তথ্যের বিস্তারিত উল্লেখ করে কয়েটি প্রশ্ন ঐক্য পরিষদকে পাঠায় নেত্র নিউজ। বেশ কয়েকবার এই ব্যাপারে ঐক্য পরিষদের বক্তব্য চাওয়া হলেও সংস্থাটি কোনো ধরনের মন্তব্য করেনি।
ঐক্য পরিষদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মনিন্দ্র কুমার নাথ ১৩৬ পৃষ্ঠার একটি প্রতিদেন পাঠিয়েছেন। যেখানে নিপীড়ন থেকে শুরু করে হত্যার মতো সহিংসতার হাজারো হিন্দু-বিরোধী ঘটনার অভিযোগের কথা উল্লেখ আছে। নেত্র নিউজ সেখানে সবচেয়ে গুরুতর দাবি ৯ হিন্দু হত্যার ঘটনাগুলো গভীরভাবে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করে। তবে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখিত সহিংসতার অন্যান্য ঘটনাগুলো নিয়ে কাজ করেনি নেত্র নিউজ।
৯ জনের মধ্যে অন্তত ৩ জন মারা যান শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্টে। ৩ জন মারা যান ৫ আগস্ট। আর সরকার পতনের পর বাকি ৩ জন মারা যান। তবে ৪ তারিখ থেকেই কেন তথ্যগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে এই ব্যাপারে প্রতিবেদনে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি ঐক্য পরিষদ।
অধিকন্তু, প্রতিবেদনটিতে ধর্মীয়ভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ডকে হিন্দুদের এই মৃত্যু থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত (মেথডোলজি) প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। বিশেষত যারা হিন্দু ছিলেন কিন্তু সাধারণ অপরাধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা বিক্ষুব্ধ জনতার সহিংসতার শিকার হয়েছেন। আগেও আর এই রকম ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতি অনুসরণ করে বাংলাদেশে হিন্দু-বিরোধী সহিংসতার নথি তৈরির ইতিহাস রয়েছে।
২০০২ সালেও নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির পর হিন্দু-বিরোধী সহিংসতার ব্যাপক অভিযোগ আনা হয়েছিল। যদিও অনেক অভিযোগের ভিত্তি ছিল। তারপরও বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তৈরি করা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, মাঠ পর্যায়ে স্বাধীন মানবাধিকার সংস্থার তদন্তে দেখা গেছে ওই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ধর্মীয় নিপীড়নের অভিযোগগুলোর কিছু ক্ষেত্রে ‘অতিরঞ্জিত’ এবং সাধারণ অপরাধমূলক ঘটনাকেও ধর্মীয় নিপীড়নের আবরণ দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক কারণে হত্যা
যখন ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলনে তাদের প্রতিবেদন তুলে ধরে তখন সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য রঞ্জন কর্মকার জোর দিয়ে বলেছিলেন, তারা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সদস্যদের লক্ষ্য করে চালানো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতার ঘটনাগুলো বাদ দিয়েছেন। ওইসব ঘটনার মধ্যেও অনেক হিন্দু অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি এই পার্থক্য কিভাবে করা হয়েছিল তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
কিন্তু তাদের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, অন্তত কিছু মৃত্যুর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে রয়েছে।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর হবিগঞ্জে বিএনপি কর্মী রিপন চন্দ্র শীলের কথাই ধরা যাক। তিনি হাসিনা-বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেন এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ।
ডেইলি স্টারকে তার ভাই শিপন শীল বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে বিক্ষোভ মিছিলে গিয়েছিলাম। আমার পায়ে গুলি লেগেছে। হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি আমার ভাই মারা গেছে। সে দেশের জন্য লড়াই করেছে এবং জীবন উৎসর্গ করেছে।’
নেত্র নিউজকে রেকর্ড করা বার্তায় রিপনের বোন চম্বা শীল বলেন, আমার ভাই দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। কিন্তু ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনে রিপন চন্দ্র শীলের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করা হয়নি। কিংবা তিনি যে আওয়ামী লীগের কর্মীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন তাও উল্লেখ করা হয়নি। বা তার মৃত্যুকে যে ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলা হয়েছে তার পক্ষে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ করা হয়নি।
৪ আগস্ট নিহত হারাধন রায়ের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল। তিনি উত্তরাঞ্চলীয় রংপুর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। ২০ অক্টোবর ওই ঘটনায় মামলা করেন হারাধনের স্ত্রী কনিকা রানী। একই ঘটনায় হারাধনের সহযোগী ইসলাম ধর্মের সবুজসহ চারজন নিহত হয়। হারাধন ছাড়া বাকি তিনজনই মুসলিম। বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে সড়কে সংঘর্ষে তারা নিহত হন। কনিকা রানীর দায়ের করা এফআইআরে এমনটাই বলা হয়েছে। এই ঘটনার পর ঐক্য পরিষদের স্থানীয় নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, হিন্দু মন্দিরে আক্রমণের যে গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে তা মিথ্যা। ওই নিহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে তারা জোর দিয়ে বলেছিলেন, এই ঘটনায় তারা কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য দেখেন না। নেত্র নিউজকেও হিন্দু সম্প্রদায়ের দুইজন নেতা ওই বক্তব্যে সমর্থন করেন। তবে বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায় নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন।
কিন্তু ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনে সংস্থাটি নিজেদেরকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু সংস্থাটির স্থানীয় এক শীর্ষ নেতা নেত্র নিউজকে বলেছেন, তিনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন হারাধন রায়ের মৃত্যুটি রাজনৈতিক সহিংসতায় হয়েছে, ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে নয়।
অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড
ঐক্য পরিষদের প্রথম দিকে তথ্য সংরক্ষণ ঘটনাগুলোর একটি হলো নারায়গঞ্জের হোসিয়ারি ব্যবসায়ী টিঙ্কু রঞ্জন সাহার ঘটনাটি। স্থানীয় নিউজ ওয়েবসাইটগুলোতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়। ‘হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি’ আদৌ কোনো হত্যাকাণ্ড নাও হতে পারে। স্থানীয় অপরাধীরা চাঁদা দাবি করে সাহাকে হুমকি দেয় বলে অভিযোগ। এই হুমকির পর ৭ আগস্ট তিনি স্ট্রোক করেন এবং চার দিন পর ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। নারায়ণগঞ্জের হোসিয়ারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বদিউজ্জামান বদু নামে এক মুসলিম নেতা নেত্র নিউজকে বলেন, তিনি সাহার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তিনি বলেন, ‘সেই সময় অপরাধীরা অনেক স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে চাঁদা চাইছিল। মুসলিম ব্যবসায়ীদেরও টার্গেট করা হয়েছিল।’
সাহার মৃত্যু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। ফলে তারা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছিল। স্থানীয় সিটি কাউন্সিলর অসিত বরুণ বিশ্বাস এমন একটি সমাবেশের সভাপতিত্ব করেন। যেখানে তিনিসহ মুসলিম ব্যবসায়ীরা বক্তব্য রাখেন। তারা বলেছিলেন, তিনিও চাঁদাবাজদের দোষারোপ করেছিলেন। তিনি নেত্র নিউজকে বলেন, ‘আমি যা জানি, কেউ তার কাছে চাঁদাবাজির চেষ্টা করেছিল। এরপর সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং কয়েকদিন পরে মারা যায়। রিংকু সাহার ছোট ভাইও সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। তিনিও অপরাধীদের দোষারোপ করেন।
ঐক্য পরিষদের স্থানীয় সংবাদ আউটলেট প্রেস নারায়ণগঞ্জকে উদ্ধৃত করে। স্থানীয় ব্যবসায়ী প্রণব রায়কে উদ্ধৃত করে সেখানেও পুলিশের একটি ‘সোর্স’সহ চাঁদাবাজদের এই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়।
১৮ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সুশান্ত সরকার নামে এক যুবককে হত্যা করা হয়। ঐক্য পরিষদকে উদ্ধৃত জাতীয় পত্রিকা কালের কণ্ঠ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই হত্যাকাণ্ডকে সাম্প্রদায়িক বলে শ্রেণীবদ্ধ করেনি।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আশিক নামে এক ব্যক্তি রাতে সুশান্তকে প্রলুব্ধ করে বাড়ি থেকে বের করে। পরদিন মেঘনা নদীর তীরে তার লাশ পাওয়া যায়। যদিও নারায়ণগঞ্জের ঘটনার মতোই ঐক্য পরিষদ তাদের সোর্সের দেওয়া সম্ভাব্য উদ্দেশ্য বাদ দেয় ঘটনার উল্লেখ করার সময়। কারণ ঘটনার পেছনে মোটরবাইক বিক্রির অর্থপ্রদানের বিরোধ ছিল।
নেত্র নিউজকে সুশান্তের মা রূপালী সরকার বলেন, অভিযুক্ত খুনি আশিক তার ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল। এই ঘটনার পেছনে কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্যের কথা অস্বীকার করেন। স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যম আশিককে আশিক মিয়া নামে শনাক্ত করেছে।
রূপালীর মতে, আশিক তার ছেলের মোটরবাইকটি ৩০ হাজার টাকায় কিনেছিলেন। কিন্তু সময়মতো টাকা দেয়নি। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে সুশান্ত টাকা দাবি করলে আশিক তাকে ফোনে হুমকি দেয় বলে অভিযোগ করেন তিনি। নেত্র নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের টাকা নিয়ে ঝগড়া না করতেও বলেছিলাম। যদি সে টাকা না দেয়, তাই হোক। কিন্তু মাত্র ৩০ হাজার টাকার জন্য সে আমার ছেলেকে খুন করে।’
তার বক্তব্যটি ঐক্য পরিষদের উদ্ধৃত কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনে ছিল। নেত্র নিউজও এই সংক্রান্ত আরও দশটি সংবাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনার মাধ্যমেও তা নিশ্চিত হয়। রূপালী আরও দাবি করেন, আশিক আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে। নেত্র নিউজ স্বতন্ত্রভাবে তা যাচাই করতে পারেনি। উত্তরাধিকার৭১ নামে একটি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমেও আশিককে আওয়ামী লীগের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করেছে। রূপালী আশিকসহ পাঁচজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে উল্লেখ করে থানায় অভিযোগ করেন।
৮ আগস্ট, খুলনার পাইকগাছায় স্থানীয় বাজার থেকে বাড়ি ফেরার সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য স্বপন বিশ্বাস খুন হন। স্থানীয়রা তার শরীরে হাতুড়ির আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান। রাজনৈতিকব অস্থিরতার কারণে স্থানীয় পুলিশ এই মৃত্যুর তদন্ত করতে বা তার দেহ পরীক্ষা করতে পারেনি। পরের দিন পরিবারের পক্ষ থেকে দাহ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হিন্দু স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি বলেছেন, একটি নিরিবিলি জায়গায় মধ্যরাতে তার ওপর হামলা হয়। কে এবং কেন তাকে আক্রমণ করেছে তা নিশ্চিত করা কঠিন।
যদি এটি আদৌ হত্যাকাণ্ড হয়—হিন্দু সম্প্রদায়ের তিন নেতা এবং স্থানীয় সাংবাদিকরা এর পেছনে দুটি যুক্তিসঙ্গত উদ্দেশ্যের কথা বলেছেন। তা হলো চিংড়ি চাষ নিয়ে আইনি বিরোধ, জমি এবং ও দোকান নিয়ে দ্বন্দ্ব৷ স্থানীয়দের বরাত দিয়ে কালের কণ্ঠের এক সংবাদ প্রতিবেদনে তার মৃত্যুর পেছনে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে একই ধরনের বিরোধের কথা বলা হয়েছে।
টেলিফোন সাক্ষাৎকারে ঐক্য পরিষদের পাইকগাছা উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তৃপ্তি রঞ্জন সেনও কাউকে শনাক্ত ছাড়া স্বপনের মৃত্যুর কারণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি নেত্র নিউজকে বলেন, ‘কেউ কেউ বলেছিল যখন সে বাড়ি ফিরছিল, তখন তাকে হাতুড়ি দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছিল, আবার কেউ বলেছিল যে সে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল এবং হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল।
সেন বলেন, তিনি ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়েছেন। তবে এও নিশ্চিত করেছেন, তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি এই মৃত্যুর কারণ। যদি হত্যাকাণ্ডও হয় আদৌ সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছিল কিনা তা নিশ্চিত না।
মব ভায়োলেন্স
৪ আগস্ট মারা যান সাংবাদিক প্রদীপ কুমার ভৌমিক। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রদীপ কুমার ভৌমিক আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় মারা গেছেন। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, ৪ আগস্ট সকালে রায়গঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের অফিসে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জড়ো হোন। এই খবরে আন্দোলনকারীরা দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে হামলা করেন। তখন কয়েকজন নেতাকর্মী দৌড়ে পাশের একতলা ভবনে (যেটি রায়গঞ্জ প্রেসক্লাবের অফিস) ঢুকে পড়েন। এসময় আওয়ামী লীগের এই কর্মীদের ধাওয়া করে প্রেসক্লাবে ঢুকেন আন্দোলনকারীরা। সেখানে তারা সবাইকে পেটান এবং তাদের হাতেই মার খেয়ে মারা যান সাংবাদিক প্রদীপ কুমার। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগের অফিস ভবন থেকে আরও ৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয় বা মিশ্র পরিস্থিতি
সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ময়মনসিংহের ফুলপুরে অজিত সরকার নামের এক কৃষককে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে ও হাত-পা বেঁধে পানিতে চুবিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। পরে তার মরদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয় বলে দাবি স্বজনদের। অজিত ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বালিয়া ইউনিয়নের ডোমকোনা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি একই গ্রামের মানবতাবিরোধী অপরাধী গিয়াস উদ্দিন খানের মামলার সাক্ষী বলে জানা গেছে। অজিত এক সময় ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। তার পরিবারের সদস্যরা এখনো পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন মতে, গিয়াস উদ্দিনের পরিবারের সদস্যদের নেতৃত্বেই অজিতকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
নেত্র নিউজের সাথে আলাপচারিতায় অজিতের স্ত্রী পূর্ণিমা রানী বলেন, হাসিনার পতনের খবর গ্রামে পৌঁছার সাথে সাথে একদল লোক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে হামলা শুরু করে। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িতে হামলা শুরু করে। অতি দ্রুতই তারা আমাদের বাড়িতেও পৌঁছেছে এবং আমার স্বামীর মাথায় আঘাত করে।
পূর্ণিমা রানী, তার স্বামী ও তাদের সন্তানরা একটি কক্ষে আশ্রয় নেয়। ভিড় বড় হওয়ার সাথে সাথে অজিত সরকার আরো নৃশংস হামলার ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কাছের একটি বাড়িতে লুকিয়ে গেলেও জনতা তাকে ধরে নিয়ে যায়। কে তাকে তুলে নিয়ে গেছে তা সে শনাক্ত করতে পারেনি পূর্ণিমা।
৭ আগস্ট খুন হন বাগেরহাটের মৃণাল কান্তি চ্যাটার্জি। এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ধারণা পাওয়া যায়নি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, হত্যার পেছনে আগে থেকে চলে আসা জমি সংক্রান্ত বিরোধের ঘটনা থাকতে পারে। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বাগেরহাটে ঘরে ঢুকে সাবেক এক স্কুলশিক্ষককে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় আহত হয়েছেন তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে।
এই ঘটনার জন্য তার স্ত্রী শেফালী চ্যাটার্জি, এবং মেয়ে ঝুমা রানী চ্যাটার্জি প্রতিবেশী হুমায়ুন শেখ এবং নুরুল ইসলামকে দোষারোপ করেন। কারণ তাদের সঙ্গে জমির মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিনের আইনি বিরোধ ছিল। এই সংক্রান্ত একটি মামলা হাইকোর্টে চলমান। নেত্র নিউজ দুটি পৃথক ফেসবুক ভিডিও পর্যালোচনা করেছে, যেখানে শেফালি সংখ্যালঘু অধিকার সমর্থকদের একটি গোষ্ঠীর কাছে এই অভিযোগগুলি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।