Logo
Logo
×

অনুসন্ধান

লেখালেখির কারণে বাংলাদেশি 'জুলভার্নের ১১ দিনের নরক দর্শন'!

Icon

আবু সুফিয়ান

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৫ এএম

লেখালেখির কারণে বাংলাদেশি 'জুলভার্নের ১১ দিনের নরক দর্শন'!

হুমায়ুন কবির

মাত্র আশি দিনে সারা দুনিয়া ঘুরে আসবেন—এরকম এক কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন ফিলিয়াস ফগ। ব্যাস, বেরিয়ে পড়েছিলেন বিশ্বভ্রমণে। সঙ্গে ছিলেন গৃহভৃত্য গ্যাসপারতু। কী চ্যালেঞ্জ ছিল তাঁর? বাজিতে হারলে তাঁকে হারাতে হবে তাঁর অর্ধেক সম্পদ। ভারতের গভীর জঙ্গল, চীনাদের আফিম সেবন, জাপানিদের সার্কাস, ছুটন্ত ট্রেনে রেড ইন্ডিয়ানদের হামলা, স্টিমারে ফগের নেতৃত্বে নাবিকদের বিদ্রোহ—সব মিলিয়ে টানটান উত্তেজনায় ভরপুর সেই অভিযান। এভাবেই ফরাসি ঔপন্যাসিক, কবি ও নাট্যকার জুলভার্ন বইয়ের পাতায়-পাতায় মাত্র ৮০ দিনে পাঠককে বিশ্বভ্রমণ করিয়েছিলেন।

তবে এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের এক জুলভার্নকে নিয়ে। এটি গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। বাংলাদেশের এই জুলভার্নকে ৮০ দিনে না, মাত্র ১১ দিনে ‘নরক’ দেখিয়েছি বাংলাদেশের ডেথ স্কোয়াড হিসেবে কুখ্যাতি পাওয়া র‍্যাব। 


কিন্তু, কেন? 

হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে কেন লিখিস?

জুলভার্ন নামে ব্লগে লেখালেখি করতেন হুমায়ূন কবির। ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। রাজধানীর গ্রিন রোডে নিজস্ব ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। ব্লগে তার লেখার অনুসারী ছিলেন অনেকে। তীর্যক লেখার সমালোচকও কম ছিলেন না। তো, সেই লেখালেখির মাশুল যে এত ভয়ঙ্করভাবে তাঁর ওপর ফেটে পড়বে তা কে ভেবেছিল!

হুমায়ুন কবির বাংলা আউটলুককে জানান, পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত একটা মামলায় হাজিরা দিতে ২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকা থেকে পিরোজপুর যাওয়ার জন্য সদরঘাটে যান। তিনি সেখানে হুলারহাটগামী একটি স্টিমারে চড়েন, তখনও সূর্য অস্ত যায়নি। সন্ধ্যা ৬টার দিকে আচমকা ৫ জন সাদা পোশাকের সশস্ত্র ব্যক্তি তাকে প্রকাশ্যে তুলে নেন। সদরঘাট পার্কিং এলাকায় রাখা একটি সাদা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে প্রথমেই তাঁর দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে ভেজা গামছা দিয়ে চোখ বাঁধেন তারা। এরপর অজ্ঞাত স্থানে তাঁকে নিয়ে যান। 

হুমায়ুন কবির বলেন, প্রথমেই তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, 'আমি সরকারের বিরুদ্ধে ব্লগে ও ফেইসবুকে কেন লিখি? বিএনপির কোন কোন নেতার নির্দেশে আমি এসব লেখালেখি করি? শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে কেন লিখি? তারা আমাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ আছে তোকে মেরে ফেলার।'

হুমায়ুন কবির আরও বলেন, একপর্যায়ে তাদের মধ্যে কথা বলতে শুনি যে আমাকে গুম করে নির্যাতন ও মেরে ফেলার জন্য ওপর মহলের নির্দেশ আছে। 

দীর্ঘ বছর চুপ থাকলেও এবার সেই ‘নরক দর্শন’ নিয়ে জাতীয় গুম কমিশনে অভিযোগ দিয়েছেন এই ব্যবসায়ী। আর এই ঘটনায় তিনি যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর ছুঁড়েছেন, তাদের মধ্যে অন্তত দুজন এখনও পুলিশের শীর্ষপদে কর্মরত রয়েছেন।

এ কেমন বর্বরতা!

গুম কমিশনে হুমায়ুন কবির যে অভিযোগ করেছিলেন তার অনুলিপি সংগ্রহ করেছে বাংলা আউটলুক। অভিযোগে হুমায়ুন কবির লেখেন, “চোখ বাঁধা অবস্থায় সারারাত আমাকে বেধড়ক মারধর করে, কানে ইলেক্ট্রিক শক দেয়। সারারাত আমাকে শারীরিক নির্যাতন করে। ফজরের আজানের পর আমাকে অর্ধচেতন অবস্থায় অজ্ঞাত একটা রুমে আটকে রাখে। সেই রুমের ছাদ আমার শারীরিক উচ্চতা থেকে কম হওয়ায় আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না। চোখ বাঁধা এবং দুই হাত পেছনে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে নগ্ন করে প্রতিদিন শারীরিক নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে। আমার গোপনাঙ্গে ইলেক্ট্রিক শক দিয়েছে। আমার হাঁটু এবং পায়ের গোড়ালিতে বুটপায়ে থেঁতলিয়ে দিয়েছে। কাঁধে ও কোমরে ভারী বস্তু দিয়ে পিটিয়েছে। আমার কোমর এবং পায়ের নখে সুঁই ফুটিয়েছে, একটা আঙ্গুলের নখ তুলে ফেলেছে।"

অভিযোগে হুমায়ুন কবির আরও লেখেন, "কয়েকদিনই আমাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার কথা বলেছে। আমাকে একপায়ে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে পিটানো অবস্থায় আমার চোখের বাঁধন খুলে যায়। তখন আমি কয়েকজন লোককে দেখতে পাই- যাদের মধ্যে আমাকে স্টিমার থেকে উঠিয়ে আনার সময় যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তাকে চিনতে পারি। তবে আমি কাদের হাতে বন্দী, কোথায় আমার অবস্থান কিছুই জানতাম না। বাথরুম এবং খাবারের সময় একহাতের হ্যান্ডকাফ খুলে দিতো তবে কখনও চোখের বাঁধন খুলে দিতো না, গোসল করতে দিতো না। কখন দিন, কখন রাত আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। মাঝে মধ্যে 'আচ্ছালাতু খাইরুম মিনান্নাউম' শুনে ফজরের আজান হচ্ছে বুঝতে পেরেছি। এভাবে কত দিন গুম অবস্থায় কেটে গিয়েছে তাও আমি বুঝতে পারিনি।"

অভিযোগে হুমায়ুন কবির আরও লেখেন, "হঠাৎ একদিন আমার চোখের বাঁধন এবং হ্যান্ডকাফ খুলে দিয়ে গোসল করতে বলে। অনেকদিন পর চোখের বাঁধন খুলে দেওয়ায় আমি দীর্ঘ সময় চোখে দেখতে পাইনি। ধীরে ধীরে সব কিছু ঝাপসা দেখতে পাই। আমার পরনের শার্ট-প্যান্ট শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ, সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন, নাক-মুখ থ্যাঁতলানো, রক্তাক্ত দেখতে পাই। স্বাভাবিক শব্দ কানে শুনতে পাই না। তখন আমি তাদের কাছে জানতে চাই- আজ কত তারিখ, কি বার, কয়টা বাজে? ওদের একজন বলে- ৭ তারিখ, সন্ধ্যা ছয়টা।"

অভিযোগে হুমায়ুন কবির আরও লেখেন, "একদিন একজন লোক এসে আমাকে শেভ করিয়ে দেয়। আমার লাগেজ ট্রলি ফিরিয়ে দিয়ে নতুন প্যান্ট-শার্ট পরতে বলা হয় এবং আমার পরনের রক্তাক্ত শার্ট-প্যান্ট ওরা নিয়ে যায়। আমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে জানায়। আমার লাগেজ ট্রলিতে ৪ লাখ নগদ টাকা এবং আমার প্যান্টের পকেটে ৪২ হাজার টাকা, হাতে ৬০ হাজার টাকা দামের নতুন টিসট ব্র্যান্ডের দামি ঘড়ি ছিল। এছাড়াও আমার লাগেজ ট্রলিতে ব্যবহৃত একটা Lenova ল্যাপটপ, নতুন HUAWE CAM-121 ব্রান্ড ফোন সেট যা আমার বড়ো বোনের জন্য ১৬ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছিলাম এবং আমার হাতেও একটা একটা HUAWE, MODEL-NMO-L32 ব্রান্ডের অ্যান্ড্রয়েড ফোন ছিল- যার কিছুই আমি ফেরত পাইনি।"

অভিযোগে হুমায়ুন কবির আরও লেখেন, "অজ্ঞাত তারিখে আনুমানিক রাত ৮টা নাগাদ তিনজন লোক এসে আমার প্যান্টের দুই পকেটে দুটি মোবাইল ফোন সেট এবং একটা রুমালে বাঁধা কিছু টাকা ঢুকিয়ে আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানের একটা বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখে। তখন একটা বড় কম্পাউন্ডে র‌্যাব-১০ লেখা অনেক গুলো গাড়ি দেখে দীর্ঘ বন্দিদশায় এই প্রথম বুঝতে পারি- আমি র‌্যাব-১০ হেফাজতে আছি। ৫ জন সিভিল পোশাক পরিহিত লোক আমাকে একটা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে সায়েদাবাদ পিরের বাড়ি এলাকার ঢাকা চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা বাস কাউন্টারে মাইক্রোবাস থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে বলা হয়। যারা আমাকে নিয়ে এসেছিল- তাদের দুজন আমার দুই পাশে হাঁটছিল। আমি কয়েক কদম হেঁটে যেতেই র‌্যাব-১০ লেখা একটা পিকআপ, একটা কালো রঙের ল্যান্ড ক্রুজার জিপ এবং অনেকজন সশস্ত্র ইউনিফর্ম র‌্যাব সদস্যদের দেখতে পাই।"

দৌড় দিলেই তোকে গুলি করে দেবো:

"২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় আমাকে তুলে নেওয়ার সময় যিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং আমাকে ঝুলিয়ে পেটানোর সময় যাকে দেখেছিলাম সেই অফিসারকে দেখে চিনতে পারি। আমি র‌্যাব সদস্যদের দেখে ভয় পেয়ে দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করলে আমার পাশে থাকা দুজন দুই পাশ থেকে আমার পাঁজরে পিস্তল ঠেকিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলে- 'দৌড় দিলেই তোকে গুলি করে দেবো'।"

"তখন র‌্যাবের পোশাক পরিহিত ৪/৫ জন এসে আমাকে জাপটে ধরে টেনে শ্যামলী বাস পরিবহনের টিকিট কাউন্টারে ঢুকিয়ে আমার পকেট থেকে ফোন আর টাকা বের করে বলে- 'এই লোক সন্ত্রাসী, অনেক দিন ধরে তাকে ধরার জন্য খুঁজতেছি'। ফোন দেখিয়ে বলে- 'এই দেখেন, সরকারের বিরুদ্ধে লেখালেখি করার প্রমাণ- একে আমরা গ্রেপ্তার করলাম'। এটা বলে আমার দুই হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেয়।"

"তারপর, উপস্থিত লোকজনের সামনে আমার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করে। বাস কাউন্টারের কয়েকজনকে সাক্ষী হিসেবে নাম ঠিকানা লিখে আমাকে র‌্যাব-১০ লেখা একটা পিকআপ গাড়িতে উঠিয়ে র‌্যাব-১০ ধলপুর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নেওয়ার পর আমাকে র‌্যাব-১০ এর কোম্পানি কমান্ডার এডিশনাল এসপি মহিউদ্দিন ফারুকী (রুমের সামনে নেম প্লেটে লেখা ছিল) সাহেবের রুমে নিয়ে যায়। 

তুই ইন্টারনেটে ও ফেসবুকে সরকার বিরোধী লেখালেখি করিস:

মহিউদ্দিন ফারুকী আমাকে বলেন- “হুমায়ূন কবির, আগে কি হয়েছে সেই সব ভুলে যা, তোকে আজই গ্রেপ্তার করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তুই ইন্টারনেটে ও ফেসবুকে সরকার বিরোধী লেখালেখি করিস। প্রধানমন্ত্রী ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে লিখিস। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্যারদের নির্দেশ আছে তোকে ক্রস ফায়ারে মেরে ফেলার। তোকে ধরার সময় ধস্তাধস্তিতে তোর গায়ে আঘাত লেগেছে। এর বাইরে একটা কথাও বলবি না। আমি র‌্যাব-২ বদলি হয়ে যাচ্ছি। যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলিস তাহলে এবার তোকে র‌্যাব-২ নিয়ে মেরে ফেলব।”


যাদের বিরুদ্ধে জুলভার্নের অভিযোগ:

কমিশনে দায়ের করা অভিযোগে হুমায়ুন কবির বলেন, আমার বিরুদ্ধে সবগুলো মামলার বাদী র‌্যাব-১০। তখন র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক ছিলেন অতিরিক্ত ডিআইজি জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর, যিনি এখন ডিএমপির ডিআইজি। তৎকালীন র‌্যাব-১০ কোম্পানি কমান্ডার এডিশনাল এসপি বর্তমানে এসপি, কমান্ডেন্ট, বেতবুনিয়া পুলিশ ট্র্রেনিংসেন্টার, রাঙ্গমাটি) সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক আইজিপি মো. শহিদুল হক ও র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের নির্দেশে র‌্যাব-১০ আমাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে নায়েব সুবেদার (ডিএডি) জেসিও- ৮২২৬ খায়রুল ইসলাম, র‌্যাব-১০, বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মামলা দিয়ে আমাকে মিরপুর থানায় হস্তান্তর করে। মিরপুর মডেল থানা মামলা নং- ১৮(১১)১৮ জি আর নাম্বার- ৭৬২ তারিখঃ ০৬/১১/২০১৮ইং ধারা- ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ২৫ (১) (ক)/(খ) ৩১ (১)।

রিমান্ডে টাকা আদায়:

কমিশনে দায়ের করা অভিযোগে হুমায়ুন কবির বলেন, "আমাকে চার দিনের রিমান্ড নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করার ভয় দেখিয়ে ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর ডিউটি অফিসার আমার স্ত্রীর নিকট থেকে ২০ হাজার টাকা এবং ৮ নভেম্বর আইও মিরপুর মডেল থানার এসআই কাজী মো. জাহাঙ্গীর আলম, বিপি নং- ৭৬৯৬০২৫৮৭৪ ও ওসি দাদন ফকির আমার স্ত্রীর নিকট থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা নেন। মিরপুর থানা আমাকে চার দিনের রিমান্ড শেষে কোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায়।" 

তিনি আরও বলেন, "একাধিক বার আমার মামলার তদন্ত অফিসার বদলি হয়। আইও এসআই আবদুল কাদের বিপি নং- ৮৮১৩১৫৭৭৯৪, র‌্যাব-১০, এক পর্যায়ে এসআই আবদুল কাদের, (বর্তমান কর্মস্থল- হাতিরঝিল থানা, ডিএমপি) তদন্ত অফিসার নিয়োগ হলে আমাকে বিভিন্ন সময় রিমান্ড এবং ক্রসফায়ারের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। টাকা দিলে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নাম করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং নিজের জন্য একাধিক বার সর্বমোট ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা নেন। যা আমি নগদ এবং তার বিকাশ নম্বরে পরিশোধ করতে বাধ্য হই। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর প্রায় সাড়ে চার মাস পর আমি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জামিনে বের হই।"

মামলায় জর্জরিত এই ব্যবসায়ী:

কমিশনে দায়ের করা অভিযোগে হুমায়ুন কবির বলেন, "জামিনে বের হওয়ার পর জানিতে পারি যে আমার নামে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা নং- ১০৭(১০)১৮ জিআর নাম্বার-১১৮৭ তারিখঃ ২৯/১০/২০১৮ইং ধারা- ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ২৫ (১) (ক)/(খ) ৩১ (১) ধারায় আমাকে এজাহারভুক্ত ৫ নম্বর আসামি করা হয়েছে এবং আই/ওঃ ১। মো. বিল্লাল হোসাইন জনি, এসআই (নিঃ), বিপি-৮৪১৩১৪৮৮৮১, যাত্রাবাড়ী থানা, ডিএমপি, ঢাকা; ২। মো. শাহীনুর চৌধুরী, বিপি-৮৫১৬১৭৮৩৩১, এএসপি, র‌্যাব-১০, ধলপুর, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা এবং ৩। মো. আবুল কালাম আজাদ, বিপি-৬৫৮৮০৫২২৪২, এএসপি, সিপিএসসি, র‌্যাব-১০, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা যাত্রাবাড়ী থানা মামলা নং- ৫১ (০৯)১৮ জিআর নাম্বার-১০০২ তারিখঃ ১১/০৯/২০১৮ইং ধারা- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী/১৩) এর ৫৭(২)/৬৬ (২) মামলায় ডিএমপি যাত্রাবাড়ী থানার অভিযোগপত্র নং- ১৬৩, তারিখ ১৯/০২/২০২২ ইং, ধারাঃ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী/১৩) এর ৫৭(২)/৬৭/৬৬। তে চার্জশীটভূক্ত ১২নং আসামি পলাতক দেখিয়ে আমাকে আসামি বানিয়ে চার্জশিট বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করেন। দুই মামলায় আমি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আগাম জামিন পাই। পরবর্তীতে নিম্ন আদালতে সারেন্ডার করিলে প্রায় ১ মাস আমি জেলে থাকার পর জামিনে বের হই।"

হুমায়ুন কবির আরও বলেন, "পরবর্তীতে মিরপুর মডেল থানা মামলা নং- ১৮ (১১)১৮ জিআর নাম্বার- ৭৬২ তারিখঃ ০৬/১১/২০১৮ইং ধারা- ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ২৫ (১) (ক)/(খ) ৩১ (১)। মামলাটির চার্জশিট দাখিল হলে মামলাটি বদলি হয়ে সাইবার ট্রাইব্যুনালে সাইবার ট্রাইব্যুনাল মামলা নং- ৬১৯/২১ তে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলে গত ১১/০৮/২০২৪ইং তারিখে আমি ট্রাইব্যুনাল হইতে খালাস পাই।"

নির্যাতনে ভয়াবহ শারীরিক সমস্যা:

ভুক্তভোগী এই ব্যবসায়ী কমিশনে দায়ের করা অভিযোগে লেখেন, "যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের হওয়া ১০৭(১০)১৮ নম্বর মামলায় আমি চার্জশিট থেকে অব্যাহতি পাই। কিন্তু যাত্রাবাড়ী থানা মামলা নং- ৫১ (০৯) ১৮ বদলি হয়ে সাইবার ট্রাইব্যুনাল মামলা নং- ৪০৬/২২ এখনও বিচার চলমান। টানা ১১ দিন র‌্যাব-১০ এ বন্দি ও গুম থাকাবস্থায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক আইজিপি মো. শহিদুল হক, সাবেক র‍্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও অন্যান্য র‌্যাব এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে আমার ওপর নির্মম শারীরিক নির্যাতন নিপীড়ন করার ফলে আমার বিভিন্ন রকমের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হয়েছে। আমি জেল থেকে জামিনে বের হয়ে সিআরপি মিরপুর হাসপাতালে তিন মাস চিকিৎসা সেবা নিই। চোখের দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে এবং এখনো সব সময় চোখ থেকে পানি পড়ে। কানে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়ায় কানে কম শুনি। গোপনাঙ্গে ইলেক্ট্রিক শক দেওয়ায় এখনো প্রস্রাবের সময় যন্ত্রণা হয়। তলপেটে লাথি দেওয়ায় নানাবিধ সমস্যায় ভুগছি। একবার অপারেশন করতে হয়েছে। এখনো তলপেটে ব্যথা আছে। আমার দুই হাঁটু, পায়ের গোড়ালি এবং কাঁধে বেধড়ক লাঠি পেটা করায় এখনো ব্যথায় আমি স্বাভাবিক ভাবে চলাচল করতে পারি না। মেরুদণ্ডের আঘাত করায় আমি এখনো ঘুমাতে পারি না, সোজা হয়ে বসতে পারি না। "

অভিযোগে তিনি আরও লেখেন, "যেহেতু আমাকে স্টিমার থেকে নামিয়ে নিয়ে গুম করেছিল তাই কোথায় কীভাবে নিরুদ্দেশ হয়েছি তা আত্মীয় স্বজন কেউ জানতো না। আমার ছেলে আমার নিখোঁজের পর ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর শের-ই-বাংলা নগর থানায় সাধারণ ডায়েরি করে। শের-ই-বাংলা নগর থানা জিডি নং- ১৯৮২ তারিখঃ ২৮/১০/২০১৮ ইং। গুমের পর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে এনিয়ে সংবাদ প্রকাশের কথাও জানান তিনি। 


হুমায়ুন কবির বাংলা আউটলুককে বলেন, "আমার খোঁজ জানতে আমার স্ত্রী তৎকালীন পুলিশের আইজিপি, র‌্যাবের ডিজি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বার বার দেখা করতে চাইলে তারা কোনো প্রকার সহযোগিতা করেনি বরং দুর্ব্যবহার করেছিলেন। আমি ন্যায়বিচার চাই। আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুম করে অন্যায়ভাবে নির্যাতন-নিপীড়নকারী ও হুকুম দাতাদের যথাযথ বিচার প্রার্থনা করছি।

অভিযোগ শুনে গুম কমিশন যা বলেছে:

হুমায়ুন কবির বলেন, "আমি গুম কমিশনে অভিযোগ এবং সাক্ষাৎকার দিয়ে এসেছি ২২/৯/২৪ তারিখ। আমার এভিডেন্স দেখে কমিশন চেয়ারম্যান বিচারপতি মাঈনুল ইসলাম চৌধুরী এবং কমিশনার ডক্টর নাবিলা ইদ্রিস আমাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে অভিযোগ জানাতে অ্যাডভাইস করেছেন।"

তিনি আরও বলেন, গুম কমিশনে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করার পর কমিশন কর্মকর্তারা বিস্তারিত ডকুমেন্টস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কয়েকদিন পর আমার সাক্ষাৎ নেওয়ার জন্য ফোন এবং ইমেইলে দিন তারিখ সময় নির্ধারণ করে দেন। নির্ধারণ দিনে কমিশন সদস্য ডক্টর নাবিলা ইদ্রিস আমার জবানবন্দি গ্রহণ করেন এবং তা রেকর্ড করেন। তারপর তিনি আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। আমার জবাবের উল্লেখযোগ্য অংশ তিনি নোট করেন। অভিযোগের মেরিটস/গুরুত্ব বিবেচনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে অভিযোগ দিতে অ্যাডভাইস করেন তিনি। সেখানে অভিযোগ গ্রহণ করা হলে তারাই তদন্ত করে মামলা পরিচালনা করবেন। আমার বিরুদ্ধে তিনটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়েছে। সেইসব ডকুমেন্টসসহ অভিযোগ আরও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে অভিযোগ দায়ের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি"

অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন