আজিমপুরে ঢাবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঠিক কী হয়েছিল সেনা সদস্যদের
আজিমপুরের ঘটনার সময় বেশ কয়েকজনকে ফেসবুক লাইভ করতে দেখা যায়। ছবি সংগৃহীত
রাজধানীর আজিমপুরে সেনাবাহিনী ক্যাম্পের সৈনিকদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কিছু সংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থী অসৌজন্যমূলক আচরণ করাসহ মারামারিতে লিপ্ত হয়েছেন। মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে এই ঘটনা ঘটে।
একটি সামরিক সূত্রে জানা যায়, ছাত্রদের এক রিকশাচালককে মারধর করাকে ঘিরে ঘটনার সূত্রপাত। এক ছাত্র পার্শ্ববর্তী ড্রেনে কলার খোসা ছুঁড়ে ফেলেন। এই দেখে এক রিকশাওয়ালা মন্তব্য করেন। তা নিয়ে রিকশাওয়ালার সঙ্গে ওই ছাত্রের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এ সময় আরো ৬-৭ জন ছাত্র এসে রিকশাচালককে বেধড়ক পেটানো শুরু করে। এক পর্যায়ে রিকশাচালক সেনা সদস্যদের সাহায্য প্রার্থনা করেন।
এসময় ক্যাম্প থেকে সার্জেন্ট সেলিমের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর একটি নিয়মিত টহল দল সেখানেউপস্থিত হয়ে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করে। কিন্তু উত্তেজিত ছাত্ররা তাদের কথা না মেনে রিকশাওয়ালাকে জোরপূর্বক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে যেতে উদ্যত হলে টহল নেতা সার্জেন্ট সেলিম রিকশাচালককে তাদের গাড়িতে করে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা সেনাবাহিনীর পিকআপে উঠে হট্টোগোল শুরু করে এবং সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে প্রবেশ করে রিকশাচালককে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।
এমনকি তাৎক্ষণিক আরও ১৫-২০ জন অন্যান্য শিক্ষার্থী এসে পূর্বের ৬-৭ জন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে চরম সহিংসতাপূর্ণ আচরণ ও সৈনিকদের প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য ছুড়তে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ইউনিটের অধিনায়ক ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত হয়ে সেখানে অবিলম্বে সহকারীসহ পুলিশের একজনকে পাঠান বিষয়টিতে মধ্যস্থতা করার জন্য।
একই সময় উক্ত ইউনিটের ক্যাপ্টেন জিদান ও ক্যাপ্টেন সাদম্যান (এমও) সৈনিকসহ সেখানে পৌঁছে ছাত্রদের শান্ত করার চেষ্টা করলে ছাত্ররা সৈনিকদের গালাগালি করেন। শুধু তাই নয় সেখানে ইউনিটের উপ-অধিনায়ক উপস্থিত হলে তার সঙ্গেও মারমুখো আচরণ ও গালাগালি করে। উপ-অধিনায়ক সৈনিকদের সহায়তায় ছাত্রদের গেটের বাইরে বের করে দেন। এই সময় উত্তেজিত হয়ে দুই একজন সৈনিক একজন শিক্ষার্থীকে মারধর করে বলে জানা যায়।
এরপর অধিনায়ক ঘটনাস্থলে এসে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীরা তার সঙ্গেও উগ্র ও অসম্মানজনক আচরণ করে। তারা অধিনায়ককে পদত্যাগ করতে বলাসহ ক্যাপ্টেন জিদানকে তাদের সামনে শাস্তি দেওয়ার দাবি করে এবং সৈনিককে চড় মারতে বলেন।
এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ঘটনাস্থলে এসে বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে তিনি অধিনায়ককে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে বলেন। অধিনায়ক সহকারী প্রক্টরের সঙ্গে পরামর্শ করে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
জানা যায়, অধিনায়ক প্রক্টর, সহকর্মী শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধির (৪ জন শিক্ষার্থী) সঙ্গে বসে বিষয়টি মধ্যস্থতা করেন।
এদিকে বিবিসি বাংলার এক খবরে বলা হয়, আজিমপুরে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে সেনাবাহিনীর লাঠিচার্জে শিক্ষার্থীরা আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে দুজনকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়।
এই বিষয়ে বিবিসি বাংলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, আমার কাছে যে তথ্য আছে, ওখানে রাস্তার পাশে যে ভেন্ডর থাকে, ওদের সাথে শিক্ষার্থীদের কথা কাটাকাটি হয়েছে। সেই সূত্র ধরেই ‘শিক্ষার্থীদের সাথে ওখানের দোকানদারদের সাথে সংঘর্ষ হয়’ এবং তারপর দোকানদাররা ‘বোধহয় আর্মির মোবাইল পেট্রোল টিমকে ডেকে নিয়ে আসে।’
তারপর সেনাবাহিনী দু’পক্ষকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ওদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে। প্রক্টরের ভাষ্য মতে, ‘এটা সৈনিকরা করেছে, অফিসাররা না। ওখানকার লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাহিদকে আমি যখন ইনভলভ করি, তিনি এসে বিষয়টিকে সুন্দরভাবে ম্যানেজ করেছেন…কিন্তু কোনও এক ফাঁকে দুই জন শিক্ষার্থীকে ওরা (সৈনিকরা) ভেতরে নিয়ে যায়।’
যে দু’জনকে তুলে নিয়েছে, তাদেরকে ‘ব্যাপকভাবে মেরেছে’ বলে জানান তিনি। প্রক্টর বলেন, ওই দুইজন ব্যাপকভাবে জখম হয়েছে। এটা অফিসারদের অজ্ঞাতে হয়েছে।
আহত ওই দুই শিক্ষার্থীদেরকে প্রাথমিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিলো। পরে তাদেরকে রাত তিনটার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যের উপস্থিতিতে সিএমএইচে পাঠানো হয়।
সিএমএইচের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহত শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে আপাতত কোনও শঙ্কা নেই।
অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, তবে ওদের বিশ্রাম দরকার এখন। পরবর্তী ছয় ঘণ্টা পর বোঝা যাবে যে অন্য কোনও ট্রিটমেন্ট দরকার কি না। বিশেষ করে তাদের লোয়ার পার্টে…সেখানে জখমের চিহ্ন আছে। এই দু’জন শিক্ষার্থী মুহসিন হলের ছাত্র।
তবে গুরুতর আহতের সংখ্যা দু’জন হলেও সেনাবাহিনীর লাঠিচার্জের কারণে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী।
প্রক্টর জানান, এই ঘটনা সেনাবাহিনী একটি তদন্ত করছে এবং তারা এই ইস্যুটা 'খুব সিরিয়াসলি' দেখবে। তারা যেহেতু কথা দিয়েছেন, তাই আমরা মামলাতে যাইনি।
ঘটনার সময় এবং পরে ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েকজনকে ফেসবুক লাইভ করতে দেখা গেছে। ঘটনার পর একটি লাইভে কয়েকজন ছাত্রকে সেনাসদস্যদের প্রশ্ন করতে দেখা যায়, কেন তারা ছাত্রদেরকে মেরেছেন?
ফেসবুকে অপর এক পোস্টে শিক্ষার্থীদের সাথে সেনা কর্মকর্তাদের একটি ছবি দেখা যায়, যেখানে বলা হয়েছে, ঘটনার জন্য সেনা কর্মকর্তা ক্ষমা চেয়েছেন এবং সেনা সদস্যদের বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।