সাব্বির হত্যায় চাঞ্চল্যকর তথ্য, বসুন্ধরার সানবীরের আঘাতেই নিহত হন সাব্বির
বসুন্ধরা টেলিকমের পরিচালক হুমায়ুন কবীর সাব্বির নিহতের ঘটনায় এবার চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এলো। ছাদ থেকে পড়ে নয়, সাব্বিরকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করেন বসুন্ধরার মালিক আহমেদ আকবর সোবহান ওরফে শাহ আলমের ছেলে সাফিয়াত সোবহান সানবীর। তারপর সানবীর ও তার সহযোগী শামসুদ্দিনের বুদ্ধিতে ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে সাব্বির মারা গেছেন বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।
আর এই চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সানবীরের চাচাতো মামা মো. খায়রুল হাসান উজ্জ্বল। উজ্জ্বলের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছাড়াও তৎকালে তিনি বসুন্ধরা স্টিল কমপ্লেক্সে সেলস অ্যান্ড মার্কেটিংয়ের পরিচালক ছিলেন। এই সংক্রান্ত একটি ভিডিও সম্প্রতি যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, কোনো একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বসুন্ধরা স্টিল কমপ্লেক্সের সেলস অ্যান্ড মার্কেটিংয়ের পরিচালক উজ্জ্বল ঘটনার আদ্যোপান্ত তুলে ধরছেন। উজ্জ্বল নিজেও সাব্বির হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। যদিও ২০০৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত তিনি চাকরিতে ছিলেন।
উজ্জ্বল নিজেকে বসুন্ধরার মালিক শাহ আলমের স্ত্রী আফরোজা বেগম চাতকের আপন চাচাতো ভাই দাবি করেন। আর এই আত্মীয়তার সূত্রেই তিনি বসুন্ধরা গ্রুপের চাকরি করতেন বলে ভিডিওতে বলেন। উজ্জ্বলের বাবার নাম হাবিবুর রহমান। পেশায় তিনি আইনজীবী ছিলেন।
ভিডিওতে উজ্জ্বল স্বীকার করেন, ঘটনাটি ২০০৬ সালের ৪ জুলাই ঘটে। সেদিন উজ্জ্বল, সাফিয়াত সোবহান সানবীর, বসুন্ধরা কনভেশন সেন্টারের ডিজিএম প্রিন্স, সানবীরের এপিএস মানিক ও হুমায়ুন কবির সাব্বির একসঙ্গে ড্রিংস করেন। তখন সানবীরের বসুন্ধরা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহ আলমের বাসায়ই তারা ড্রিংস করেন। পরে সানবীর তার এপিএসকে নিয়ে গাড়িতে করে চলে যান। সাব্বিরের নিজের গাড়ি ছিল না। তাকে উজ্জ্বল নিজের গাড়িতে লিফট দিয়ে তার (সাব্বিরের) বোনের বাসায় দিয়ে আসেন।
ভিডিওতে উজ্জ্বল জানান, সাব্বিরকে তার বোনের বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফেরার পরপরই সানবীর উজ্জ্বলক ফোন করে আবারও আনন্দফূর্তি করার প্রস্তাব দেন। তারপর তিনি গাড়ি নিয়ে তার বাসার কাছে গেলে দেখেন সানবীর গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছেন। এসময় তিনি (উজ্জ্বল) সানবীরের গাড়ির পেছন পেছন যান। এক পর্যায়ে সানবীর সাব্বিরকে তার বোনের বাসা থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গুলশানের ২ এর একটি রেস্ট হাউসে যান। সেখান থেকে দুইজন কল গার্ল (যৌনকর্মী) নেন (এর মধ্যে একজনের নাম রাত্রি)। তারপর সেখান থেকে তারা গুলশান ১ এর একটি পানশালায় গিয়ে বিয়ার ও মদ কেনেন। এরপর সেখান থেকে তারা গুলশানের একটি অ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটে যান।
তিনি আরও জানান, সেখানে গিয়ে তারা গান শুনেন, টিভি দেখেন। ফ্ল্যাটটি সানবীরের। ফ্ল্যাটটি সানবীরের বুলগেরিয়ান স্ত্রীর। পড়াশোনা করতে এসে সানবীরের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে তাকে বিয়ে করেন ওই বুলগেরিয়ান নারী। তবে সানবীরের পরিবার এই বিয়ে মেনে নেয়নি। মেয়েটি বছরের দুইবার ঢাকায় আসতেন। তখন সানবীর সেখানে গিয়ে থাকতেন।
উজ্জ্বল জানান, একসময় দুই মেয়েসহ সবাই টিভি রুমে আসেন। এক পর্যায়ে মেয়ে দুটিকে নিয়ে সানবীর ও সাব্বির পাশের দুই রুমে চলে যান। সেখানে গিয়ে তারা সম্ভবত শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হন। তারপর দুইজন ৭/৮ মিনিটের ব্যবধানে বের হয়ে আসেন। এক মেয়ে ওয়াশরুমে যায়। আরেকজন তখনো তার রুমেই ছিল। এই সময় সাব্বিরের ফোনে একটি ফোন আসে। ফোন রিসিভ করে পরে কথা বলছি বলে ফোনটি তিনি কেটে দেন। এসময় সানবীর সাব্বিরের দিকে একটু রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে বলে, তোমাকে আমি লন্ডনে শেয়ার মার্কেটে নিয়ে গিয়েছি, তুমি আমার অনেক টাকা লস করছো। আমার পারসোনাল গাড়ি ছিল সেই গাড়িটাও তুমি ক্রাশ করছো।
শারমিনের (শারমিন সম্পর্কে বাড়তি কোনো তথ্য দেননি উজ্জ্বল) সঙ্গে তোমার বাজে সম্পর্ক। এগুলো ঠিক না।
এই সময় উজ্জ্বল সাব্বিরকে উদ্দেশ করে বলেন, তুমি যারটা খাও তার সঙ্গে এমনটা করো কেন? এক পর্যায়ে সানবীর উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং সাব্বিরকে উদ্দেশ করে বলেন, গেট আউট ফ্রম মাই হাউস। নতুবা তোমাকে আমি দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধরে বের করে দিব। এই কথা বলার পর সাব্বির দাঁড়িয়ে যায় এবং বলে কি হয়েছে? এ সময় সানবীর সাব্বিরকে ধাক্কা মারে। এতে উপুর হয়ে পড়ে যান সাব্বির। এতে সাব্বির রেগে গিয়ে সানবীরকে মাদারচোদ বলে গালি দেয়। এতে সানবীর পাশে টেবিলে থাকা মদের বোতল দিয়ে সাব্বিরের মাথার পেছনে আঘাত করেন।
স্বীকারোক্তিতে উজ্জ্বল বলেন, এসময় মাথায় আঘাত পেয়ে সাব্বির মা বলে চিৎকার করে উঠেন। এমন সময় ওয়াশরুমে যাওয়া যৌনকর্মী বের হয়ে আসে। তাকে সানবীর তাকেও একটি রুমে পাঠিয়ে দেয়। এ সময় আঘাত করা মদের বোতলটিও পাশের টেবিলে রেখে দেয়।
উজ্জ্বল বলেন, আমি তখন চিৎকার দিয়ে বলি আল্লাহ তুমি কি করলা। দেখি সাব্বির আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সেন্স হারায়ে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে সানবীর ইন্টারকমে দুইজন দারোয়ানকে ডাকেন। সাব্বিরের মাথা থেকে হাতে রক্ত লেগেছিল। তবে খুব বেশি রক্তক্ষরণ হয়নি। দুই দারোয়ান আসলে সানবীর বলে এই তোমরা ধরো তাকে নিচে নিয়ে যাও, আমরা আসতেছি।
উজ্জ্বল বলেন, সানবীর এমন একটা ভাব করে যেন সাব্বিরকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। এ সময় পাশ থেকে চাদরের মতো ছোট কিছু একটা দিয়ে সাব্বিরের মাথায় পেচ দিয়ে তাকে লিফট দিয়ে নামিয়ে গাড়ির কাছে নিয়ে রাখে।
উজ্জ্বল জানান, এসময় দুই যৌনকর্মীসহ সানবীর ও তিনি লিফটে নিচে নামেন। হঠাৎ সানবীর মেয়ে দুটি নিয়ে তড়িগড়ি করে পালিয়ে যায়। উজ্জ্বলকে দারোয়ানরা গাড়ির ব্যাকডোর খুলতে বললে তিনিও খারাপ কিছু আঁচ করতে পেরে তিনিও দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সানবীরের বাসায় চলে যান।
উজ্জ্বল দাবি করেন, সাব্বির বাসার নিচে থাকা অবস্থায়ই মারা যান।
এদিকে, বাসায় গিয়ে দেখেন সানবীর চুপচাপ বসে আছেন। উজ্জ্বল এসময় বলেন, এটা কি হলো। আমি তো ব্যাকডোর খোলার কথা বলায় ভয় পেয়ে চলে এসেছি। তখন সানবীর বলেন, আমি শামসুদ্দিন কাকারে ফোন করেছি। তুমি শামসুদ্দিন কাকার বাসায় যাও, উনাকে নিয়ে তুমি যা করার করো। পরে তিনি শামসুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর তার (শামসুদ্দিনের) বাসায় গিয়ে তাকে নিয়ে গুলশান থানায় যান। গুলশান থানায় গিয়ে পুলিশকে ঘটনা প্রসঙ্গে বলা হয়, সাব্বির ছাদ থেকে পড়ে গেছে। পুলিশ ফোর্স নিয়ে গিয়ে লাশটি ভবনটির সামনে পড়ে থাকতে দেখেন। অর্থাৎ আগে যে জায়গায় লাশটি ছিল সেখান থেকে আগেই সরিয়ে রাখা হয়েছিল। এ সময় শামসুদ্দিন উজ্জ্বলকে বলেন, তোমাকে টায়ার্ড দেখাচ্ছে। তুমি বাসায় চলে যাও। পরে উজ্জ্বল বাসায় চলে যান।
উজ্জ্বলের দাবি, সানবীর ও শামসুদ্দিনের বুদ্ধিতেই সাব্বির ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর নাটকটি সাজানো হয়।
প্রসঙ্গত: ২০০৬ সালের ৪ জুলাই রাতে গুলশানের একটি বাড়িতে খুন হন বসুন্ধরা টেলিকমিউনিকেশসন্স নেটওয়ার্ক লিমিটেডের পরিচালক সাব্বির। এর তিন দিন পর নিহতের ভগ্নিপতি এএফএম আসিফ একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
ঢাকার ৪ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মোতাহার হোসেন ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।
মামলার প্রধান আসামি ছিলেন সানবীর। তিনি ছাড়াও নূরে আলম ও হুমায়ূন কবীর নামে আরো দুই জন পলাতক ছিলেন। বাকি দুই আসামি খায়রুল হাসান উজ্জ্বল ও শামসুদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট মো. আরমান আলী ২০০৮ সালের ১২ মে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেন। এতে বলা হয়, গুলশানের ১০৪ নম্বর সড়কে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন ৩/জি নম্বর বাসার ছাদ থেকে সাব্বিরকে ফেলে দেওয়া হয়।
বিচারক মোতাহার হোসেন রায়ে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ বস্তুনিষ্ঠ, প্রকৃত ও বাস্তব সাক্ষী উপস্থাপনে ব্যর্থ হওয়ায় পাঁচ আসামির সবাইকে বেকসুর খালাস দেওয়া হলো।
রায় ঘোষণার সময় বাদীপক্ষের কাউকে এজলাসে পাওয়া যায়নি। তবে বাদী পক্ষের আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ ও নাসির উদ্দিন চৌধুরী তখন বলেছিলেন, রায় নিয়ে বাদীপক্ষের তেমন আগ্রহ ছিল না বলেই নিহতের আত্মীয়স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন না।
অবশ্য বাদী এ এস এম আসিফ বলেছিলেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।
অন্যদিকে, সাব্বির হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে ২১ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালের ৪ অক্টোবর দুদকের উপ-পরিচালক আবুল কাসেম রাজধানীর রমনা থানায় একটি দুর্নীতির মামলা দায়ের করেন। মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়। ২০০৮ সালের ২৩ এপ্রিল তারেকসহ আট আসামির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।
এরপর ওই বছরের ১৪ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে বিশেষ জজ আদালতে অভিযোগও গঠন করা হয়। এ পর্যায়ে তারেক রহমানসহ চারজন হাইকোর্টে ওই মামলা বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। তারেক ছাড়া অন্যরা হলেন- সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক আবু সুফিয়ান ও ব্যবসায়ী কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল।