Logo
Logo
×

অনুসন্ধান

মনিরুলের শ্যালক পরিচয়েই শাহীন গড়েন সম্পদের পাহাড়

জুলকারনাইন সায়ের

জুলকারনাইন সায়ের

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৪, ০৫:২৯ পিএম

মনিরুলের শ্যালক পরিচয়েই শাহীন গড়েন সম্পদের পাহাড়

শাহীনের ফ্ল্যাট ও বাড়ির চিত্র। ইনসেটে নিচে (বাঁয়ে) শাহীনের বোন-দুলাভাই ও নিচে ডানে শাহীন।

পড়াশুনা এসএসসি পর্যন্ত। তেমন কোনো চাকরি করেন না। কোনো বড় ব্যবসা করেন বলেও এলাকার মানুষ জানেন না। কেউ কেউ জানেন তিনি ঠিকাদারি করেন। তবে সবাই জানেন, তার অনেক ক্ষমতা। কারণ তিনি সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলামের শ্যালক এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানা শিউলির ভাই। 

আর বোন-দুলা ভাইয়ের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়েই তিনি বিপুল সম্পদ ও সম্পত্তি গড়েছেন। নিজের নামে ঢাকায় অন্তত ৭টি ফ্ল্যাট কিনেছেন। স্ত্রীর নামে কিনেছেন বাড়ি। ১৫ বছর আগেও গ্রামে যে টিনের ঘর ছিল সেটিকে এখন বানিয়েছেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি।

শাহীনদের বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি

‘করিৎকর্মা’ এই ব্যক্তির নাম রেজাউল আলম শাহীন। বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বাটিকামারী জোনারংক গ্রামে। বাবার নাম ছাদেক আহম্মেদ। এলাকায় পরিচিত সাদেক মিয়া নামে। শাহীনের ব্যাপারে স্থানীয়দের কাছে জানতে চাইলে কেউই নাম প্রকাশ করে কিছু বলতে রাজি হননি। তবে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাহীন গ্রামের বাড়িতে মাঝে মাঝে যান। বেশিরভাগ সময় গ্রামের বাইরে ঢাকা বা অন্যত্র থাকেন। 

শাহীন তার বোন আর দুলা ভাইয়ের দাপট দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা রোজগার করছেন -এমন খবর এলাকার অনেকেই জানেন। গ্রামের বয়স্ক কয়েকজন পরিচয় গোপন রেখে জানান, দেশ স্বাধীনের পর তাদের সম্পত্তি তেমন একটা ছিল না। গত ১৫ বছরে তাদের সম্পদ ও ক্ষমতায় বড় ধরনের উত্থান হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, ১৫ বছর আগে শাহীনদের টিনের ঘর ছিল। এখন সেটা পাল্টে সুরম্য এক দোতলা ভবনসহ অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। ঢাকায় তাদের নামে-বেনামে নানা রকমের ব্যবসা আছে। তবে প্রকাশ্যে ঠিকাদারী ব্যবসা করেন। তার ঠিকাদারী ব্যবসার নাম এসএস এন্টারপ্রাইজ। এছাড়া তার দায়িত্বে দুটি আন্তর্জাতিক এনজিও রয়েছে। সেগুলো হলো কুয়েত সোসাইটি ফর রিফিল (কেএসআর) এবং শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল। 

শাহীনের বোন ও দুলাভাই। 

সাদেক মিয়ার সন্তানদের মধ্যে ১. সায়লা ফারজানা শিউলি (স্বামী পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, ২. শাহীন ঠিকাদার,  ৩. মলি গৃহবধূ (আমেরিকায় থাকে, স্বামী ওখানে চাকরি করে ), ৪. মামুন একটি ব্যাংকের ম্যানেজার ৫. তুলি (স্বামী গাজীপুরের এসপি কাজী শফিক), ৬. মিতু ব্যাংকার (স্বামী বেকার)।

জানা যায়, সাদেক মিয়ার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। শিউলি বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পর অবস্থা পাল্টাতে শুরু করে। পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে শিউলি বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মূলত তার চাকরির পরই তার এক ভাই ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন। দুই বোনকে ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। শিউলির স্বামী পুলিশের শীর্ষ ও প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের একজন-মনিরুল ইসলাম। তিনি পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি। একই সঙ্গে তিনি পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।

ঠিকারদার শাহীন

বাংলা আউটলুকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, শাহীনের ঠিকাদারী ব্যবসার নাম এসএস এন্টারপ্রাইজ। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়েই আবার কেএসআর-শারজাহ ইন্টারন্যাশনালের সব নির্মাণ কাজ করানো হয়। এ ছাড়া এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি গণপূর্ত অধিদপ্তর (পিডব্লিউডি) থেকেও লাইসেন্স প্রাপ্ত। তাই সেখানকারও তালিকাভুক্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। 

বিভিন্ন স্থানে শাহীনের ফ্ল্যাট ও বাড়ি।

শাহীনের সম্পত্তি

বাংলা আউটলুকের অনুসন্ধানে রেজাউল আলম শাহীনের নামে মিরপুরের রাকিন সিটি ও পুলিশ কনভেনশন সংলগ্ন আড়াই কাঠার একটা বাড়ির খোঁজ পাওয়া যায়। মিরপুর ডিওএইচএস সংলগ্ন ৬ কাঠার প্লট, উত্তরাতে ৬ কাঠার ২টি প্লট, ( এর সঙ্গেই লাগোয়া পাশাপাশি শাহীনের এনজিও কেএসআরের ডিজি গাজী জহিরুল ইসলামেরও ২ টি প্লট আছে)। দুইজনে চারটি প্লট একসঙ্গে নিয়েছেন মহামারী করোনার আগে। ফরিদপুর শহরে শাহীনের ১৫ কাঠা জমি আছে। সাভারের ধউর ব্রিজ পার হয়ে (জিরাবোর দিকে যেতে) ডান দিকে ভেতরের একটা রাস্তা দিয়ে বেশ সামনে কয়েক একর জমি আছে, যার অধিকাংশ দখলকৃত। গাজীপুরে শাহীন ও গাজী জহিরুল আলমের একসাথে ৩/৪  একর জমি থাকার খবরও পাওয়া গেছে। তবে তা পুরোপুরো যাছাই করা সম্ভব হয়নি। 

এছাড়াও মিরপুরের পল্লবীতে একই বিল্ডিংয়ে শাহীনের মোট ৩টি ফ্ল্যাট। প্রতিটি ১৮০০ স্কয়ার ফিটের। ঠিকানা: বাড়ি ১১, রোড-১৮ অ্যাভিনিউ-৫, সেকশন-১১, পল্লবী, মিরপুর। একটি ফ্ল্যাট শাহীনের স্ত্রী তানজিন টুম্পার নামে রেজিস্ট্রেশন। এসব সম্পদের অধিকাংশই মনিরুল ইসলামের বলে গোপন সূত্রে জানা যায়। এছাড়া মিরপুর-১০ বাড়ি-১০, রোড ২২, ব্লক সিতে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। 

দুই এনজিওর মালিকানায় শাহীন

শাহীন ‍দুটি এনজিও চালান। এগুলোতে বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক অনুদানের তথ্যও পাওয়া গেছে। এনজিও দুটি হলো কুয়েত সোসাইটি ফর রিফিল (কেএসআর) যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০৬৫১ এবং শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ০৮২৫। মজার ব্যাপার হলো দুটি এনজিও-ই হাউস-০২, রোড ০৬/এ, সেক্টর-০৪, উত্তরা, ঢাকা : ১২৩০ ঠিকানা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা। সামনে থেকে এনজিও দুটির পরিচালনায় অন্য ব্যক্তিরা থাকলেও সরকারি নথি ও দাপ্তরিক কার্যাবলিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে শাহীনের নামই ব্যবহার করা হয়েছে। 

শাহীনের সম্পদ

এদিকে, কেএসআরের পাওয়া অনুদানের একটি হিসাব বাংলা আউটলুকের হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এনজিওটিতে ৩ কোটি ৯৬ লাখ ৭১ হাজার ৫২৪ মার্কিন ডলার অনুদান আসে। বাংলা টাকায় যা দাঁড়ায় ৪৬৬ কোটি ৩৬ লাখ ৮৯ হাজার ১৪৯ টাকা (১১ আগস্টের মুদ্রা বিনিময় হিসাবে)। তবে এনজিওটির ব্যায়ের সুনির্দিষ্ট হিসাব বাংলা আউটলুক বের করতে পারেনি। যদিও এনজিওটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, দেশের ৮০০ গ্রামে তারা ৫০০ মসজিদ নির্মাণ, ১০০ এতিমখানা, ১০০০ হাজার ওজুখানা নির্মাণ করেছে।  

প্রসঙ্গত: কেএসআর হলো কুয়েতভিত্তিক একটি এনজিও। এটি অনেক পুরোনো একটি এনজিও। যার পূর্ব নাম ছিল রিভাইভাল অব দ্য ইসলামিক হেরিটেজ।  নাইন ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে এনজিওটির বিরুদ্ধে। সেজন্য অনেক দেশে এনজিওটি নিষিদ্ধও। এছাড়া শাহীনের মতো প্রায় অশিক্ষিত লোক কিভাবে কুয়েতের এই এনজিওটির বাংলাদেশ শাখার দায়িত্ব পেলেন তা নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন। তাহলে এর নেপথ্যে কে? সম্পত্তির মালিক হতে যে প্রভাবের ব্যবহার করেছেন, এ ক্ষেত্রেও তাই করেছেন? শুধু কেএসআর নয়, শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনালও কি করে তার হাতে এলো তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

বোনের সঙ্গে শাহীন। 

আরও মজার ব্যাপার হলো কুয়েত সোসাইটি ফর রিলিফ এবং শারজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনাল—দুটি এনজিও সংশ্লিষ্ট যত নির্মাণ কাজ হয় তার দায়িত্বে থাকে শাহীনেরই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এসএস এন্টারপ্রাইজ। 

এসব ব্যাপারে শাহীনের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন