আবু সাঈদ হত্যা মামলায় শিশুসহ গ্রেপ্তার ২৪ জন
পুলিশের কেউ নেই
পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদ। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনার ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হবে—আন্তর্জাতিক মহলে এমন প্রচার প্রচারণাই চালাচ্ছে সরকার। সরকারের এই প্রচার জোরদার করতে কূটনৈতিক তৎপরতাও চলছে সমান তালে। কিন্তু এরই মধ্যে খবর নিয়ে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় হওয়া মামলায় পুলিশ নয়, বরং শিশুসহ ২৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।এর মধ্যে এক কলেজ পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীও রয়েছেন।বয়স অনুযায়ী, যাকে শিশু আদালতে তোলা হচ্ছে। এ মামলার অন্যরা বিভিন্ন বয়সের ছাত্র ও সাধারণ জনগণ। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি সূত্রে এমনটাই জানা গেছে।
গত ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে রংপুরের অবস্থিত বেরোবির এক নম্বর গেটের সামনে প্রকাশ্যে দিনের আলোতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন নিরস্ত্র আবু সাঈদ।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ বিভূতিভূষণ রায় পরের দিন তাজহাট থানায় ৩০০০ লোকের বিরুদ্ধে হত্যা, ভাঙচুর ও বিভিন্ন ধরনের অপরাধের কথা উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন।
পুলিশ এজাহারে আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনায় দাবি করে, বিভিন্ন দিক থেকে বিক্ষোভকারীদের ছোড়া গুলি, পাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে এক শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখা যায়। তখন তার সহপাঠীরা উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ৩:৩৫ মিনিটে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার নাম আবু সাঈদ(২৩)।
এদিকে, আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন। আর উল্টো দিক থেকে পুলিশ শটগান থেকে গুলি ছুঁড়ে। এক পর্যায়ে সাঈদ গুলিবিদ্ধ হয়। পরে অন্য শিক্ষার্থীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তার নিহতের খবরে সারা দেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সংঘর্ষ আরো ছড়িয়ে পড়লে আরো ২১০ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়।
এই ঘটনায় পুলিশের যে ব্যক্তি গুলি চালিয়েছে তাকে গ্রেপ্তার করা না হলেও, এখন পর্যন্ত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, এই ২৪ জনের মধ্যে ছাত্রসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষ রয়েছেন। তাদের একজন মো. আলফি শাহরিয়ার মাহিম। মাহিমের বয়স ১৬ বছর ১০মাস। তিনি রংপুরের পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজে একাদশ (এইচএসসি ২৫) শ্রেণিতে পড়ছেন।
এদিকে মাহিমের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ১৫ জুলাই কলেজে পরীক্ষা দেওয়ার পর অসুস্থ হওয়ায় ওই দিন বিকেল থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত মাহিম রংপুর মেডিকেলে ভর্তি ছিল। ভর্তির কাজগপত্র তারা বাংলা আউটলুককে দেখিয়েছেন। এরপর ১৮ তারিখ তিনি কলেজের উদ্দেশে বের হলে জানতে পারেন পরীক্ষা স্থগিত। তখন বন্ধুদের সঙ্গে মিছেলে যোগ দেয় এবং পুলিশের টিয়ারসেলে বন্ধুদের থেকে আলাদা হয়ে যায়।
পরিবারের থেকে জানায়, পরবর্তীতে ১৮ তারিখ আনুমানিক ৪টায় ওর বন্ধুদের কাছ থেকে তারা জানতে পারেন তার পায়ে রাবার বুলেট লেগেছে এবং স্থানীয়রা তাকে কোনো একটি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন।
রাত ১০টা পর্যন্ত সব হাসপাতাল-ক্লিনিক খুঁজেও যখন পাচ্ছিল না, তখন তার বাবার কাছে মোবাইলে একটা কল আসে। ফোনে অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘আপনার ছেলে আমাদের হেফাজতে আছে, জানাজানি করিয়েন না তাতে ছেলের ক্ষতি হবে, তাকে আগামীকাল সকালে ছেড়ে দেওয়া হবে। চিন্তার কিছু নেই।’
মাহিমের পরিবার দাবি করেছে, পরদিন (১৯ জুলাই) সকালে পরিবারের পক্ষ থেকে খোঁজ নিলে তারা অস্বীকার করে বলে তাদের কাছে এই নামে কেউ নেই। এরপর আনুমানিক বিকেল ৪:৩০টায় কোর্ট থেকে কল আসে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পরিবার কোর্ট থেকে নথিপত্র নিয়ে জানতে পারে তাকে আবু সাঈয়ের হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে।
গত ৩০ জুলাই শিশু কোর্টে তাকে নেওয়া হলে আগামী ৪ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করেন আদালত। তার বিষয়ে শুনানি শিশু আদালতে হবে।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অপরাধ) আবু মারুফ হোসেন দাবি করেন, আবু সাঈদের মৃত্যুর পর দায়েরকৃত মামলায় যে নাশকতা অভিযোগ রয়েছে সে অভিযোগে ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যার অভিযোগে ওকে (মাহিম) এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি, যোগ করেন তিনি।
তিনি জানান, ইতোমধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার সাইফুজ্জামান ফারুকী নেতৃত্বে একটি চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত দল আবু সাঈদের মৃত্যু কিভাবে হয়েছে তা দেখতে কাজ করছে।
মারুফ হোসেন বলেন, ‘পুলিশের গুলিতেই তার মৃত্যু হয়েছে নাকি তার মাথায় আঘাত লেগেছে তা ভিডিও, ছবি ও মেডিকেল রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে নিশ্চিত করা যাবে।
তিনি বলেন, ‘ইতিমধ্যে যার বিরুদ্ধে গুলি করার অভিযোগ এসেছে তাকে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে।আর তার ও তার পরিবারের নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করা থেকে কর্তৃপক্ষ বিরত রয়েছে। আমরা বারবারই বলছি আবু সাঈদের মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক এবং এ ঘটনায় আমরাও মর্মাহত।’
এই গ্রেপ্তারগুলো এমন সময় হলো যখন সরকারের পক্ষ থেকে হাইকোর্টের একজন বিচারপতি নেতৃত্বে ১৬ তারিখে ঘটে যাওয়া ছয়টি মৃত্যুর বিষয়ে বিচার বিভাগীয় গঠন করা হয়েছে।
এদিকে, গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে ঢাকাস্থ জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম টোস্টার তার দেশের পক্ষ থেকে এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ ও পূর্ণাঙ্গ বিচার দাবি করেন।
সরকারের পক্ষ থেকে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ঘোষণা দেওয়া হলেও দোষী পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।