লিডস কর্পোরেশনের পতন
বকেয়া বেতন, আইনি জটিলতা ও সন্দেহজনক অব্যবস্থাপনার কাহিনী
এই বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে সম্প্রতি অবসর নেওয়া ব্যাংকার মিজানুর রহমান বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় সফ্টওয়্যার কোম্পানি লিডস কর্পোরেশনের এক শীর্ষ নির্বাহীর কাছ থেকে ফোন পান। ওই শীর্ষ কর্মকর্তা মিজানুরকে লিডসের নির্বাহী কর্মকর্তা হতে এবং সেই নিয়ে আলোচনা করতে একটি রেস্তোরাঁয় ডাকেন।
দেশের তিনটি ব্যাংকের সাবেক আইটি প্রধান হিসেবে মিজানুর বেশ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং লিডসের কার্যক্রম এবং এর পণ্যের সঙ্গেও পরিচিত ছিলেন।
ফ্লোরাব্যাংক ও লিডস—বাংলাদেশের একমাত্র দুই কোম্পানি যারা গত দুই দশক ধরে দেশের ব্যাংকগুলির জন্য কোর ব্যাংকিং সফ্টওয়্যার (সিবিএস) তৈরি করছে।
সিবিএসকে ভিত্তি করেই ব্যাংকের কার্যক্রম চলে এবং এখানেই সব গ্রাহকের এবং আর্থিক তথ্য কেন্দ্রীভূত করে রাখা হয়। এটি বিভিন্ন ব্যাঙ্কিং পরিষেবা, নিয়ন্ত্রক বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত এবং জেনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে থাকে।
সেই যাইহোক, সিবিএসের নকশা করা এবং বাস্তবায়ন করতে বহুস্তরের একটি জটিল ধরনের কাজ যার করকে বিশেষ প্রোগ্রামিং জ্ঞান, সিস্টেম আর্কিটেকচারের দক্ষতা এবং যথেষ্ট আর্থিক বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। আর এমন একটি সমন্বিত কাজ যা করতে বাংলাদেশের বেশিরভাগ সফ্টওয়্যার কোম্পানিকে বেগ পেতে হয়।
১৯৯২ সালে ইউএস-ভিত্তিক সফ্টওয়্যার জায়ান্ট এনসিআর-এর বাংলাদেশ অফিসের মেশিনারিজ কেনার মধ্য দিয়ে লিডস কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর বাজারে বড় ধরনের আস্থা তৈরি করেছিল এবং ১৯৯৯ সালে সিবিএস বাজারে প্রবেশ করে।
এর আগে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ আবদুল ওয়াহিদ জানিয়েছিলেন, আর্থিক খাতে এনসিআরের সামর্থ্য, বিশেষ করে ৯০-এর দশকে বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্কের এটিএম ব্যবস্থাপনায় তাদের কার্যক্রম লিডসকে ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কে মূল্যবান জ্ঞান দিয়েছে।
এনসিআর গ্রাহকদের সমর্থনের মাধ্যমে অর্জিত এই দক্ষতা তাদের নিজস্ব সিবিএস ডিজাইনের পরবর্তী পদক্ষেপের দিয়ে নিয়ে যায়। এই ব্যাপারে এই প্রতিবেদককে অন্য একটি সংবাদমাধ্যমে ওয়াহিদ বলেছিলেন, স্থানীয়ভাবে তৈরি পণ্য দিয়ে বিদেশি সিবিএসের স্থলাভিষিক্ত করার লক্ষ্য নিয়েই সিবিএস নকশা এবং বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
এদিকে, মিজানুর বাংলা আউটলুকে বলেন, আমি লিডসের পণ্যের সঙ্গে বেশ পরিচিত ছিলাম। আইটি প্রধান হিসেবে, আমার কাজ করা একটি ব্যাংকে তাদের সিবিএস বাস্তবায়নে সাহায্য করেছি। তবে লিডস কর্পোরেশনের সিইও হওয়ার প্রস্তাব আমাকে বিশেষভাবে উৎফুল্ল করেনি।
এর কারণ ছিল লিডস এমন এক ভিন্ন ধরনের আইনি জটিলতায় পড়েছিল যে, এটি কোম্পানির শুধু তহবিলই ক্ষয় করেনি, কোম্পানিটিকে ঋণের মধ্যেও ফেলে দিয়েছে। ফলে কর্মচারীদের মাসের পর মাস বেতন পরিশোধ হয়নি এবং সবমিলিয়ে বেতন ৪০ কোটি টাকা বকেয়া।
যদিও লিডসের এই আর্থিক দুরাবস্থার কথা জনসাধারণ জানতো না। তবে একই ইন্ডাস্ট্রির মানুষ হিসেবে মিজানুর সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি জানতেন যে কোম্পানিটি সমস্যার মধ্যে রয়েছে এবং একটি ‘অদ্ভুত মামলা’ চলছে। এসব সত্ত্বেও কৌতূহলবশত এবং ডুবন্ত জাহাজকে উদ্ধারের আকাঙ্ক্ষায় নিয়ে মিজানুর প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং মার্চের শুরুতে লিডসের নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন।
আইনি জট
চলতি বছরের জানুয়ারির আগ পর্যন্ত লিডস কর্পোরেশনের এই আইনি ঝামেলা লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিল। শুধু তাই নয়, অর্ধেত কারিগরি কর্মীসহ ৩০০ জন কর্মীর কারই এই পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না।
যাইহোক, তারা ২০১৮ সালের শেষের দিকে কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে টের পায়। কারণ সময়মতো বেতন দেওয়ায় পরিচিত লিডস তখন বেতন অনিয়মিত হওয়া শুরু হয়েছিল
লিডস কর্পোরেশনের সাবেক সিওও এসএম সাইফুর রহমান বাংলা আউটলুককে বলেন, ২০১৮ সালে যখন আমাদের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ে তখন আমরা বুঝতে পারি কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। তবে বোর্ড এবং মালিকরা আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন এই সমস্যা অস্থায়ী এবং শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হবে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ফেব্রুয়ারির শুরুতে হঠাৎ করেই লিডসের মূল পণ্য এবং কোর ব্যাংকিং সফ্টওয়্যার (সিবিএস) ব্যাংক আল্টিমাস নিলামে তোলার নির্দেশ দেন ঢাকার যুগ্ম জেলা আদালত-১। খান আকতার আলম নামে এক ব্যক্তিকে লিডস প্রায় ৮৩ কোটি টাকা বকেয়া অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় এই নিলামের আদেশ দিয়েছিলেন আদালত।
সাইফুর বলেন, এটা আমাদের কাছে একটা ধাক্কা ছিল। এর মানে হলো আমরা যে প্রধান পণ্যটি বিক্রি করছি তা আর আমাদের থাকছে না। অর্থাৎ আমাদের আর বিক্রি করার মতো কিছু ছিল না।
লিডসে ২০ বছর চাকরি করেছে সাইফুর। চলতি মাসে লিডস ছেড়েছেন। কোম্পানির কাছ থেকে তার বকেয়া পাওনা ১ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তিনি দুঃখের সঙ্গে জানান, সময় যাচ্ছে আর তিনি দেখছেন এই পাওনা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে।
লিডস কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে খান আকতার আলমের দায়ের করা মামলাটি বেশ চাঞ্চল্যকর।
এই মামলার শিকড় আসলে ১৯৯২ সালে নিয়ে যায়, যখন বাংলাদেশে এনসিআর কর্পোরেশনের চালানো কার্যক্রম থেকে যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে লিডস কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৮০-এর দশকে খান আকতার আলম এনসিআর কর্পোরেশনের একজন কর্মী ছিলেন, যিনি কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী বিক্রয়ের উপর কমিশন পেতেন।
এই বিক্রয় কমিশনের অর্থ না দেওয়ায় খান আক্তার ১৯৮১ সালে ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা চেয়ে এনসিআরের বিরুদ্ধে একটি মামলা ঠুকে দেন। মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে কমিশন হিসেবে তিনি ওই টাকা পান।
১৯৮৬ সালে প্রাথমিকভাবে তার আবেদন আদালতে বাতিল হয়ে যায়। ১৯৮৭ সালে খান আক্তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেন। এদিকে, ১৯৯২ সালে লিডস কর্পোরেশনে স্থাপনের জন্য যন্ত্রপাতি স্থানান্তর করে এনসিআর কর্পোরেশন বাংলাদেশ থেকে চলে যায়।
লিডস কর্পোরেশনের আইনী প্রতিনিধিরা স্পষ্ট করেন যে, লিডস এনসিআর কর্পোরেশনকে অধিগ্রহণ বা এর সঙ্গে একীভূত হয়নি। বরং লিডস চুক্তির করে কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা ছাড়াই এনসিআর থেকে যন্ত্রপাতি কিনেছে।
প্রাথমিকভাবে লিডস কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে খান আক্তার কোনো দাবি করেননি। কিন্তু ১৯৯৯ সালে আদালতে দেওয়া নথিতে তিনি নিজেকে লিডস কর্পোরেশন এবং এনসিআর কর্পোরেশনের জোনাল ম্যানেজার হিসেবে উল্লেখ করেন। আর ২০১০ সালে যুগ্ম জেলা আদালত-১ এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয়।
লিডসের শীর্ষ ব্যবস্থাপনা প্রাথমিকভাবে খান আক্তারের মামলাটি পাত্তা দেননি এবং মনে করতেন এই ব্যাপারে একমাত্র দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান এনসিআর এবং খান আক্তারকে কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য আদালত তাদের দায়বদ্ধ করবে না। যাইহোক, ২০১০ সালে আদালত খান আক্তার হোসেনের বকেয়া মূল্যায়নের জন্য একটি অডিট রিপোর্ট দেওয়ার জন্য লিডসকে নির্দেশ দেয়। পরে এন.এল রায় অ্যান্ড কোং নামে একটি বাইরের অডিট ফার্মকে হিসাব দেওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল।
একই বছরে অডিট শেষ। প্রতিবেদনে বলা হয়, সুদসহ খান আক্তারের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার যা ২০১৮ সালে যখন ঢাকা যুগ্ম জেলা জজ আদালত-১ লিডসকে খান আক্তারকে তার প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেয় তখন টাকার হিসেবে তা ৫৭ কোটি দাঁড়ায়।
বাংলা আউটলুক এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য খান আক্তার আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। তবে এই বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
সাইফুর বাংলা আউটলুককে বলেন, ‘আপনি বুঝতে পেরেছেন ২০১৮ সালে ঢাকার এক আদালত লিডসকে ওই পরিমাণ অর্থ ফেরত দিতে বলেছিল এবং কর্মচারী হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত আমরা এই বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলাম।
ফেব্রুয়ারিতে নিলাম বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতি ডলার ১১৫ টাকা বিনিময় হারে খান আক্তারের বকেয়া ৮৩ কোটি ৬৬ লাখ ৯২১৩৪ টাকায় পৌঁছেছে এবং এই বকেয়া পরিশোধ করতে লিডসের সিবিএস পণ্য ব্যাংক আলটিমাস নিলামে তোলা হবে। ওই নিলাম হয়েছিল এবং দেশের সিবিএস বাজারে লিডসের একমাত্র ব্যবসায়ীক প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্লোরাব্যাংক মাত্র ৫ কোটি টাকায় ব্যাংক আল্টিমাস কিনে নেয়।
কর্মীদের দুর্ভোগ
২০২২ সালে লিডস কর্পোরেশনের চকচকে অফিস খোলার পর থেকে ঢাকার মিরপুরের আইকনিক বিল্ডিং হয়ে উঠে। দুই দশক নানা জায়গা স্থানান্তরের পর সেখানকার ওই বিল্ডিং করে উঠে প্রতিষ্ঠানটি। যে দেশে বেশিরভাগ সফ্টওয়্যার কোম্পানি সঙ্কুচিত আবাসিক ভবন থেকে পরিচালিত হয় সেখানে লিডসের গ্লাস এবং ইস্পাতের ওই বিল্ডিং ব্যতিক্রম কিছু ছিল।
লিডসের কর্মীরা বেশ উদার ক্ষতিপূরণ প্যাকেজও উপভোগ করেছেন। যার ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রযুক্তি শিল্পে অনেকেই ঈর্ষান্বিত এবং নিজেদের আধুনিক কর্মক্ষেত্র নিয়ে কর্মীরা গর্বিতও ছিল।
লিডস কর্পোরেশনের সাবেক একজন সিস্টেম আর্কিটেক্ট ছিলেন আরিফুর আমরান চৌধুরী। কোম্পানির সমৃদ্ধির দিনগুলোকে মনে রেখেছেন। ২০১৪ সালে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় তার দুটি পা-ই ভেঙে যায়। পরে লিডস থেকে চিকিৎসা ব্যয় হিসেবে তিনি তিন লাখ টাকা পান।
স্মৃতিচারণ করে আরিফুর বলেন, লিডসের ফিনান্স এবং অ্যাকাউন্টিং বিভাগে বিল জমা দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আমি পুরো অর্থ পেয়েছি। কোনো ধরনের ঝক্কি এবং বিলম্ব ছাড়াই তা পেয়েছিলাম।
যাইহোক, ২০১৮ সালের পর থেকে পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নিয়েছে। দুঃখ করে আরিফুর বলেন, বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়ে, প্রায়শই তিন থেকে চার মাস দেরি হয়। আমরা বেতন দিয়ে চলি। নিয়মিত বেতন ছাড়া চলা আমাদের জন্য ক্রমশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছিল।
২০২৩ সালের শুরুর দিকে আরিফুর লিডস ছেড়ে অন্য একটি আইটি ফার্মে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, এখন লিডস থেকে আমার বকেয়া পাওনা ১৭ লাখ টাকার বেশি। সেই টাকা পুনরুদ্ধারের খুব একটা আশা আমি দেখছি না। বিশেষ করে ব্যাংক আল্টিমাস আর যখন লিডসের সঙ্গে নেই।
অন্য অনেক লিডস কর্মীর মতো আরিফুরকে যা বিভ্রান্ত করেছিল তা হলো, কোম্পানিটির আইনি সমস্যা সম্পর্কে তাদের সচেতনতার অভাব।
তিনি বলেন, পেছন ফিরে তাকালে এখন সবকিছুই পরিষ্কার মনে হয়। বেতন সমস্যার পাশাপাশি কাকতালীয়ভাবে ২০১৮ সালেই আইনগত সমস্যাও শুরু হয়েছিল। যখনই আমরা অনিয়মিত বেতনের বিষয়ে অফিসকে প্রশ্ন করি, তারা প্রায় সবসময় ব্যাংক ঋণের কথা উল্লেখ করে যেগুলি পরিশোধের প্রয়োজন এবং শিগগরিই বেতন নিয়মিত করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এমনকি সাইফুরের মতো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও এসব আইনি ঝামেলা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। লিডসে দুই দশকের দীর্ঘ যাত্রায় তিনি ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ২০১৮ সালে, যখন লিডসের আইনি ঝামেলা বাড়তে শুরু করেছিল তখন তিনি চিফ মার্কেটিং অফিসার (সিএমও) ছিলেন।
সাইফুর বলেন, লিডসের কর্মীদের মাসিক বেতন ছিল প্রায় ২ কোটি টাকা। আর আমাদের সিবিএস ব্যবহার করা বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা নিয়মিত ৬-৭ কোটি টাকা পেতাম। সুতরাং, অংক খুব সহজ ছিল এবং আমরা সবসময় লাভে ছিলাম।
কিন্তু যখনই আমরা কর্মচারীদের পাওনা সম্পর্কে অর্থ বিভাগকে জিজ্ঞাসা করেছি তারা উত্তর দিয়েছে মালিকরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য তহবিলের একটি বড় অংশ সরিয়ে নিচ্ছে। যদিও তারা বলত সমস্যাটি অস্থায়ী এবং শিগগিরই এর সমাধান হবে— যোগ করেন সাইফুর।
লিডস কর্পোরেশনের সাবেক সহকারী মহাব্যবস্থাপক আবদুল্লাহ আল মামুন মনে করেন লিডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে শেখ আব্দুল ওয়াহিদের যোগদানের পর থেকেই কোম্পানির সমস্যা শুরু হয়।
ঢাকা কলেজ থেকে ব্যবসায় ব্যবস্থাপনায় স্নাতক করা শেখ ওয়াহিদ এনসিআর কর্পোরেশনের যুক্তরাষ্ট্রের হেড অফিসে যোগদান করেন। পরে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অবশেষে ২০১৫ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন এবং লিডস কর্পোরেশনে যোগ দেন। যে কোম্পানিটি ১৯৯২ সালে তার বড় ভাই শেখ আব্দুল আজিজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। লিডস কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার আগে শেখ আজিজের ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশে (বিএটিবি) ন্যাশনাল বিক্রয় ব্যবস্থাপক হিসেবে সফল কর্মজীবন এবং পোশাক শিল্পেও অভিজ্ঞতা ছিল।
সাবেক এজিএম আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আজিজের (সাহেব) বাংলাদেশে শিকড় ছিল, কিন্তু তার ভাই শেখ ওয়াহিদের তা ছিল না। ওয়াহিদ তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে কাজ করেছেন। তার পরিবারের সদস্যরাও বিদেশে থাকেন। আমরা কর্মচারীরা বুঝতে শুরু করি কোম্পানির সঙ্গে ওয়াহিদের (সাহেব) কিছুটা যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতা রয়েছে।
২০২২ সালের শেষ দিকে আবদুল্লাহও লিডস ছেড়ে অন্য একটি আইটি ফার্মে যোগ দেন। তিনিও লিডসের কাছে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা পান এবং তিনি মনে করেন কোম্পানি কখনই আর এই টাকা ‘পরিশোধ করতে পারবে না।’
ডুবন্ত জাহাজ
মার্চে যখন মিজানুর দায়িত্ব নেন তখন তার প্রধান অগ্রাধিকার ছিল প্রায় ৪০ কোটি টাকা বেতন না কর্মচারীদের বকেয়ার সমাধান করা এবং খান আক্তারের সঙ্গে আইনি জটিলতাগুলি সমাধান করা। তিনি আবিষ্কার করেন ফেব্রুয়ারির পর থেকেই লিডস কর্পোরেশনের সমস্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ রয়েছে এবং আর লিডসের সিবিএস পরিষেবার জন্য আদালত-নিযুক্ত গ্রহিতাকে অর্থ দিতে নির্দেশ দেওয়া আছে।
তা সত্ত্বেও মিজানুরের আর্থিক রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার আগেও পরিষেবা দিয়ে লিডস সাধারণত প্রতি মাসে ৪-৫ কোটি টাকা পেত। অথচ কর্মচারীদের বেতন ছিল মাত্র দেড় কোটি টাকা। এতে বুঝা যায় যে, বকেয়া পরিশোধের জন্য লিডসের কাছে পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে কিন্তু তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলা আউটলুককে মিজানুর বলেন, এটা খুবই বিস্ময়কর। রেকর্ড দেখাচ্ছে লিডসের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ ছিল, কিন্তু টাকা চলে গেছে। মনে হচ্ছিল টাকা অন্য কোথাও, সম্ভবত দেশের বাইরে স্থানান্তর করা হয়েছে।
লিডস কর্পোরেশনের কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধের ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে বাংলা আউটলুক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত শেখ ওয়াহিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওয়াহিদ সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। অস্পষ্টভাবে বলেছেন, বকেয়া ‘খুব শিগগিরই’ পরিশোধ করা হবে।
কোম্পানিকে কার্যকরভাবে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ওয়াহিদ গত সপ্তাহে লিডস কর্মীদের এক ই-মেইলে সিইও মিজানুরকে অপসারণের ঘোষণা দেন এবং সব কর্মীদের কাজে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
মিজানুর বলেন, ওই ই-মেইল অযৌক্তিক ছিল। আমি গত মাসে অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম লিডসের আর্থিক এবং আইনি সমস্যাগুলি এর মালিকরাই তৈরি করেছে এবং এগুলো সমাধানের ঊর্ধ্বে চলে গেছে।
তিনি আরও বলেন, শূন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে কর্মীদের কাজে ফিরে যেতে বলাটা মালিকদের আরেকটি নিষ্ঠুর পরিহাস।
এদিকে, শেখ ওয়াহিদ বাংলা আউটলুকের কাছে লিডস কর্পোরেশনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্লোরাব্যাংকের কর্পোরেট গুপ্তচরবৃত্তির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে ফ্লোরব্যাংক ১০টি ব্যাংককে সিবিএস সেবা দিচ্ছে। যেখানে লিডস তার ব্যাংক আল্টিমাস সফ্টওয়্যার দিয়ে ১৩টি ব্যাংককে পরিষেবা দেয়।
৮০ বছর বয়সী ওয়াহিদ তার ভাইয়ের সঙ্গে আছেন এবং বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করছেন। তিনি অভিযোগ করেন, অতীতে সংশ্লিষ্ট নয় এমন এক মামলার মাধ্যমে তাদের দুর্বলতাকে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি দাবি করেন, ফ্লোরাব্যাংবক তাদের কোর ব্যাঙ্কিং সফ্টওয়্যার পরিষেবাগুলি পেতে অযাচিত চাপ প্রয়োগ করছে এবং নিলাম প্রক্রিয়ায় কারসাজি করছে।
‘ডিউক’ নামে পরিচিত মোস্তফা রফিকুল ইসলাম হলেন ফ্লোরব্যাংকের ক্যারিশম্যাটিক মালিক। তিনি আমেরিকার পারডু ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স স্নাতক করেছেন। দেশের কয়েকজন আইটি উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনি একজন, যিনি আসলে বোঝেন এই শিল্পের আগাপাশতলার কোথায় কি ঘটছে।
ওয়াহিদের কর্পোরেট গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ডিউক বলেন, ফ্লোরাব্যাংক আদালতের নির্দেশিত নিলামের মাধ্যমে আইনত ব্যাংক আল্টিমাস সফ্টওয়্যারটি অধিগ্রহণ করেছে। তিনি জোর দেন, তারা মেধা সম্পত্তি অধিকার অধিগ্রহণে আইন অনুসরণ করেছেন এবং ভুল কিছু করেননি।
ডিউক ব্যাখ্যা করেন, লিডস মালিকরা তাদের কোম্পানিকে সেই দুর্দশায় ফেলতে যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছিল সে সম্পর্কে আমি অবগত নই। তা এমন কিছু না যা নিয়ে আমি ভাবি। আমার প্রতিযোগীর মূল পণ্যটি অধিগ্রহণের সুযোগ ছিল এবং আমি তা গ্রহণ করেছি। এটি কর্পোরেট বিশ্ব মোটামুটি খুব সাধারণ ঘটনা, বিশেষ করে প্রযুক্তি শিল্পে।
এদিকে, ব্যাংক আল্টিমাস সফ্টওয়্যার ব্যবহারকারীদের উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। ব্যাংকগুলির জন্য সিবিএস একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা এবং ব্যাংকগুলোর নির্বিঘ্ন দৈনন্দিন কার্যক্রম সিবিএসের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। লিডস বা ফ্লোরব্যাংকের মতো সেবাপ্রদানকারীরা চলমান সফ্টওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অপরিহার্য।
লিডসের অধিকাংশ টেকনিক্যাল কর্মী কোম্পানিটি ছেড়ে চলে যাওয়ায় ক্লায়েন্ট ব্যাংকগুলি অদূর ভবিষ্যতে সমস্যার সম্মুখীন হবে বলে বড় ধরনের উদ্বেগ রয়েছে।
ব্যাংক আল্টিমাস ব্যবহার করে উত্তরা ব্যাংক। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম লিডস কর্পোরেশন সংকটের সম্ভাব্য দেশব্যাপী প্রভাব তুলে ধরেন। তিনি সতর্ক করেন, সফ্টওয়্যার পরিষেবাগুলোয় হঠাৎ কোনো ব্যাঘাত ঘটলে ব্যাংকিং কার্যক্রমে বড় ধরনের সমস্যা হবে।
তিনি বলেন, সফ্টওয়্যার সরবরাহকারী পরিবর্তন সহজ বা দ্রুত কোনো সমাধান নয়। এর পরিণাম কোম্পানিকে ছাড়িয়ে জাতীয় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে এবং দেশীয় সফ্টওয়্যার শিল্পের সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাহ উল হক আশ্বস্ত করেছেন, এই ধরনের সফ্টওয়্যার-সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যাংকগুলিকে সহায়তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইসিটি নির্দেশিকা রয়েছে।
তিনি বলেন, সফ্টওয়্যার কোম্পানিতে আইটি কর্মী কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলির দৈনন্দিন কার্যক্রমে উপর ‘তাৎক্ষণিক প্রভাব’ ফেলবে না। তবে এটি ‘নতুন পণ্য চালু করতে বা সফ্টওয়্যার হালনাগাদে বিলম্ব হতে পারে।
এদিকে, ফ্লোরাব্যাংকের ডিউক অবশ্য বলেছন, তারা যেহেতু ব্যাংক আল্টিমাস অধিগ্রহণ করেছেন, তাই তারা এর জন্য কর্মী নেবেন এবং ম্যানুয়াল তৈরি করবে। তিনি বলেন, আমরা ব্যাংক আল্টিমাস ব্যবহার করে ব্যাংকগুলিকে আমাদের সফ্টওয়্যারে চলে আসার আহ্বানও জানাতে পারি।