লাঠি গুলি হুমকিধামকি
বিজেপি যেভাবে উত্তর প্রদেশে জিতেছে
আইয়ুশ তিওয়ারি
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪, ০৯:১২ এএম
নাগলা ভাগ্গু গ্রামের মানুষ ভোটার স্লিপ হাতে দাঁড়িয়ে। তারা কেউ এবার ভারতের সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। ছবি: আয়ুশ তিওয়ারি
ভারতের উত্তর প্রদেশে ফারুখাবাদ আসনে ভোট হয় গত ১৩ মে। তখন সমাজবাদী পার্টি অভিযোগ করে, খিরি-পামরান গ্রামে জাল ভোট দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন কর্মকর্তারা অভিযোগ খারিজ করে দেন। কিন্তু ছয় দিন পর একটি ভিডিও প্রকাশ হয়, যেখানে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় জনতা পার্টির একজন কর্মীর ছেলে আটটি ভোট দিচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করেছে এবং প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা সেই কেন্দ্রে পুনরায় ভোটগ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু নির্বাচনী কারচুপির এটাই একমাত্র উদাহরণ নয়, যা সমাজবাদী পার্টি অভিযোগ করেছিল এবং নির্বাচন কর্মকর্তারা উপেক্ষা করেছিলেন।
নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর এসব অভিযোগ নতুন তাৎপর্য অর্জন করেছে। বিজেপি রেজরের মতো ব্যবধানে ফারুখাবাদ জিতেছে। যে আসনে ১০ লাখের বেশি ভোট পড়েছে সেখানে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান মাত্র ২ হাজার ৬৭৮ ভোট।
অভিযোগগুলি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হলে ভোটে ফল কি অন্যরকম হত—এই প্রশ্ন এখন খুবই জোরালো এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
ভোট গ্রহণের তিন সপ্তাহ পর অনেক ভোটার এখনও স্পষ্টভাবে স্মরণ করছেন কিভাবে বিজেপি-কর্মীরা তাদের ভয় দেখিয়েছিল এবং ভোট দেওয়া থেকে বিরত করেছিল, ভোটকেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বা ভোট দেওয়ার পর তাদের মারধর করা হয়েছিল।
পর্সুপুর গ্রামের ৪০ বছর বয়সী কৃষক অশোক যাদব মঙ্গদপুর গ্রামের ঠাকুরদের হাতে নির্যাতনের কথা স্মরণ করেন, যেখানে ছিল ওই ভোটকেন্দ্রটি। কৃষক অশোক নির্যাতনকারীদের একজনকে বিজেপি নেতার সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অশোক বলেন, ‘তারা (নির্যাতনকারীরা) বলেছে, আমরা আপনাকে (অশোককে) ভোট দিতে দেব না। আপনি যদি বাড়াবাড়ি করতে চান তবে আপনি গ্রামে প্রবেশ করতে পারবেন না।’ যাদবকে প্রচণ্ড মার দেওয়া হয়। তিন সপ্তাহ পরও তাকে হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে। তার পাঁজরে হামলার কালো চিহ্ন রয়েছে।
৫০০ ভোটারের গ্রাম
নাগলা ভাগগু ইটা জেলার আলিগঞ্জ ব্লকে পড়ে। এর প্রায় ১ হাজার বাসিন্দা রয়েছে, যাদের অধিকাংশই শাক্য, যারা আলু ও ভুট্টা চাষ করে। ব্লকটি একটি কাঁচা রাস্তা দিয়ে নিকটতম মহাসড়কের সাথে সংযুক্ত।
গ্রামে নিবন্ধিত ভোটার রয়েছেন প্রায় ৫০০। তাদের একজনও ১৩ মে ভোট দিতে পারেননি। বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী ভারতের গণমাধ্যমের কাছে এই অভিযোগ করেছেন।
বছরের পর বছর ধরে গ্রামের বাসিন্দারা কাদারাগঞ্জের পার্শ্ববর্তী গ্রামের একটি কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন, যেখানে অনগ্রসর শ্রেণি হিসাবে তালিকাভুক্ত রয়েছে লোধি গোষ্ঠী। ২০১৪ সাল থেকে ফারুখাবাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন বিজেপির মুকেশ রাজপুত, বর্ণ অনুসারে লোধি।
পোলিং এজন্টদের নিয়ে যা হয়েছিল
ভোটের দিন সকাল সাড়ে ৫টার দিকে নাগলা ভাগ্গু গ্রামের বাসিন্দা রঘুবীর সিং, কৃষ্ণ মুরারি, রমেশ ও তাদের ছয় বন্ধু কাদারাগঞ্জ ভোটকেন্দ্রে পৌঁছান।
মুরারি ও রমেশ কাদারাগঞ্জ ভোটকেন্দ্রে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট ছিলেন। কিন্তু তাদের কাজ করতে দেওয়া হয়নি। রঘুবীর সিং বলেন, ‘বিজেপিকর্মী ধীরেন্দ্র রাজপুত আমাদের কাছ থেকে ফর্মগুলি ছিনিয়ে নিয়েছিলেন এবং আমাদের হারিয়ে যেতে বলেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেদের ভোট দিতে চেয়েছিলাম এবং আমাদের গ্রামের ভোটও নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। কাদারাগঞ্জের রাজপুতরা আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে।’
কাদারাগঞ্জে বিজেপির বুথ কমিটির সদস্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বটে।
ভোটের দিন সকাল ৮টা ৩৩ মিনিটে সমাজবাদী পার্টি টুইট করে যে, ‘কাদারাগঞ্জের প্রিসাইডিং অফিসার তার পোলিং এজেন্টের নিবন্ধনের অনুমতি করছেন না। ভারতের নির্বাচন কমিশনের উচিত এটি বিবেচনা করা এবং সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করা।’
সকাল ৯টার দিকে নাগলা ভাগ্গুর গ্রামপ্রধান রাজবীর সিং কাদারাগঞ্জ ভোটকেন্দ্রের বিষয়গুলি নিজের হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তা হয়নি। রাজবীর সিং বলেন, “ধীরেন্দ্র রাজপুত ও তার লোকেরা আমাকে বলেছিল, ‘আপনি যদি আমাদের দিকে তাকান আমরা আপনার চোখ উপড়ে ফেলব। আপনি যদি আপনার হাত ব্যবহার করেন, আমরা ওই হাত কেটে ফেলব।’ আমি তাদের বলেছিলাম, ‘আমরা লড়াই করার জন্য আসি নাই। আমরা শুধু ভোট দিতে চাই।’
কিন্তু হুমকি থামেনি। ভয় পেয়ে রাজবীর ভোট না দিয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি বলেন, ‘আমি ফেরার পথে ভুট্টাক্ষেত থেকে ছুরি ও লাঠি হাতে লোকজন বেরিয়ে এসেছিল। এটা ভীতিকর ছিল। আমি গ্রামে ফিরে আসি। আমি গ্রামের লোকজনকে বলি, এমন পরিস্থিতির মধ্যে আমরা ভোট দিতে যেতে পারব না।’
তবে বিজেপিকর্মী রাজপুত দাবি করেছেন, ‘এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ। এর কোনো প্রমাণ নেই।’
পুলিশের কৌশল
সকাল টায় সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী ড. নবল কিশোর শাক্য (ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ) ওই গ্রামে যান। তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। শাক্য ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। এরপর শতাধিক লোক জড়ো হয়ে কাদারাগঞ্জে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু পথে নয়াগাঁও থানার পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের বাধা দেন। একটি ভিডিওতে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আপনারা জোড়ায় জোড়ায় ভোটকেন্দ্রে যান। সবাই একসাথে যাওয়া যাবে না।’ কিন্তু এক-দুইজন গেলেই বিজেপির হাতে মার খেতে হবে।
সমস্ত বিকল্প চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে নাগলা ভাগ্গুর ভোটাররা হাল ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। রঘুবীর সিং বলেন, ‘যদি আমরা জোড়ায় জোড়ায় যেতাম তাহলে আমাদের হত্যা করা হতো। আমরা পুলিশের নিরাপত্তা চেয়েছিলাম, কিন্তু পুলিশ তা অস্বীকার করেন। কেউ ভোট দেয়নি। আমরা আজ ব্রিটিশ রাজের চেয়েও বেশি অত্যাচারের সম্মুখীন।’
ওই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে নয়াগাঁও থানার স্টেশন হাউস অফিসার রিতেশ ঠাকুর। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করেছে। আমরা শত শত ভোটরকে মিছিল করার অনুমতি দিইনি। কারণ এটা সহিংসতার দিকে যেতে পারে।’
রিতেশ ঠাকুর বলছেন, তিনি ভোটারদের জোড়ায় জোড়ায় ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দেননি। ‘আমি বলেছিলাম যে তাদের মধ্যে ৫-১০ জন একসাথে যেতে পারে।’ সম্পাদিত ভিডিওতে সেই অংশটি দেখা যায়নি।
নাগলা ভাগগু এলাকায় লোধিরা প্রভাবশালী, শাক্যরা সংখ্যালঘু। প্রশাসন লোধিদের পক্ষে রয়েছে বলে শাক্যদের অভিযোগ।
বিজেপি রাজনীতিবিদ মুকেশ রাজপুত ২০১৪ সাল থেকে ফারুখাবাদ আসনের সংসদ সদস্য। ২০২৪ সালেও তিনি জিতেছেন। ২০১৯ সালে তিনি জিতেছিলেন দুই লাখ ভোঠের ব্যবধানে। এবার সেই ব্যবধান নেমেছে দুই হাজার ৬৭৮ ভোটে। এই ব্যবধানকে রেজরের সঙ্গে তুলনা করেছেন দেশটির কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী।
(স্ক্রল ডট ইন থেকে অনুবাদ)
* আইয়ুশ তিওয়ারি ভারতীয় সাংবাদিক