দ্য ডিপ্লোম্যাটকে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে যা বললেন মাহফুজ আলম
মাহফুজ আলম। ছবি: সংগৃহীত
২৭ বছর বয়সী মাহফুজ আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। বাংলাদেশে হাসিনা শাসনের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক আন্দোলনের পেছনের মূল কারিগরদের একজন তিনি। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের সাইড লাইনে অনুষ্ঠিত ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অনুষ্ঠানে কথা বলতে গিয়ে মাহফুজকে জুলাই আন্দোলনের নেপথ্যের মূল কারিগর বলে উল্লেখ করেছেন।
মাহফুজ আলম ২০২১ সাল থেকে আন্দোলন পরিচালনাকারী ছাত্রনেতাদের সহযোগী রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি তরুণ বুদ্ধিজীবীদের আকৃষ্ট করতে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক স্টাডি সার্কেল পরিচালনা করেন। এছাড়া তিনি সিনে ম্যাগাজিন ‘পূর্বপক্ষ’ সম্পাদনা করেন। বর্তমানে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া তিনি অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিটির সদস্যও।
সম্প্রতি দ্য ডিপ্লোম্যাটকে একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, পররাষ্ট্রনীতিসহ সমসাময়িক আলোচিত-সমালোচিত নানান ইস্যুতে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নয়া দিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের রিসার্চ স্কলার শাহাদাত হোসাইন। বাংলা আউটলুক পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির ভাষান্তর করে দেওয়া হলো।
আগেও বাংলাদেশে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন হয়েছে এবং সেই আন্দোলনের ব্যানারে ‘কোটা সংস্কার’ শব্দ যুগল বা টার্মটি ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু আপনি নতুন ব্যানার তৈরি করেন যেখানে লিখা ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন ওই নামে শুরু হয়েছিল, শুরু থেকেই কি বড় কোনো পরিকল্পনা ছিল?
মাহফুজ আলম : আমাদের ব্যানারে দেশের সংকটকে বড় মাত্রায় তুলে ধরার লক্ষ্য ছিল। কোটাবিরোধী আন্দোলনতো ইতোমধ্যে চলছিল। আমাদের মনে হয়েছিল এর সঙ্গে আরও বড় ইস্যু যোগ করার সুযোগ আছে। আমরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারের আওতায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সব নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। এই নামটি একটি ইউনিক নাম হিসেবে কাজ করেছে। ওই সময় আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধেও কথা বলেছি। নাগরিকে সমস্যাগুলোতে আমাদের নজর দেওয়ার বিষয়টিতে জোর দিতেই এই নাম বাছাই করা হয়।
আপনি বলেছেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা ১৯৭১-এর ব্যাপারে পূর্বানুমান করতে পারেনি এবং ২০১৪ সালের ব্যাপারেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। তাহলে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কোন পথে আছেন? কেন তারা এতো বড় আন্দোলনে অংশগ্রহণে সক্ষম হয়নি?
মাহফুজ আলম : এ বিষয়ে বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়নি। মিশেল ফুকো, দেরিদা, ইকবাল আহমেদ বা ভারতের জনগণের জন্য কাজ করা বুদ্ধিজীবীরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তালিকাভুক্ত। সেখানে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের দৌড় বড়জোর সাংবাদিক, বাংলা সাহিত্য বা ইংরেজি সাহিত্যে পাণ্ডিত্য জাহির পর্যন্ত। বাংলাদেশে অসংখ্য সংকট রয়েছে, তবুও জনসাধারণের জন্য বুদ্ধিবৃত্তি ও গবেষণার অর্থপূর্ণ বিকাশ হয়নি। ছোট পরিসরে যেটুকুই হয়েছে তা ব্যক্তিগত উদ্যোগে হয়েছে, তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সহায়তা নেই। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উচ্চ-মধ্যবিত্ত, শহুরে কোলাহলে থাকার প্রবণতা আছে, সাধারণ জনগণের ভাষা, চিন্তাভাবনা এবং জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। তারা প্রকৃতপক্ষে জনগণের মতামত নেয় না। বরং তার পরিবর্তে তারা তাদের ধারণা এবং মতাদর্শকে ‘উপর থেকে নিচে’ দৃষ্টিকোণ থেকে চাপিয়ে দিয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে, সমাজের মধ্যে আদর্শিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলি ধরতে বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থ করে তোলে।
আগের জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় আটকে থাকার ফলে এই বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই জনগণ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছেন। রাষ্ট্র যখন জনগণের উপর নিপীড়ন চালায় এসব বুদ্ধিজীবীর বেশিরভাগই হয় নীরবে সমর্থন দিয়েছেন বা উৎসাহ দিয়েছেন। কখনও কখনও সত্যিকার অর্থে জনগণকে বোঝার চেষ্টা না করেই তাদের বিভিন্ন তকমা দিয়েছেন। এই সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিভাজন বুদ্ধিজীবী ও জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই বিচ্ছিন্নতার কারণে বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের বিষয়টি আঁচ করতে পারেনি।
আপনি দায়িত্ব এবং সহানুভূতির রাজনীতির পক্ষে কথা বলেন। এর মানে কি, একটু ব্যাখ্যা করবেন?
মাহফুজ আলম : বাংলাদেশের রাজনীতি গত ১৫ বছর ধরে নিপীড়নমূলক, যার ফলে মানুষ অধিকার বঞ্চিত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ধারাবাহিকভাবে তাদের অধিকার দাবি করে গেছে। যদিও আমি বিশ্বাস করি অধিকার দায়িত্বের সঙ্গে আসে। আমাদের এককভাবে অধিকারভিত্তিক রাজনীতি থেকে দায়িত্বভিত্তিক রাজনীতিতে যেতে হবে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা হলো ফ্যাসিবাদী রাজনীতি থেকে দূরে যাওয়া। সেই আকাঙ্ক্ষা হলো যা জনগণের মধ্যে মতবিরোধ এবং বিভাজন তৈরি করে, তার থেকে বোঝাপড়ার রাজনীতির দিকে যাওয়া।
আমরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে জন্য মর্যাদা, দায়িত্ব এবং সহানুভূতিশীল মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক কাঠামো চাই। এছাড়া আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শকে সমুন্নত রাখব।
আমাদের অবশ্যই মুজিববাদের মতো সংঘাতময় রাজনীতির বাইরে যেতে হবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিকে সঙ্গী করতে হবে। সহানুভূতি ছাড়া মানুষের সঙ্গে সংযোগ করা বা প্রকৃত অন্তর্ভুক্তি অর্জন অসম্ভব। আর এই কারণেই আমরা সহানুভূতি এবং দায়িত্বকেন্দ্রীক রাজনীতির পক্ষে কথা বলি।
আপনি ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘ঢাকা হবে সভ্যতার কেন্দ্রস্থল এবং বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।’ এই যুক্তির ভিত্তি কি একটু বিস্তারিত বলবেন?
মাহফুজ আলম : বাংলা বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল। ঐতিহাসিকভাবে ইসলাম লিখিত ইয়োগার আরবি ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে এখানে এসেছে। এই ভূমি বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদিদের আবাসস্থল এবং সমুদ্র বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। আমরা বাংলাকে সংস্কৃতি ও সভ্যতার মিলনস্থল হিসেবে দেখি, যার কেন্দ্রে ছিল ঢাকা। বিভিন্ন সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস এখানে মিশেছে। মানুষের মধ্যে মতামত, বিশ্বাস এবং ধারণার বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করেছে। এখানে কোনো একক মতাদর্শ আধিপত্য দেখাতে পারেনি। এই ভূমি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মিশ্রণে সমৃদ্ধ। এই ভূমি এমন এক সমৃদ্ধ ভূমি যেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও বৈষ্ণবরা পারস্পরিক বোঝাপড়ায় সহাবস্থান করেছে এবং রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করেছে।
বঙ্গোপসাগরের পরিচয়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গোপসাগরের চারপাশে চট্টগ্রাম, আরাকান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ যেখানে গত ২০০- ৩০০ বছর ধরে সাংস্কৃতিক মিশ্রণ ঘটছে। আমরা চাই বাংলাদেশ এই অতীত উত্তরাধিকারকে ধারণ করুক এবং ধর্ম, সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যময় ধারণার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হোক।
আপনি ’৪৭ (ভারত ভাগ), ’৭১ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ) এবং ’২৪ (জুলাই বিপ্লব) এর চেতনাকে একত্রিত করা উচিত বলে মনে করছেন। কিন্তু প্রতিটি ঘটনার একটি আলাদা ধরনের চেতনা ছিল। এই তিনটি ঘটনাকে কীভাবে একত্রিত করা যায়?
মাহফুজ আলম : আমি বিশ্বাস করি ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ এর মধ্যে একটি কমন চেতনা ছিল যেখানে বাঙালি মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিয়েছিল। ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ উভয় সময়েই তারা নিজেদের সম্মিলিত লক্ষ্যগুলির মূলে থাকা আকাঙ্ক্ষার তাগিদ অনুসরণ করে হিন্দু এবং অন্যদের সাথে মিত্রতা করেছিল। যদিও ১৯৪৭ সালের আন্দোলনটি মুসলিম জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে উদ্ভূত হয়েছিল। এতে পূর্ব পাকিস্তান আন্দোলনে নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭১ সালেও বাঙালি মুসলমানরা তাদের হিন্দু বন্ধুদের পাশাপাশি একই ধরনের উদ্দেশে লড়েছিল। ১৯৪৭ সালে লক্ষ্য ছিল একটি স্বদেশ খোঁজা যেখানে তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে, জমিদারি প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাকে ধর্মের সাথে সংযুক্ত সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি চর্চা করতে পারে।
ওই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা, শরিয়ত প্রতিষ্ঠা করা নয়; পরে কিছু ইসলামী পণ্ডিত এই দিকটিকে অতিরঞ্জিত করে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যকে বিকৃত করে। বরং আমি বিশ্বাস করি পাকিস্তানের আকাঙ্ক্ষা ছিল কেবল ধর্মীয় আচার পালনের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য। ১৯৪৭ সালের আগে এ অঞ্চলে এই ধরনের স্বাধীনতা সীমিত ছিল।
সমগ্র বাংলা কেন পাকিস্তানের সঙ্গে মিশেনি? পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক ও শ্রেণি বিভাজন ছিল, যেটাতে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ইন্ধন যোগান। বাঙালি মুসলমানরা একটি অখণ্ড বাংলাকে সমর্থন করেছিল, যে অবস্থানকে আমরা এখনও সমর্থন করি। আমরা আবুল হাশেমের মতো গুরুদের শ্রদ্ধা করি, যিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শরৎ বসুর সঙ্গে মিলে অখণ্ড বাংলা চেয়েছিলেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশও একটি সুসংহত বাঙালি পরিচয়ের জন্য প্রয়াস চালান এবং বেঙ্গল প্যাক্টের মাধ্যমে অখণ্ড বাংলার পক্ষে কথা বলেন। আমরা চিত্তরঞ্জন দাসকে তার কাজের জন্য, তার অবদানের জন্য গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
১৯৭১ সালের লড়াই ছিল রাজনৈতিক ইসলামের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, বাঙালি মুসলমান বা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিরুদ্ধেও নয়। ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশি পরিচয়ের সূচনা হয়েছিল। ১৯৪৭ না হলে ১৯৭১ হতো না, যেমনটি আবুল মনসুর আহমদ উল্লেখ করেছেন। লাহোর প্রস্তাবের আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে পূর্ণ হয়েছিল। আমি পাকিস্তান আন্দোলনকে ভিন্নভাবে দেখি, একে পূর্ব পাকিস্তান আন্দোলন বলি, কারণ এটি মূলত বাঙালিদের মাধ্যমে হয়েছিল। যখন তারা বুঝতে পেরেছিল পাঞ্জাবি আধিপত্যের কারণে রাষ্ট্রে কার্যকর স্বায়ত্তশাসনে রূপান্তর হয়নি, তখন ১৯৭১ সালে তারা এই নিয়ন্ত্রণকে উচ্ছেদ করে।
সমতার আহ্বান ছিল ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা, যেখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বৈষম্যের বিরোধিতা করে এবং সমান সুযোগের আশায় একত্রে রাস্তায় নেমেছিল। এতে মাদ্রাসার ছাত্রসহ ইসলামিক স্কলাররা অংশ নেন এবং প্রায় ১০০ মাদ্রাসা ছাত্র শহীদ হন। ১৫ বছর ধরে তারা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিল; যারা ধর্ম পালন করে তাদের জঙ্গি আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। শ্রমিক ও নারীরাও লড়াই করেছে; প্রতিটি শ্রেণি তাদের অনন্য আকাঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত ছিল। এই পার্থক্য সত্ত্বেও সম্মিলিত শুরুর বিন্দু ছিল বৈষম্যের বিরোধিতা এবং সমতার অন্বেষণ। ফলস্বরূপ, আমরা এই কমন বিষয়গুলির উপর আমাদের কাজ করে যাব।
তাহলে বাংলাদেশের চূড়ান্ত ভিত্তি কী? এ অঞ্চলের মানুষ যখন ধারাবাহিকভাবে লড়াই করছে, তখন মানুষ বা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত পরিচয় কী?
মাহফুজ আলম : অন্যান্য সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুদের ঐক্যের মধ্যেই বাংলাদেশের ভিত্তি নিহিত। বাঙালি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় পরিচয়ের রাজনীতির প্রয়োজন নেই; তারা রাষ্ট্রকে স্পষ্ট করে তোলে। রাষ্ট্রের দুটি দিক: রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের বিকাশ এবং রাষ্ট্র গঠন। বাঙালি মুসলিম আকাঙ্ক্ষা থেকে রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে হবে। রাষ্ট্রকে বাঙালি মুসলমান ও হিন্দু—সবাইকে সমান বিবেচনা করতে হবে।
বাঙালি মুসলমান তাদের অধিকার আদায়ের জন্য বারবার সংগ্রাম করেছে। ১৯৪৭ সালে তারা পাঞ্জাবি আধিপত্যের কারণে সেটা অর্জন করতে পারেনি এবং ১৯৭১ সালে মুজিববাদ তাদের আবদ্ধ করে রেখেছিল। এমন একটি রাষ্ট্রের সন্ধানে তারা ২০২৪ সালে আবার জেগে ওঠে, যেটা বৈষম্যহীন, আরও বেশি গণতান্ত্রিক এবং আরও বেশি সমতার। এই লড়াই ধর্ম নিয়ে নয়, যদিও ধর্মীয় অনুপ্রেরণা রয়েছে—এটি ধর্মীয় শাসনের জন্য নয়, সাম্য ও ন্যায়বিচারের জন্য।
আপনি দেশে সমঝোতার কথা বলেন; ২০২৪ সালের বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের পর তা কতটা সম্ভব? ইতোমধ্যে শাহবাগ-হেফাজত বিতর্ক বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের দৃশ্যপটকে প্রভাবিত করছে।
মাহফুজ আলম : ১৯৭১ সালের পরে একটি সমঝোতার প্রয়োজন ছিল এবং জামায়াতের সাথে সমস্যাটি ২০১৪ পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হওয়া উচিত ছিল না। এটি আগেই সমাধানের প্রয়োজন ছিল। এখন আওয়ামী লীগের প্রশ্ন তুলে জাতীয় ঐক্যকে আরও দুর্বল করার তৎপরতা চলছে। আমি মনে করি ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশে শাহবাগ-হেফাজত দ্বন্দ্ব উবে গেছে। তবে সাংস্কৃতিক লড়াই রয়ে গেছে। শাহবাগ-হেফাজত দ্বন্দ্ব কেবল রাজনৈতিক নয়; এটি একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব। মুজিববাদীরা এই সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বকে স্থায়ী করেছে। তারা জাতির মধ্যে বিভাজন ধরে রাখছে এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি অংশের সঙ্গে মিলে অন্য অংশকে সত্যিকার অর্থে বোঝার চেষ্টা না করে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে আখ্যা দেয়। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য দ্বন্দ্বের এই চক্রটি মুজিববাদীরা সাজিয়েছে।
যে ধরনের সংবিধানের আমরা আশা করছি তা বিভাজনমূলক হবে না; এটা অধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে। আমাদের লক্ষ্য হলো শাহবাগ-হেফাজত দ্বন্দ্বের সমাধান করা। কিন্তু এর শিকড় সাংস্কৃতিক রাজনীতির গভীরে রয়েছে। শুধু একটি নতুন সংবিধানের মাধ্যমে এটি সম্পূর্ণরূপে সমাধান সম্ভব না। তবুও আমরা এই বিভেদ দূর করার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশ তার নতুন রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কারের প্রেক্ষাপটে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে কীভাবে দেখবে? ২.০ বাংলাদেশে পররাষ্ট্রনীতি কোন পথে চলবে?
মাহফুজ আলম : আমি বাস্তববাদী এবং সংবেদনশীল মানুষ। আমরা সভ্যতাগত মিশ্রণ এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলির পক্ষে কথা বলছি যা আমাদেরকে মধ্য এশিয়া থেকে তুরস্ক এবং চীন থেকে কোরিয়া ও জাপানে সভ্যতাগত সংলাপের মাধ্যমে যুক্ত করে। আমি যখন সামুদ্রিক সম্পর্কের কথা বিবেচনা করি, তখন আমরা দেখতে পাই আমাদের প্রভাব শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে হওয়া পররাষ্ট্রনীতিকে আমরা সমর্থন করি। কিন্তু বাংলাদেশে বিভক্তিমূলক রাজনীতি সমন্বিত জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আমাদের নেতারা জাতীয় পরিচয় বা ঐক্যের প্রশ্নে একত্রিত হতে পারেননি, যা আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করেছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চরিত্রের অনুপস্থিতির কারণে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে স্বচ্ছতা ও আলোচনার অভাব আছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি খুবই আজ্ঞাবহ এবং দলীয় রাজনীতি দ্বারা চালিত। এটি পরিবর্তনের জন্য আমাদের অবশ্যই জাতীয় সমঝোতা করতে হবে। নতুন দৃশ্যপটে আমরা জনগণের কূটনীতির পক্ষে কথা বলি এবং বাংলাদেশের জন্য আমি জনগণের কূটনীতি পদ্ধতির একটি রূপরেখা দিয়েছি। আমাদের জনগণের কূটনীতির পাশাপাশি সামরিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কূটনীতি দরকার।