রেজাউল করিম রনি
মতাদর্শ থাকবে সমাজে; রাষ্ট্র হবে মূল্যবোধ ভিত্তিক
রেজাউল করিম রনি। ছবি: বাংলা আউটলুক
মার্চের মাঝামাঝি, ২০১৯ সালে আল জাজিরার অনুসন্ধানী টিম একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার শিরোনাম ছিল, ‘বাংলাদেশ সরকারের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ’। সেই প্রতিবেদনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তানভির আহমেদ সিদ্দিকী সেনা গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে তার তিন বিজনেস পার্টনারকে গুম করেন। পুরো প্রতিষ্ঠান নিজের দখলে নিতেই তিনি এই কাজ করেন বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। এমন একটি খবর প্রকাশ হলে, বাংলাদেশের কোনো মিডিয়া সেই খবরটি প্রকাশ করার সাহস দেখায় নাই। তখন হাসিনা মাত্রই ২০১৮ সালের রাতের ভোটে ক্ষমতায় এসেছেন। স্বৈরাচারী শাসনের চরম কাল চলছে। একমাত্র বাংলাদেশি মিডিয়া হিসেবে ‘জবান’ সেই খবরটি হুবহু অনুবাদ করে প্রকাশ করে। রেজাউল করিম রনি এই দুঃসাহসটি দেখান। এর পরে তার উপর নেমে আসে প্রচন্ড চাপ। জবান বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি পালিয়ে বেড়ান। এমন সব সাহসী কাজের পাশাপাশি রনি নিজেকে সাংবাদিকের চেয়ে দার্শনিক কাজের দিকেই বেশি মনযোগী রাখতে চান। হাসিনার রেজিমের একজন প্রচন্ড সাহসী সমালোচক এবং বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তাশীল মতামত তৈরিতে গত ১৫ বছর ধরেই তিনি রাখছেন অগ্রগণ্য ভূমিকা। বাংলা আউটলুকের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক ফয়সাল মাহমুদ সম্প্রতি রনির একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন । জুলাই অভ্যুত্থান ও নতুন বাংলাদেশ গঠনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশ ও কিছু নতুন প্রশ্ন সংযুক্ত করে বাংলায় অনুবাদ করেছেন সংস্কৃতিকর্মী ও নাট্য পরিচালক সাকিল সৈকত।
প্রশ্ন: দেশে একটা গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। যেসব দাবি উঠছে সেগুলোকে কতটা যৌক্তিক মনে হচ্ছে? অনেক দাবির কথা বলতে পারি, যেমন উদাহরণ হিসেবে জাতীয় সংগীত পরির্বতনের কথা বলা যায়।
রেজাউল করিম রনি : যে কোনো গণঅভ্যুত্থানের পরে এই ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আলোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক। কেন না যে অবস্থার মধ্যে এতাদিন জনগণ ছিল তার আর কোনো কার্যকারিতা নাই দেখেই তো গণঅভ্যুত্থান দরকার হয়েছিল। ফলে এখন তো এই প্রশ্নগুলোই উঠবে। এটা খুবই যৌক্তিক। এবং এটাই উপযুক্ত সময় এই প্রশ্নগুলা তুলবার জন্য। তাই বলে সব প্রশ্নের এখনই সুরাহা হয়ে যাবে তা মনে করার কোনো কারণ নাই। আপনি উদাহরণ হিসেবে জাতীয় সংগীত নিয়ে যে বিতর্কের প্রশ্ন তুলেছেন তা কিন্তু নতুন না। এই জাতীয় সংগীতটা অনেকেরই পছন্দ ছিল না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। কেন না আমাদের বুঝতে হবে জাতীয় সংগীত আসলে কি রিপ্রেজেন্ট বা প্রতিফলিত করে? জাতীয় সংগীত গোটা জাতীর আবেগ ও স্পিরিটের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এখন ১৯৭১ সালে যেটাকে জাতীয় স্পিরিট হিসেবে তখনকার বুদ্ধিজীবীরা বিবেচনা করেছিল তার মধ্যে তো কলকাতার সংস্কৃতি ও সাহিত্য রুচির আধিপত্য ছিলই। সেটাই তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে আওয়ামী লীগের ইতিহাস করেছে। কাজেই তখন যে স্পিরিট ছিল তা তো এখন কার্যকর নাই। ইনফেক্ট এই ধরনের ফাঁপা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধেই তো আমরা অভ্যুত্থান করেছি। এখন প্রশ্ন হলো- এই জাতীয় স্পিরিটকে ধারণ করা, তাকে সংগত করার মতো কি লেখক-কবি আমাদের আছে? আমাদের বেশিরভাগ কবি-সাহিত্যিক তো দলদাস। তারা জাতীয় ঐক্য ও আবেগকে ধারণ করার মতোন দার্শনিক ও আত্মিক উন্নতিতে পৌঁছাতে না পারার ফলে আমাদের গোটা সংস্কৃতিই তো খুব কুৎসিত অবস্থায় পতিত হয়েছে। এখন নতুন বাংলাদেশের যে সূচনা তার যে স্পিরিট সেটার আলোকে নতুন করে সব কিছুকে নির্মাণ করার আকাঙ্ক্ষা জাগবে এটাই স্বাভাবিক। আর জাতীয় স্পিরিট তো অনঢ়, স্থীর কোনো বিষয় না। এটাও কালে কালে পরির্বতন হয়। হতে পারে। কাজেই জাতীয় সংগীত পরির্বতনের কথা উঠেছে দেখে আঁতকে উঠার কিছু নাই। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো- নতুন বাংলাদেশের স্পিরিটকে ধারণ করে সাহিত্য সৃষ্টির মতো সৃজন প্রতিভা ছাড়া তো এই ধরনের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হবে না। তেমন লেখক যদি আমাদের থাকে যার সৃজন প্রতিভার মধ্যে গোটা জাতির এখনকার আবেগ ও স্পিরিট প্রতিফলিত হয়েছে তা হলে সেটাকে মানুষ গ্রহণ করবে। তবে দাবি উঠার বিষয়গুলাকে আমি খুব স্বাভাবিকই মনে করি।
প্রশ্ন: রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কীভাবে কাজ করবে? আমাদের দেশে বিভিন্ন শক্তি আছে। রাজনীতির ভিন্নতা আছে। সে ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কীভাবে হতে পারে?
রেজাউল করিম রনি : দেখেন, এটার অনেক লম্বা উত্তর দেওয়া যায়। সহজ করে বললে- ভিন্নতা থাকার পরেও যেভাবে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে ঠিক সেইভাবেই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কাজ করতে পারে। আমরা সবাই জানি গণঅভ্যুত্থান হচ্ছে- অভূতপূর্ব ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ। কাজেই যে স্পিরিট এই ঐক্যকে সম্ভব করেছে তাকে আগে বুঝতে হবে। এখন যদি আপনি একটা বিশেষ গ্রুপ বা গোষ্ঠীকে ক্রেডিট দেন। কাউকে হিরো? রহস্য পুরুষ বা মূল নেতা বানিয়ে পূজা শুরু করেন তা হলে সে ক্ষমতায় যাওয়ার দাবি করবে। বা স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষমতা নিতে চাইবে। এবং তখনই এই আন্দোলনের মধ্যে যে যৌথ কর্তাসত্ত্বা বা প্লুরাল সাবজেক্টিভিটি তৈরি হয়েছে তার দাফন হয়ে যাবে। একটা মেসিয়াহ বা ত্রাণকর্তা যদি আপনি খুঁজতে থাকেন তা হলে অতিদ্রুত এই অভ্যুত্থান গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার লেবাসে আর একটা ফ্যাসিবাদে পরিণত হতে শুরু করবে। ৭১ -এ এটাই হয়েছিল। কাজেই এই বিভক্ত সমাজেই ঐক্য প্রচেষ্টার জন্য মতাদর্শগত পার্থক্য বজায় রাখার সংগ্রাম যেমন জারি থাকবে, এর মধ্যে মূল্যবোধ ভিত্তিক একটা ফাংশনাল গণতন্ত্র কিভাবে কায়েম হতে পারে তার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তুলতে হবে। প্রায় সবগুলো দলকে এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গড়ে তুলবার সংগ্রামে নিয়োজিত হতে হবে। আমাদের রাজনীতি লাগবে। ক্ষমতার প্রশ্নটা পরে। সেটা জনগণ ঠিক করবে। দলগুলো ইডিওলজি বেইজড হতে পারে। সমাজের মতাদর্শ থাকবে। এটা নিয়ে সমাজে তর্ক ও প্রতিযোগিতা থাকবে। যাকে পাবলিক পছন্দ করে তাকে নির্বাচিত করবে। কিন্তু রাষ্ট্র হবে ভ্যালু-বেউজড, মানে মূল্যবোধ নির্ভর। যারা এটা বুঝতে পারে না তারাই আগে ইডিওলজি বা মতাদর্শগত পার্থক্যকে সামনে এনে খোদ রাষ্ট্রকেই ইডিওলজি ভিত্তিক করে ফেলতে চায়। এরা জাস্ট লীগের একটা রেপ্লিকা হবে। এটাই ফ্যাসিবাদি মডেল যা গণতন্ত্রের লেবাসে ফিরে আসে বা ফাংশন করে। অনেক সমন্বয়ক নামধারী তাত্ত্বিক গুরুরা এই লাইনে হাঁটছে এখন। ফলে এই আন্দোলন যদি পরাজিত হয় তা প্রথম হবে যারা এটার ক্রেডিট দাবি করে সামনে এসে ক্ষমতার আসনে বসেছে তাদের দ্বারা। আমাদের কাজ হবে এই ক্রিটিকটা পরিষ্কার করে বলে দেওয়া। কাজেই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হতে হবে রাজনীতি নির্ভর। ক্ষমতা নির্ভর না। রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে কোনো সমাধান হবে না। সেই ক্ষেত্রে আমাদের কাজ হলো- গত দেড় দশকে আমাদের সমাজে ফ্যাসিবাদের যে সামাজিকীকরণ হয়েছে তাকে মোকাবিলার জন্য কালচারাল ফাইট করা, মানে কাউন্টার কালচার ডেভলপ করা। এবং এর সূত্র ধরে গভীর দার্শনিক ইন্টারভেনশন করতে হবে। এইসবগুলার মূল লক্ষ্য থাকবে একটা রাজনীতি নির্মাণ করা। যেই রাজনীতি আমাদের মধ্যে একটা কালেকটিভ মোরাল ঐক্য তৈরি করে। একটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী আকারে আমাদের সংগঠিত হতে সাহায্য করবে। এটা না হলে স্বার্থভিত্তিক ঐক্য কিছুদিন ওয়ার্ক করবে। তার পরে অবস্থা আগে যেমন ছিল তেমন বা তার চেয়ে খারাপের দিকে যাবে।
প্রশ্ন: রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন করে সংবিধান পুনর্লিখনের দাবি উঠছে। বর্তমান সংবিধানের বেশকিছু বিধিবিধান স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের জন্ম দেয়, এমন অভিযোগ আছে।
রেজাউল করিম রনি : ঠিক বলেছেন। এই ফ্যাসিবাদকে আমরা সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ বলছি। কারণ—পলাতক হাসিনা সংবিধানকে একটা শেখ পরিবারের দলিলে পরিণত করেছিল। আর এটার যাত্রা শুরু হয়েছিল বড় শেখ মানে মুজিবের হাত ধরে সেই ’৭২ সালে। ফলে এই গণঅভ্যুত্থানের পরে সবচেয়ে জরুরি হলো জনগণের অভিপ্রায়কে ধারণ করতে পারে এমন একটা সংবিধান আমাদের লাগবে। সংবিধান মানে আইনি কিতাব না। সংবিধান বলতে আমরা অনেক সময় জটিল আইনের বিধান বুঝি । কিন্তু এটা হতে হবে জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার আলোকে প্রণীত একটা জাতীয় ঐক্যর ভিত্তিপুস্তক।
যাতে, জনগণের কমন ইচ্ছার বা স্পিরিটের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। এটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ঠিক হবে। আর আইনি বিষয়গুলা পরে জনগণের প্রতিনিধিরা ঠিক করবেন। কাজেই আমি মনে করি সংবিধান এমন ডাউস বই হতে হবে এর কোনো মানে নাই। জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর মতো একটা সংবিধান ছোট একটা চটি বইতেই তো থাকতে পারে। আর অবশ্যই তাতে অতীতের সব মুক্তির আন্দোলনের লিগেসির স্বীকৃতি থাকবে। কিন্তু এখনকার সংবিধান হতে হবে ২৪ এর অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধারণ করে। নতুন যে জনআকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে তার আলোকে হতে হবে। এটা একটা জেন-জি সংবিধান হতে হবে। পুরানা আমলের রাজনৈতিক কু-মতলব বাস্তবায়নের সব পথ বন্ধ করে সততা ও নীতির একটা রিফ্লেকশন থাকতে হবে নয়া সংবিধানে। এগুলা নিয়ে আমি বিস্তারিত লিখেছি। অনেক জায়গায় বলেছি। সংক্ষেপে এতোটুকুই থাক আজ।
প্রশ্ন: সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে এখন নানা রকমের সংস্কারের দাবি উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এসব সংস্কারের দাবি কতটা পূরণ করা সম্ভব হবে।
রেজাউল করিম রনি : সংস্কার কথাটার পক্ষে আমি না। আমি পুনঃগঠন কথাটি ব্যবহার করবো। ১/১১ –এর সময়ে সংস্কারের কথা বলে আমরা জাতির সাথে প্রতারণা করতে দেখেছি। এখন এই পুনঃগঠন করার ক্ষমতা এই সরকারের খুব যে আছে তা মনে করি না। এই সরকারকে কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ছাত্র-জনতার পক্ষে। পুনঃগঠনের কাজটি করতে হবে সম্মিলিত ভাবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে। আগামীর বাংলাদেশের জন্য যে ধরনের পুনঃগঠন লাগবে তাতে জেন-জি -এর চাওয়াকে আমলে নিয়ে কাজে হাত দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলার যে পুরানা খাসিলত তাতে এরা নিজেরা যদি নিজেদের সংস্কার আগে করে না নেন তাহলে দেশ পুনঃগঠনে তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ থাকবে না। সে ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক শক্তির হাতে ক্ষমতা আটকে পড়ার সম্ভাবনা আছে। তাই পুনঃগঠনকে কোনো সরকারের একক কর্মসূচি না মনে করে এটা জাতীয় কর্মসূচি হিসেবে নিতে হবে। এবং তাতে সবার অংশগ্রহণের একটা প্রক্রিয়া আমাদের বের করতে হবে। এটাই হতে পারে গণতান্ত্রিক একটা দেশ গঠনের পথে হাঁটার কাঙ্ক্ষিত শুরু। তা না হলে অতীতের মতো এই সংস্কারও একটা ভাওতা হিসেবে চিহ্নিত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে- কেউ আমাদের কাজটা করে দিয়ে যাবে না। আমাদের ত্রাণকর্তা কেউ হয়ে উঠবে না। বা হয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। আমাদের কোনো হিরো খুঁজবার দরকার নাই। আমাদের সবাইকে মিলেই যৌথতার ভিত্তিকে একটা নতুন বাংলাদেশ গঠনের কাজে হাত দিতে হবে। এই সংস্কার যদি সবার পক্ষ থেকে না হয়ে একটা গ্রুপের মনোপলি হয়ে ওঠে তা হলে তা সফল হবে না। এটাই বড় চ্যালেঞ্জ এখন। এটার একটা সামাধন হতে পারে হেগেলের দেখানো পথে। লম্বা আলাপ না করে শুধু বলি- ব্যক্তি না কর্তা বা সাবজেক্ট হবে খোদ স্পিরিট। এবং এর আলোকে প্রতিষ্ঠান তৈরি হলে জনগণ ধীরে ধীরে নাগরিকের গৌরব বা মর্যাদা অর্জন করতে শুরু করবে। ইকুয়ালিটির পথে হাঁটা সহজ হবে। তা না কলে বীরপূজা শুরু হলে কাজের কাজ হবে না। আত্মশক্তি অর্জন না করতে পারলে আত্মগৌরব আমাদের কোনো কাজে আসবে না।
প্রশ্ন: পরাশক্তিগুলোর কাছে বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান তার একটি ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। এই গুরুত্ব এখানে সরকার গঠনে কী ধরনের প্রভাব রাখে।
রেজাউল করিম রনি : পরাশক্তি বলে দুনিয়াতে কোনো শক্তি নাই। পরাশক্তি বলতে যদি আমেরিকাকে বুঝাইতে চান! তো এরা তো আফগানিস্তানে পরাজিত হয়েছে। ভিয়েতনামে হয়েছে। কাজেই পরাশক্তির ধারণা থেকে বের হতে হবে। তবে হ্যাঁ, এখন রাষ্ট্র একটা গ্লোবাল রিয়ালিটির মধ্যেই গঠিত হয় এবং ফাংশন করে। সেই ক্ষেত্রে জরুরি হলো— আমরা নিজেরা আমাদের মধ্যে কতোটা সংঘঠিত সেটা বিবেচনায় নেওয়া। কতোটা প্রস্তুত নিজেদের অধিকার ও আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে তার উপর নির্ভর করবে অন্য রাষ্ট্রগুলো আমাদের কিভাবে ট্রিট করবে। এটা আমাদেরই ঠিক করতে হবে। এটা আমরাই ঠিক করবো। তার পরে যাদের স্বার্থ আছে তারা তাদের স্বার্থ নিয়ে ধীরে ধীরে নেগোসিয়েশন করতে আসবে। ভারতের গোলাম বা আমেরিকার চাকর হওয়ার শর্ত মেনে ক্ষমতা দখলের ভেল্কিবাজির দিন খতম করতে হবে। ফলে আমাদের ঐক্যই পারে এই ধরনের বিষয়গুলোতে নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করতে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের ভূ-অর্থনীতির কথা বলি। আমাদের রপ্তানি বাজার পশ্চিমে, কিন্তু বেশিরভাগ পণ্য আমদানি হয় চীন আর ভারত থেকে। এই দুই দেশের ওপর নির্ভরশীলতা বেশ বেড়েছে। এখানে কি কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখেন?
রেজাউল করিম রনি : বাংলাদেশকে তো ভারতের বাজারে পরিণত করা হয়েছে সব দিক থেকেই। চায়নার ঘটনাটা অন্য। এরা সারা দুনিয়াতেই বাজার বিস্তার করে ফেলেছে। কারণ- চাইনিজ পণ্যের মূল্য ও সহজলভ্যতা ইতিহাসের এক অতুলনীয় ঘটনা। ফলে চায়নার শত্রু দেশেও চায়নার পণ্য নির্ভর হয়ে আছে এমন বহু দেশ আপনি দেখতে পাবেন। কিন্তু আমাদের মূল বাস্তবতা হলো- এখানে উন্নয়ন ও নগরায়নের নামে, পরিবেশ ও কৃষির এমন সর্বনাশ করা হয়েছে যে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা প্রায় শূন্য। কৃষিকে এখনও বঞ্চিত লোকের পেশা হিসেবে দেখা হয়। চাষা -এখনও গালি। সব নাগরিক সমান হবে –এটাই আমরা চাই। তারপরেও এই দেশের নাগরিকদের মধ্যে যদি সবচেয়ে বেশি সম্মান কারো প্রতি দেখাতে হয় সেটার প্রাপ্য তো কৃষকদের। কিন্তু এখন দেখেন তো কৃষক কই? কৃষক দ্রুত খামারি হতে চায়। হাইব্রিড বীজ ও কিটনাশক নির্ভর এই উৎপাদন ব্যবস্থা জনস্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। কাজেই আমাদের সব উন্নয়ন বন্ধ করে হলেও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে। গ্রাম হবে শহর –এর চেয়ে ভয়াবহ প্রচার আর কি হতে পারে? অথচ এটাকে আধুনিকতার নামে রাজনৈতিক দলগুলো অন্যতম এজেন্ডা করে প্রচার করেছে। আমাদের চিন্তার মধ্যে ফুটানি ঢুকে গেছে। বাংলাদেশের প্রকৃতির সাথে জীবনের সম্পর্ক রক্ষার সূত্র হলো- আমাদের সনাতনি কৃষি। এটাকে আমরা যুগোপযোগী করবো। তবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের দিকটি আগে নিশ্চিত করে নিতে হবে। কাজেই আমাদের ভূ-অর্থনীতির দিক থেকে আমরা খুবই বাজে অবস্থায় আছি। একদিকে গার্মেন্টে দর্জিগিরি করি অন্যদিকে ভারত থেকে পণ্য কিনি। এগুলো কোনো জাতির শক্তিশালি অর্থনৈতিক অবস্থান তৈরির লক্ষণ না। এগুলা পাল্টাতে হবে। আমাদের জমিকে যত্ন করতে হবে। তাতে পরিবেশ ও খাদ্য দুটাই ঠিক হবে। পরনির্ভর অবস্থায় আপনি ভালো খাইলেও, কম দামে খাইলেও আপনার নিজের উৎপাদন ঠিক না হলে অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদি হওয়ার সুযোগ নাই।
প্রশ্ন: ক্যম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়ে আপনার মতামত কী?
রেজাউল করিম রনি : রাজনীতি কি নিষিদ্ধ জিনিস নাকি? বাংলাদেশে তো এমনিতেই রাজনীতি নাই। আছে দলাদলি। আমাদের শৈশব থেকেই রাজনীতির শিক্ষা দেওয়া শুরু করা দরকার। আপনি বলেন, নিষিদ্ধ করতে? পাগল নাকি?
প্রশ্ন: গত কয়েকদিন দেশে যা ঘটে গেল, তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রেজাউল করিম রনি : গত কয়েকদিনে দেশে যা ঘটেছে তা গত ১৫ বছর ধরেই ধীরে ধীরে তৈরি হইতেছিল। ফ্যাসিবাদী শাসনই এমন ঘটনা ঘটার কারণ তৈরি করেছে। এটা নিয়ে বিস্তারিত বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। আমি শুধু একটা কথাই বলবো- এই জেনারেশন, যাদের আপনারা জেন-জি বলেন, তারা এতোদিন অন্যদের ইতিহাসের মধ্যে থেকে হাফিয়ে উঠে ছিল। সেই ৭১ এর ইতিহাসের প্রজন্ম তো ১০ ভাগও বেঁচে নাই। ৯০ এর ইতিহাস তৈরি করা প্রজন্মেরও বয়স ৬০ এর উপরে। এগুলার মধ্যে এই জেনারেশনকে আটকে রাখা হয়েছিল। তার কোনো বিলংগিং ছিল না। সে ছিল আদার। সে বাঁচতে ছিল দাদার ইতিহাসের বা বাবার ইতিহাসের মধ্যে। আর সবগুলার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবেই তো বাংরাদেশে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ কায়েম হতে পেরেছে। ফলে স্পিরিট অব দ্য জেনারেশন অবরুদ্ধ ছিল। তার কোনো হিস্ট্রিক্যাল সাবজেক্টটিভিটি ছিল না। এই সময়ের মধ্যে তার কোনো স্বপ্ন ও কল্পনাকে সে খুঁজে পাচ্ছিল না। সে এলিয়েনেটেড হয়ে পড়ছিল। সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। তার বাপ-চাচা চোর হলেও আওয়ামী মিথ্যার সাম্রাজ্য তার বেসিক হিউম্যান ডিগনিটিকে অপমাণিত করছিল। সে হাঁসফাঁস করছিল। সে ইতিহাসে নিজের হাজিরা জানান দিতে চাইছে। অনেকবার চেষ্টা করেছে। দেখলো এবাবে হবে না। তখন সে মৃত্যুকে হাসতে হাসতে বরণ করে নিলো। কইলো- বিদায় পৃথিবী। দাঁড়ায়ে গেল গুলির সামনে। আর এভাবেই সে ইতিহাস তৈরি করেছে। তার সময়ের সে দখল নিছে। ইতিহাসের সাথে তার যাপিত সময়ের মীমাংসা করতে চেয়েছে। এখন সে বুক উঁচা করে লিখছে- এইটা জেনজির সময়। সে আপনার সময়ের অধীনে, আপনার মিথ্যা বয়ান ও কল্পনার অধীনে বাঁচতে পারছিল না। ফলে সে রিভোল্ট করেছে। ধনীর জেনজি থেকে হকার জেনজিগুলির সামনে দাঁড়িয়ে কইছে আমিই বিকল্প। হাসিনা চু.. না। সে তার ইতিহাসের রেফারেন্স পয়েন্ট তৈরি করেছে। সে বীরের মতো লড়েছে। অগ্রভাগে থেকে ফাইট করেছে এবং অন্য সবার অংশগ্রহণে গোটা দেড় দশকের সংগ্রামকে বিজয়ের গৌরবে রূপান্তরিত করেছে। সেই দিক থেকে এটা সবার সংগ্রামেরও ফসল। কিন্তু এটার ঐতিহাসিকতার মধ্যে যাদের হক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারা জেন-জি। ইটস টাইম ফর জেন-জি।
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সংগ্রামগুলো সফল হলে বাচ্চাদের এভাবে প্রাণ দিতে হইতো না। আমি জানি না গাজা ছাড়া, দুনিয়ার আর কোনো দেশের গণতন্ত্রের সংগ্রামে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এতো শিশু ও কিশোর নিহত হয়েছে কি না এতো অল্প সময়ে। কিন্তু সমস্যা হলো- এই জেন-জির কোনো রাজনীতি নাই। আমি আগেই বলেছি সে স্বাধীনতা চায়। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। রাজনীতিকে সে তেমন ডমিনেন্ট দেখতে চায় না। সে ওয়েস্টটার্ন রুচিতে আরাম পায়। ভার্চুয়াল সোসাইটির মানুষ সে। রিয়েল সমাজকে সে তেমন বুঝতেও পারে না। কিন্তু তারা এবার ইতিহাসের মধ্যে নিজের হকটা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু তারা রাজনৈতিক মুক্তির বিষয়ে আপনাকে হেল্প করতে পারবে না। সেটা তাদের কাজ না। রবিনহুড মডেলে দেশ চলে না। এটাকে যারা রাজনীতি মনে করে, তরুণদের সামনে রেখে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করছে এবং সব রাজনৈতিক দলের সংগ্রাম ও সাধারণ মানুষের ত্যাগকে পাশ কাটিয়ে এই অভ্যুত্থানকে ছাত্রদের মনোপলিতে পরিণত করতে চাচ্ছে তারা এই আন্দোলনের শত্রু। এরা টাউট। জেন-জি কিন্তু কাউকে পীর বানাচ্ছে না, তারা গোটা জেনারেশনকে হিরো মনে করে। এটাকে আপনার লীগের খুনিরা বাদে গোটা দেশ হিরো -এই জায়গায় নিতে হবে। কাজেই এইভাবে রাজনৈতিক মুক্তির প্রশ্নটার সমাধান আপনাকেই করতে হবে।
এখন আমাদের কাজ হলো তাদের আকাঙ্ক্ষার অনুগামী একটা রাজনীতি তৈরি করা। আর সেই রাজনীতিই যেন দেশকে পরিচালনা করে, তাতে তারা যেন স্বাধীনতার পুরো স্বাদ প্রাণভরে উপভোগ করতে পারে এটা ঠিক করা। এটা না করতে পারলে দেশে এনার্কি থামবে না। এতোটুকুই থাক এখানে।
প্রশ্ন: গণঅভ্যুত্থানের নায়ক তরুণদের এখন কী করণীয়?
রেজাউল করিম রনি : তরুণদের এককভাবে কিছুই করণীয় নাই। আর দেশে এক রকম তরুণ বলে কিছু নাই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ, প্রাইভেটের তরুণ, শ্রমিক তরুণ, কওমি তরুণ, নিরক্ষর তরুণ, ছবির হাটের গাঁজাখোর তরুণ- এমন নানান শ্রেণির তরুণ আছে। একক তারুণ্য চিহ্নিত করে শাহবাগের ফ্যাসিবাদি কৃত্রিম গণজাগরণ বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ কায়েমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এটা ভুলে গেলে চলবে না। নতুন রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার কাজটা শুধু তরুণরা করতে পারবে না। কেন না এটা কোনো বিপ্লব না। এটা একটা গণঅভ্যুত্থান। ফলে তরুণরা কোনো রাজনীতির প্রস্তাব করে নাই। তাদের কোনো রাজনীতি নাই ইনফ্যক্ট। এখন এই রাজনীতি না থাকাকেই অনেক উম্মাদ নয়া রাজনীতি হিসেবে তত্ত্বায়ন করতেছে দেখা যাচ্ছে। এগুলা কুশিক্ষার ফল। রাজনীতিকে অন্য কিছু দিয়ে রিপ্লেস করার পরিণতি হয় ভয়াবহ। ফলে অরাজনীতিকে রাজনীতি বলে চালানো বা এটাই নয়া রাজনীতি বলা আত্মঘাতী। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে- এতোদিন যে ধরনের রাজনীতি চলেছে তার বিরুদ্ধে এই তারুণ ছাত্র-জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। কাজেই এখন মূল কাজ হলো রাজনৈতিক দলগুলোর। তরুণদের বা বুড়াদের আলাদা আলাদা কাজ এমন নাই। সবারই কাজ হলো- একটা গণতান্ত্রিক দেশ গঠনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্যকে সংহত করা। এর জন্য প্রথমে হিরোইজম বা কাল্ট বানানোর চেষ্টা বাদ দিতে হবে। সবাই হিরো। আওয়ামী চোরগুলো বাদে সবাইকে নিয়ে একটা দেশ গঠনে এগিয়ে যেতে হবে। আর এই আন্দোলনের কাল্টধারী বয়ান তৈরির জন্য এখন যারা কাজ করছে এরা সবাই এই আন্দোলনের স্পিরিটের শত্রু। কেন না এরা মুক্তিযুদ্ধ পূজারি। এরা জেন-জিকে ইতিহাসের জায়গা ছেড়ে না দিয়ে আলগা হিরোইজম তৈরি করছে। আন্দোলনের গুপ্তপুরুষ, মাস্টারমাইন্ড ইত্যাদি ভুয়া জিনিস সামনে আনছে। তরুণদের এগুলার থেকে সতর্ক থাকতে হবে। অনেকে কথা বলতে শুরু করার ফলে অবশ্য এই বিষয়গুলো এখন কৌতূকে পরিণত হয়েছে। তরুণরা একটা ইতিহাস তৈরি করেছে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু এই ইতিহাস তারা যদি দখল করতে চায়, অন্যদের অবদানকে গৌণ করে একটা জুলাই পূজা শুরু করতে চায়, তাহলে তারা আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যের পথেই হাঁটবে। নিজেদের সেবক ও নাগরিক হিসেবে দেখতে হবে। এবং একটা রাজনীতি তৈরি করতে- যেই রাজনীতি আমাদের ফ্যাসিবাদ থেকে চিরতরে মুক্তি দিবে। এটাই এখনকার কাজ।
প্রশ্ন: রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রোধে কি করণীয়?
রেজাউল করিম রনি : লম্বা কথা না বলে এর সহজ উত্তর হলো- আওয়ামী লীগ যা করেছে তা না করাই হলো রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রোধের সবচেয়ে ভালো উপায়। এটাই দেশ গঠনেরও মূল সূত্র হতে পারে। সেই দিক থেকে কিন্তু দেশ গঠন বরং সহজ। জাস্ট লীগ যা করছে তা না করা। প্রতিটি পদে এটা ফলো করলেই আমরা এগিয়ে যেতে পারবো। কারণ- লীগ তো শুধু একটা রাজনৈতিক দল না এটা একটা চরিত্র, স্বভাব বা খাসিলত। এটা বাদ দিতে পারলে কাজ সহজ হয়ে যায়।
প্রশ্ন: একনায়কতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদ যাতে এ দেশের মানুষের ঘাড়ে আর না চেপে বসে সেটি নিশ্চিত করতে কি পদক্ষেপ নিতে হবে?
রেজাউল করিম রনি : উপরের প্রশ্নে আমার মনে হয় সেই আলাপ চলে এসেছে। আমাদের দেশে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা চলছে। কারণ- দেশে একমাত্র রাজনীতি (যেটা আসলে ফ্যাসিবাদ) ছিল লীগের, বাকিরা তার প্রতিক্রিয়াতে রাজনীতি করতো। লীগ শেষ, দেখেন রাজনীতি নাই। একদিকে ফ্যাসিবাদ এবং অন্যদিকে তার প্রতিক্রিয়াতে গড়ে উঠা রাজনীতি—এই দুইটাই নতুন যে গণআকাঙ্ক্ষা তার সাথে যায় না। ফলে বাকি দলগুলোর দ্রুত এই সময়ের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার আলোকে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। সেটা করতে পারলে ভবিষতের জন্যও ফ্যাসিবাদ ঠেকানো সম্ভব হবে। সেটা কেমন হবে উপরের প্রশ্নে তা খানিকটা বলেছি।
প্রশ্ন: সাংস্কৃতিক ও সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের কথা সংক্ষেপে একটু বলেন। এটা নিয়ে আপনি অনেকদিন থেকে কাজ করছেন আমরা জানি।
রেজাউল করিম রনি : আমরা দেখেছি- আওয়ামী লীগ মূলত একধরনের সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদকে মূলধারা হিসেবে কায়েম করে তার উপর ভর করেই টিকে ছিল। মিডিয়া ছিল এটার অন্যতম সহযোগী। মানে সাংস্কৃতিক ফোর্সকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাশীন ছিল। আর এই কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিটাই রাজনৈতিকভাবে আমাদের পরাধীন করে রেখেছিল। এই ফ্যাসিবাদের সংস্কৃতিকে দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরাজিত করতে না পারলে রাজনৈতিক মুক্তি আসবে না। ঠিকই বলেছেন—এই বিষয়ে আমি বিস্তারিত লিখেছি। সেই দিক থেকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ মূলত সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ। আর এটাকে সংবিধান সংশোধন করে জমিদারতন্ত্র হিসেবে কায়েম করা হয়েছিল হাসিনার হাত ধরে। আমাদের এখন ফ্যাসিবাদ-বিরোধী কাউন্টার কালচার তৈরি করতে হবে। এটা শক্তিশালী না হলে ফ্যাসিবাদি ধারাই মূলধারা হিসেবে আবার ফিরে আসবে। এই তথাকথিত ইসলামোফোব সেক্যুলার ফ্যাসিবাদি সাংস্কৃতিক ধারাকে পরাজিত করার কাজ একদিনেই হবে না। আমরা গত ১৫ বছর ধরে এটার বিরুদ্ধে লড়ছি। কিন্তু আমাদের সফলতা তেমন উল্লেখ্যযোগ্য অবস্থায় পৌঁছায় নাই। কারণ রাজনৈতিক দলগুলা এগুলাকে এখনও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। তারা বুঝতে পারে না ক্ষমতার চেয়ে রাজনীতি জরুরি। আমি সব সময় বলি- ক্ষমতা আপনাকে টিকিয়ে রাখার গ্যারান্টি দিতে পারবে না, কিন্তু রাজনীতি আপনাকে টিকিয়ে রাখবে। এবং আপনি ক্ষমতায়ও আসতে পারবেন। রাজনীতিহীন ক্ষমতার দৌড়াদৌড়ি একটা ফ্যাসিবাদি প্রবণতা। এটা বাংলাদেশে প্রবলভাবে আছে।
প্রশ্ন : বর্তমান গণঅভ্যুত্থানকে সফল করতে হলে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি ডেকে সংবিধান প্রণয়নের দাবি অনেক জোরালো হয়ে উঠেছে।
রেজাউল করিম রনি : এটা জাতীয় কমিশন বা অ্যাসেম্বলি গঠন করে করা যায়। এটা করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো- এটা রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে তো হবে না। সবাইকে নিয়ে করতে হবে। এই সরকার একা এটা করতে পারবে না। ৭২ –এর মতো একই ভুল করা যাবে না। আমাদের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নামে যে ফ্যাসিবাদি ধারাবাহিকতা চলেছে তার থেকে বের হতে হবে। এটা করতে না পারলে এই গণঅভ্যুত্থান একটা ট্রাজেডিতে পরিণত হবে। আমরা সবাই এটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে অবশ্যই এটার একটা সুরাহা হবে। এটা করতেই হবে। তবে এটার মধ্যে পুরানা কিছু ধান্ধাবাজ লোকও আছে। যারা অতি আতলামি আর নিজেদের স্বার্থ রক্ষা ছাড়া জনগণের জন্য আর কিছু করে নাই, তারা কূটচাল ও কৌশলকে জ্ঞান মনে করে। তাদের খপ্পরে পড়া যাবে না। পারসোনাল সততা একটা বড় বিষয়। এটার অভাবই ফ্যাসিবাদ কায়েমে সহযোগিতা করেছে। কাজেই চিহ্নিত টাউট বুদ্ধিজীবী, দার্শনিকদের কথায় ঘাবড়ে না গিয়ে সাধারণ জনগণের ইচ্ছা ও সরলতার আলোকে রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সংবিধান প্রণয়ন একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। তাই সবারই এতে অংশগ্রহণ করার অধিকার আছে। এটা আমাদের প্রথমেই বলে নিতে হবে। এটাকে অহেতুক জটিল ও বিরাট জ্ঞানীদের কাজ হিসেবে দেখার দরকার নাই। দেশ গঠনের অন্যতম কাজ হলো- জুলাইয়ের স্বাধীনতার সম্মিলিত স্পিরিটকে একটা রাষ্ট্রের রূপ দেওয়া। তা না হলে নাগরিকদের স্বাধীনতা আসবে না। দেশের স্বাধীনতার মধ্যেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা আটকে থাকবে। মনে রাখতে হবে—রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া দেশের স্বাধীনতার কোনো অর্থ থাকে না।
প্রশ্ন: আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
রেজাউল করিম রনি : ধন্যবাদ আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য। আর এতোক্ষণ এই কথাগুলো পড়বার জন্য প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।