সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা
বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান হতে পারে
আউটলুক ডেস্ক
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৪, ০৪:১১ পিএম
বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা।
বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজীনা। যুক্তরাষ্ট্রের টাইম টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই মন্তব্য করেন তিনি। টাইম টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু তাহের তার সাক্ষাৎকার নেন।
সাক্ষাৎকারে ড্যান ডব্লিউ মজীনা বলেন, কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটতে পারে। আবার পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোও পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। আবার এটা হতেও পারে, না-ও হতে পারে।
বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ধারায় ভারত সহায়তা করতে পারে। সীমান্তের কাছে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে না। ফলে ভারত সহায়তা করতে পারে। হতে পারে আন্তর্জাতিক বন্ধুরা র্যাবের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সহায়তা করতে পারে পুনরেকত্রীকরণের ক্ষেত্রে।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে এখানে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে। আমি বহুদলীয় (রাজনৈতিক) প্রক্রিয়া সমর্থন করি। এটা ভাঙা উচিত। এ জন্য প্রয়োজন অর্থপূর্ণ সংস্কার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ব্যাপারে ড্যান ডব্লিউ মজীনা বলেন, আমি জানি না কতো মানুষ নিহত হয়েছেন। আমি বিধ্বস্ত। যা ঘটেছে এবং যা ঘটছে তাতে আমি বিপর্যস্ত। গত সপ্তাহে যা ঘটেছে তাতে আমি ভীতসন্ত্রস্ত। এটা হতে পারে ১৫০, হতে পারে ২০০, হতে পারে ৪০০, আমি জানি না। সংখ্যাটা যা-ই হোক, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের ভালো মানুষ। কেন তাদেরকে হত্যা করা হলো? কেন? আমি বিপর্যস্ত।
এই রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, যা ঘটেছে তা ফেরাতে পারবেন না। আসুন আমরা এখন কোথায় আছি সেটা দেখি। বাংলাদেশ এখন কী করছে? আমার মায়ের কথা বলতে পারি। আপনি তাকে দেখেননি। মা এবং সবাই আমাকে ড্যান নামেই ডাকেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন- ড্যান, তোমার জীবনে অনেক অনেক কালোমেঘ আসবে। কখনো কখনো সেই নিকষ কালোমেঘের মধ্যে তুমি ‘সিলভার লাইনিং’ দেখতে পাবে।
তিনি বলেন, ১ জুলাই সেই কালোমেঘ দেখতে পেয়েছি আমি। আমার মায়ের কথা মনে হয়েছে। এই ভয়াবহতার মধ্যে কোনো ভালো কিছু থাকতে পারে। যা দেশের জন্য অধিকতর ভালো কিছু হবে। উত্তরটা হ্যাঁ হবে নাকি না হবে তাও জানি না। গত সপ্তাহে যে ভয়াবহতা দেখেছি, তা হয়তো হতে পারে বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে অচল রাজনৈতিক জ্যামকে ভাঙতে সহায়ক। আপনি জানেন আমি কি নিয়ে কথা বলছি। এর প্রেক্ষিতে আমার কি ধারণা সেটা শেয়ার করতে পারি। আমি নিশ্চিত এই ভয়াবহতা বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসবে। হতে পারে এটা একটি ব্যর্থ চর্চা। আমি এ বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারি না। প্রথমত, সর্বোপরি আজই এসব বন্ধ করুন।
ডব্লিউ মজীনা বলেন, সেনাবাহিনীকে তার ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। প্রত্যেককে তাদের জায়গায় (কাজে) ফিরতে হবে। ইন্টারনেট মুক্ত করে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিতে হবে। আটক রাখা ছাত্রদের ছেড়ে দিতে হবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, বিশ্বাসযোগ্য, নিরপেক্ষ/ক্রেডিবল/ইন্ডিপেন্ডেন্ট তদন্ত শুরু করতে হবে। তাতে পরিষ্কার করতে হবে কী ঘটেছিল এবং পরিষ্কার করতে হবে যে, কোন অপরাধের জন্য কে দায়ী। কেউ তো ওইসব মানুষকে হত্যা করেছে। আমি জানি না।
রংপুরের আবু সাঈদ হত্যার ঘটনা দেখেছেন বলে জানিয়ে তিনি বলেন, কেউ তো তাকে হত্যা করেছে। আমি মনে করি তাদের জবাবদিহিতায় আনা উচিত। কংক্রিট স্টেপ আছে, যা শুধু সরকারকে নয়, সবাইকে অল্প সময়ের মধ্যে নিতে হবে। এরপর আসুন বৃহত্তর পরিসরে। আমি একজন আশাবাদী মানুষ। বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক অচলাবস্থা আছে। এটাকে ভাঙতে হবে। অর্থপূর্ণ সংস্কার করতে হবে। সেটা হতে পারে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়।
বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে সংলাপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে অপশন কী হতে পারে? কীভাবে বলবেন এর অবসান হবে? আমি মনে করি মানুষ হত্যা কারও জন্য মঙ্গল নয়। ধ্বংস নয়, আপনাদেরকে দেশটা গড়তে হবে।
বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের প্রভাবের বিষয়ে ডব্লিউ মজীনা বলেন, এটা কোনো গোপন কথা নয়। সবাই জানেন ২০১৪ সালের নির্বাচনকে সামনে নিয়ে নয়াদিল্লি কি চেয়েছিল। আমি সবাইকে বলেছি, ভারতও সবাইকে বলেছে- একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চায় ভারত। আমিও এটা বিশ্বাস করি। আমি ইতিহাসের পেছনে যেতে চাই না। আপনি যেটা বলছেন আমার ধারণা তার থেকে ভিন্ন ছিল। ভারত সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে নাকি করবে না- সেটা নিয়ে নয়। তারা একটি দলকে সমর্থন করবে কিনা বিষয়টি তা নয়। আমার মতে, বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিকভাবে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আছে। তারা তাদের নেতা নির্বাচনের জন্য বদ্ধপরিকর। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের ভূমিকার বিষয়ে ড্যান মজীনা বলেন, এক্ষেত্রে তাদের ‘ফেভারিট হর্স’ আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ডব্লিউ মজীনা বলেন, আমি তো বাইরে থেকে কথা বলছি। আমি আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি, আমি একজন প্রাইভেট সিটিজেন। আমার বিষয় ছাড়া অন্য কারও বিষয়ে আমি কথা বলতে পারি না। যুক্তরাষ্ট্র সরকার কী করছে, কী ভাবছে ভেতরে ভেতরে সেটা আমি জানি না। পিটার হাস্কে নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। এটা তার নিজের ব্যাপার। এ বিষয়ে আপনি সরকারের কাছে জানতে চাইতে পারেন।
বাংলাদেশের সমস্যাগুলোর সমাধান দেশের মানুষকেই করতে হবে জানিয়ে ডব্লিউ মজীনা বলেন, তাদের তো এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই। ভারতের প্রয়োজন নেই। রাশিয়া বা চীন বা অন্য কারও সহায়তা প্রয়োজন নেই। আমি এটাকে সফিসটিকেটেড দেশ মনে করি। আপনার প্রশ্নের জবাবে বলি- যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে পারে এই প্রক্রিয়ায়। বাংলাদেশে অনেক ‘এলিমেন্ট’ আছে। আপনি জানেন, আমি জানি সেখানে পুনরেকত্রীকরণে আমরা সহায়তা করতে পারি। আমরা সেখানে গঠনমূলক সহায়তা করতে পারি। তা হতে পারে প্রশিক্ষণ, সমর্থন। সম্ভবত নিষেধাজ্ঞাও সহায়ক হতে পারে। ২০২১ সালে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
আমি তো মনে করি তাতে কতোগুলো জীবন রক্ষা করা গেছে। আমার দৃষ্টিতে এতে কিছু নিরপরাধ মানুষের জীবন রক্ষা হয়েছে। আমার শেষ কথা হলো যুক্তরাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক কোনো দেশ এই সমস্যার সমাধান করতে পারে না। বাংলাদেশের কাছেই আছে এর উত্তর। আমি আশা করি- বাংলাদেশের জনগণ যেভাবে সমস্যার সমাধান চায় তাতে সহায়তা করার চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতি নিয়েছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড্যান মজীনা বলেন, প্রতিটি দেশেরই কূটনৈতিক মিশন আছে, দূতাবাস আছে। এখন যেখান থেকে এই সাক্ষাৎকার দিচ্ছি এখান থেকে বাংলাদেশ দূতাবাস দূরে নয়। তারা একই কাজ করে। দুটি নয়, তিনটি নয়। তারা একটি কাজ করে। বাংলাদেশের স্বার্থ দেখে। যুক্তরাষ্ট্রও তাই করে। প্রতিটি দেশের সম্পর্ক আছে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রদূত কাজ করেন। সব দেশই এটা করে। এক্ষেত্রে মানবাধিকার এবং অর্থনৈতিক বিষয়টিও দেখা হয়। গণতন্ত্র দেখা হয়। নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয় দেখা হয়। আমি দীর্ঘ ক্যারিয়ারে শিখেছি এটাই আমার কাজ। এর ফল সুখকর নয়। ফল হ-য-ব-র-ল। বাইরে থেকে এটাকে অন্যভাবে দেখা হয়। এর মধ্যদিয়েই আমাদেরকে কাজ করতে হয় ভারসাম্য রক্ষা করে।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্য হিন্দুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নতুন নির্বাচন দাবি করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, আপনি বলেছেন ইউনূস বলেছেন নতুন নির্বাচন। এটা ভালো আইডিয়া হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। এ বিষয়ে আমার আইডিয়া নেই। আমি এটা নিয়ে রায় দিচ্ছি না। আমি এটা জনগণের কাছে ছেড়ে দিতে চাই, যারা আলোচনার মধ্যদিয়ে এটা ঠিক করতে পারেন। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এটা সহায়ক কিনা।
এ অঞ্চলে ভারত-চীনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি, জনগণের কল্যাণ এসবই তাদের উত্তম স্বার্থের বিষয়। কখনো কখনো এই ইন্টারেস্ট নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। এ সময়ে আপনাকে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। আমি মনে করি যুক্তরাষ্ট্র, চায়না, ভারত, রাশিয়া আমরা সবাই বাংলাদেশকে একটি পুরোপুরি অর্থপূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখতে চাই। এটা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, রাশিয়া সবার জন্যই মঙ্গলজনক।
তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে। কার সঙ্গে কাজ করতে চান। জবাবে মজীনা বলেন, আমি সবার সঙ্গেই কাজ করতে চাই।