Logo
Logo
×

সাক্ষাৎকার

‘চোখ-হাত বেঁধে পুলিশ আমাকে কবরস্থানে নিয়ে গেল, এরপর…’

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৪, ১২:৫৬ এএম

‘চোখ-হাত বেঁধে পুলিশ আমাকে কবরস্থানে নিয়ে গেল, এরপর…’

হঠাৎ থানার গারদের দরজায় একজন সিপাহী আসলো। আমার চোখ কালো পাড় দিয়ে বেঁধে দিল। দুই হাত পেছনের দিক দিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দিল। দুজন দুই পাশ থেকে আমাকে শক্ত করে ধরে হাটতে শুরু করলো। মনে হচ্ছিল আমাকে বাইরে নিয়ে যাচিছল। একটু হাঁটার পরই পুলিশের এক সদস্য বলল, ‘পা উপরে তোল, গাড়িতে ওঠ’। আমাকে সিটের মাঝখানে বসিয়ে দুই পাশে দুজন বসলো। মিনিট দশেক গাড়ি চললো। গাড়ি থেমে গেল, মানুষের কোলাহল টের পেলাম। আমার চোখ ও হাত বাঁধা। দুজন দুদিক দিয়ে শক্ত করে দুই বাহু ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে হাঁটাতে শুরু করলো। আমি টের পচ্ছিলাম, আমাকে কোথাও মাটির পথ ধরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একজন বললো, ‘তোকে শেষ করে দেব। অস্ত্র কোথায় বল’। আমি কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। এরপর তাদের বললাম, আপনাদের কোনো বাজে উদ্দেশ্য থাকলে বলেন, আমার বিধবা মা অসুস্থ, তার সঙ্গে আমাকে একটু কথা বলার সুযোগ করে দেন, শেষ বার আমি কথা বলতে চাই মায়ের সাথে। 

-কথাগুলো বলছিলেন পিরোজপুর জেলা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দিন তালুকদার কুমার। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন তিনি। 

১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট পিরোজপুর সদর উপজেলার ধুপপাশা তালুকদার বাড়িতে জন্ম সালাউদ্দিন তালুকদার কুমারের। বাবা মৃত নাসির আহম্মেদ তালুকদার এবং তাসলিমা বেগমের ৩ সন্তানের মধ্যে সবার বড় কুমার। জেলা যুবদলের সভাপতি থাকা অবস্থায় ১৯৯৭ সলে মারা যান বাবা নাসির আহম্মেদ তালুকদার। কুমার তখন মাত্র দ্বিতীয় শ্রেনীর ছাত্র। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হওয়ায় সেই শৈশবেই বাবার পথ ধরে হাটেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনৈতিক পথ ধরে। পিরোজপুর টাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে মাধ্যমিক, ২০১০ সালে পিরোজপুর সরকারী সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন কুমার। মাধ্যমিক পাস কারার আগেই ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হন সালাউদ্দিন তালুকদার কুমার। কলেজে পড়ার সময়ই রাজপথে মিছিল মিটিংয়ে অগ্রভাগে চলে আসেন কুমার। উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর পরই বৈরি রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে স্নাতক সম্পন্ন করাটা সহজ হয়নি তার। ২০১৮ সালে  জিয়া নগর কলেজ থেকে বিএ পাস কোর্স সম্পন্নের পর স্নাতকোত্তর আর সম্পন্নই করতে পারেননি তিনি। 

এরই মধ্যে ২০১১ সালে জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য পদ পান কুমার। ২০১৮ সালে হন জেলা ছাত্রদলের সংগঠনিক সম্পাদক। এখনো পর্যন্ত সেই পদে থেকেই রাজপথে জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে কুড়িয়েছেন সুনাম। ছোটবেলা থেকেই বৈরি রাজনৈতিক পরিবেশে এগিয়ে চলা সালাউদ্দিন তালুকদার কুমার বহুবার কারাবরণ করেছেন। হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৩ বার। বর্তমানে এই ছাত্রনেতার বিরুদ্ধে ৮টি রাজনৈতিক মামলা চলছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ২টি মামলা। আর উচ্চ আদালত থেকে স্থগিত করেছে ২টি মামলায়। বিএনপির অন্যতম সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের রাজনৈতিক পথ ধরে চলতে গিয়ে নানান সময়ের হামলা মামলা এবং নিপীড়নের বিষয়ে বাংলা আউটলুকের সাথে কথা বলেছেন সালাউদ্দিন তালুকদার কুমার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলা আউটলুকের ঢাকা প্রতিনিধি। 

বাংলা আউটলুক: ছাত্রদলের সাথে জড়ালেন কীভাবে? 

সালাউদ্দিন কুমার: আমার বাবা নাসির উদ্দিন আহম্মেদ বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্নেই জাগো ছাত্রদলের মহকুমা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। এর পর যুবদলের প্রতিষ্ঠাকালে জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সর্বশেষ জেলা যুবদলের নির্বাচিত সভাপতি হন। একই সময়ে তিনি যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক এবং জেলা বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। জন্মের পর থেকেই বাবার কোলে চড়ে রাজনীতির মাঠে প্রথম পা দেয়া। সেখান থেকেই আসলে আমার রক্তে জাতীয়তাবাদের বীজ বপণ হয়ে যায়। এর পর ১৯৯৭ সালে মাত্র ৬ বছর বয়সে বাবা মারা যান। একেবারে অল্প বয়সেই আমার ছোট এক ভাই এবং এক বোনসহ তিন সন্তানকে নিয়ে মা বিধবা হয়ে যান। সংসার চালাতে মাকে বহু প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে হয়েছে। পারিবারিকভাবেই আমরা পিরোজপুর শহরে মোটামুটি স্বচ্ছলই ছিলাম। সে কারণেই হয়তো, বাবার অনুপস্থিতি আমাদের তিন ভাই বোনকে টের পেতে দেননি মা। শক্ত হাতে হাল ধরে এগিয়ে চলেছেন সংসার নিয়ে। কখনো টের পেতে দেননি কতটা কষ্ট বুকে নিয়ে পথ পাড়ি দিয়েছেন আমার মা। বাবার আদর্শের সাথে কখনোই আপস করেননি তিনি। ফলে বাবার পথ ধরেই আমরা তিন ভাইবোনও এগিয়েছি। কখনোই বাধা হয়ে দাঁড়াননি আমার মা। একটু বড় হয়ে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দেয়ার পরই জেলার বিএনপিসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতাদের সান্নিধ্যে আমি চলে আসি। স্কুলে পড়ার সময়ই আমি ছাত্রদলের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। 

বাংলা আউটলুক: রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন কীভাবে? 

সালাউদ্দিন কুমার: স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে, যখন কলেজে যাই; তখনই মূলত রাজপথে আরো সক্রিয় হয়ে যাই। এক-এগারোর সময়ে রাজনৈতিক কারণেই মূলত এক বছর আমার শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে যায়। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে বহু রাত বাড়িতে ঘুমাতে পারিনি সেই ছোটবেলায়ই। ২০১০ সালের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে, কলেজে নিয়মিত ক্লাস করতে পারতাম না। ছাত্রলীগ, পুলিশ এদের সাথে প্রায়ই গণ্ডগোল বাঁধতো। সেই সময়ে একধরনের হিরোইজম কাজ করতো। রক্তের মধ্যে আরো শক্তভাবে গেঁথে যায় জাতীয়তাবাদী আদর্শ। এভাবেই এগিয়ে চলছি। 

বাংলা আউটলুক: মামলা হামলার মুখে পড়েছেন কতবার? 

সালাউদ্দিন কুমার: বহুবার। ছোট ছোট মামলা হয়েছে কতবার সে হিসেব কখনো করা হয়নি। একটা সময় বয়স কম বলে মামলার আসামী করতো না পুলিশ। কিন্তু গত ১০ বছরে পিারোজপুরে যতগুলো রাজনৈতিক মামলা হয়েছে সবগুলোতেই আসামী করেছে। পুলিশকে টাকা দিয়ে কোনোটা দিয়ে নাম কাটিয়েছি। আবার কোনোটি এমনি এমনিই পুলিশ ফাইনাল রিপোর্টে নাম রাখেনি। কিন্তু এর বাইরেও এখন ৮টি মামলা চলছে। এসব মামলায় এ পর্যন্ত কারাবরণ করেছি ৬ বার। 

বাংলা আউটলুক:  হামলার শিকার হয়েছেন কতবার?  

সালাউদ্দিন কুমার: বেশ কয়েক বার। ২০১৯ সালে পিরোজপুর জজ কোর্ট এলাকার আমিব্য়া হাসপাতালের সামনে ছাত্রলীগ আমার ওপর হামলা করেছিল। মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। ২০২২ সালে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে দুই দিক থেকে আটকে পুলিশ ও ছাত্রলীগ হামলা করেছে। সেইবারও বেশ আহত হয়েছিলাম। ২০১৮ সালে ১৭ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপর্সনের কোর্টে হাজিরার দিন ঢাকার হাইকোর্টের সামনে পুলিশের হামলার শিকার হই। ওই দিন গ্রেফতারও হই। আমাকে রমনা থানার দুটি মামলায় ৭৬ দিন জেলা খাটতে হয়েছে। ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর গায়েবী মামলায় আটক হয়ে ১ মাস ১৯ দিন কারাগারে থাকতে হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর উল্লেখ করার মতো; এবং সাম্প্রতিক। ওই দিন আমি পিরোজপুর জেলা নেতৃবৃন্দের সাথে কাকরাইল মোড় এলাকায় ছিলাম। হঠাৎই দুপুর দেড়টার দিকে কাকরাইল মোড় এলাকায় পুলিশ আমাদের ওপর টিআর শেল ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। টিয়ার শেলে আমাদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমিও রাস্তায় পড়ে যাই। আমার ওপর পুলিশ শটগানের গুলি চালায়। আমার মাথা এবং শারীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। গ্রেফতার এড়াতে সেখান থেকে সন্ধ্যার পর বিজয়নগর কালভার্ট রোডের এক আইনজীবীর চেম্বারে রাত কাটাই। পরদিন বিকেলে পিরোজপুরে চলে যাই। 

বাংলা আউটলুক: পিরোজপুরে গিয়ে কি দলের কর্মসূচি পালন করেছেন? 

সালাউদ্দিন কুমার: হ্যাঁ। পিরোজপুরে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্যই ছিলো হরতাল কর্মসূচি পালন করা। গিয়েই ১ নভেম্বর থেকে সহকর্মীদের সাথে নিয়ে দিনে এবং রাতে ধারাবাহিক কর্মসূচি শুরু করি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে পড়ে যাই; এবং টার্গেটে পরিণত হই। গ্রেফতার এড়াতে বাড়িতে থাকছি না। আবার শহরেও প্রকাশ্যে উঠতে পারছি না। ফলে এক ধরনের ফেরারী জীবন যাপন শুরু করি। বাগানে বাগানেই থাকতে হয়েছিল। এভাবেই মোটামুটি ফ্যাসিস্ট সরকারের স্থানীয় নেতাদের এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এক ধরনের চাপের মধ্যে ফেলে দেই। হঠাৎই ৪ নভেম্বর রাতে আমাকে ধরে ফেলে ডিবি। 

বাংলা আউটলুক: কীভাবে ধরলো? 

সালাউদ্দিন কুমার: ২৮ নভেম্বরের পরদিন থেকেই পুলিশ আমার বাড়িতে গিয়ে মা, ছোটবোনকে ধমকায়। ভয়ে আমার ছোটভাইও বাড়িতে থাকতে পারছিল না। আমি পিরোজপুরে গিয়েছি, এটা পুলিশ টের পায়নি। কিন্তু কর্মসূচি পালন করার সময় ওরা আমাকে দেখে ফেলে। আমাকে ফলো করা শুরু করে। এসময় আমার হাতে সরাসরি কোনো মোবাইল ফোন ছিল না। ফলে ট্র্যক করে পচ্ছিল না। কিন্তু ডিবির টিম ওঁৎ পেতে ছিল, নানান জায়গায়। ৪ নভেম্বর রাতে পিরোজপুর শহরতলীর উত্তর কৃষ্ণনগর এলাকায় একটি কলাবাগানে বসে আমার দুই সহকর্মীর সাথে কর্মসূচি নিয়ে কথা বলছিলাম। রাত তখন ১২টা বা এর একটু বেশি হবে। পাশেই একটি পারিবারিক কবরস্থান। এমন সময় ডিবির অন্তত ২৫ জনের একটি টিম আমাদের ঘিরে ফেলে। আমরা টের পাইনি। এ সময় আমার সাথের দুই জন দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু আমাকে ধরে ফেলে ডিবি। 

বাংলা আউটলুক: ধরে কোথায় নিয়ে গেল? 

সালাউদ্দিন কুমার: ধরেই আমার দুই হাতে পেছন দিক দিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। চোখ বেঁধে ফেলে। কোনো কথা নেই। কয়েক জন মিলে আমাকে কিল ঘুষি মারতে শুরু করে। এলাপাথাড়ি আঘাত। অন্তত ১৫ মিনিটের মতো ওখানেই মাটিতে ফেলে মারে আমাকে। বুকে পিঠে এলাপাথাড়ি লাথি দেয় তারা। শীতের মধ্যে আঘাতে আমি প্রচণ্ড ব্যথা পাই। শরীরের বিভিন্ন স্থান ফুলে যায়। এর পর আমাকে ধরে নিয়ে হাঁটা শুরু করে। হাঁটিয়েই ওরা আমাকে জেলা ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে চোখ খুলে দেয়। আমাকে প্রশ্ন করে “ তোর কাছে অস্ত্র আছে, সেই অস্ত্র কোথায়?”। আমি বলি আমার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। আমি অস্ত্রের রাজনীতি করি না। আমার দলও কোনো সন্ত্রাসী দল না। এর পর দেখলাম কোনো এক উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে জানানো হলো, আমাকে তিনি সদর থানায় হস্তান্তর করার নির্দেশ দিলেন। 

বাংলা আউটলুক:  এর পর কি থানায় দেয়া হলো? 

সালাউদ্দিন কুমার: হ্যাঁ। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমাকে গাড়িতে তুলে সদর থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে নিয়েই আমাকে সোজা থানা হাজতে দিয়ে দেয়া হলো। থানার গারদে গিয়ে দেখলাম, আগে থেকেই জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য মনিরুল ইসলাম এবং জেলা ছাত্রদলের সহ-দপ্তর সম্পাদক আবু নাহিদকে আটক করে সেখানে রাখা হয়েছে। 

বাংলা আউটলুক:  এর পর কিছু বলেনি?

সালাউদ্দিন কুমার: থানায় নেয়ার ঘন্টা খানেক পর পুলিশের একজন সিপাহী গারদের দরজায় এসে আমাকে ডাকলেন। দরজা খুলে আমাকে বাইরে বের করে, প্রথমেই কালো কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধলেন। দুই হাত পেছনের দিক দিয়ে হাতকড়া পরালেন। আমি জুতা পরতে চাইলে, আমাকে জুতা পরতে দেয়া হয়নি। দুই বাহু ধরে দুজন আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। সম্ভবত ওসি তদন্তের কক্ষে নিয়েছিলেন বলে মনে হয়েছে। একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোদের পরিকল্পনা কী? আমার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের নাম ধরে গলি দিতে দিতে বললেন, “তারেক রহমান যে টাকা দিয়েছে, সেই টাকা কোথায়, অস্ত্র কোথায়?” এছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সনকে নিয়েও অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিলেন সেই অফিসার। আমি বললাম, “আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই, আর কোনো অস্ত্রও নেই। সাথে সাথে মোটা একটি লাঠি দিয়ে আমার দুই হাতের বাহুতে, পায়ে পেটাতে শুরু করলো। অন্তত মিনিট দশেক আমাকে পিটিয়েছে সেই কর্মকর্তা। আমার হাত, পা ফুলে গেছিল। সবকিছু অবস হয়ে গেছিল। এর পর আবারো আমাকে গারদে নিয়ে গেল দুজন দু’হাত ধরে। আমি কিছুই দেখাতে পেলাম না। আমাকে কোনো খাবার বা পানি দেয়া হলো না। বাইরে থেকেও কোনো খাবার দিতে দিল না। গারদে অপর দুই দলীয় সহকর্মীর পানি এবং খাবার ভাগ করে খেয়েছি। 

বাংলা আউটলুক:  রাতে আর কিছু বলেনি বা পরের দিন কী করলো? 

সালাউদ্দিন কুমার: রাতে আর আমাকে কিছু বলেনি। পরদিন সকালে আবারো আমাকে সেই কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। একই ভাবে চোখ, হাত বেঁধে। খালি পায়ে। আমাকে সেই অফিসার জিজ্ঞাসা করলো, “ কেন বিএনপি করিস? অস্ত্র কোথায়? বাঁচতে চাইলে স্বীকার কর। তোকে কিন্তু মেরেই ফেলবো।” আমি তার কথামতো প্রশ্নের জবাব না দেয়ায় আমাকে একটি চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেললো। আমার দুই পায়ে মোটা লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করলো। ব্যথায় আমি চিৎকার দিতে চাইলাম। আমাকে বললো, নড়াচড়া করলে, পা ভেঙ্গে যাবে। চিৎকার দিলে বেশি মারবে। তাই দাঁতে দাঁত লাড়িয়ে ব্যথায় গোঙাচ্ছিলাম। পায়ের বুট দিয়ে আমার দুই হাটুতে লাথি মারতে থাকে। অন্তত ১০ মিনিট এমন নির্যাতন চালিয়ে ফের আমাকে গারদে পাঠিয়ে দিল। আমি পানি চেয়েছিলাম, দেয়নি। প্রচণ্ড ক্ষুধায় শরীর চলছিল না। দুপুরের পর গারদের অপর দুই জনকে আদালতে পাঠিয়ে দেয়। আমাকে রেখে দেয়। ফাকা গারদে আমাকে চোখ, হাত এবং পা বেঁধে। উপুর করে শুইয়ে রাখে ঘন্টাখানেক। বলে, “এটাই তোর শাস্তি”। বিকেলের দিকে একজন এসে আমাকে পা খুলে দিয়ে বলে, “তুই স্বীকার করবি না? চল তোকে স্বীকার করাই। এই বলে আবারো সেই অফিসারের কক্ষে নিয়ে গেল।

বাংলা আউটলুক:  এবার নিয়ে কী করলো? 

সালাউদ্দিন কুমার: অন্য কক্ষে নিয়ে হাতকড়া খুলে হাটুর নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেয়। এর পর ওসি আবির আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, “তুই কেন বিএনপি করিস?” এই বলেই শক্ত মোটা লাঠি দিয়ে আমাকে পেটাতে শুরু করে। টানা ১০ মিনিট পেটায়। আমার চোখ বাঁধা থাকায় আমি কিছু দেখতে পাইনি। কণ্ঠ শুনে মনে হয়েছে ওটা ওসি আবিরই ছিল। বুট দিয়ে আমার বুকের ওপর বেশ কয়েকটা লাথি মারে। আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। পানি পানি বলে চিৎকার দিলাম। ওসি আবির বললো, “প্রস্রাব করে খা, পানি পাবি না”। কিছুক্ষণ পর আমাকে আবারো থানার গারদে পাঠিয়ে দেয়। আমি অনেকটা অচেতন হয়ে থানার মেঝেতে পড়ে রইলাম। 

বাংলা আউটলুক:  চিকিৎসা দেয়নি? এর পর কী হলো?

সালাউদ্দিন কুমার: না। কোনো চিকিৎসা দেয়নি। খাবার কিংবা পানিও দেয়নি। আমি থানার মেঝেতে শুয়ে রইলাম। রাত তখন আনুমানিক ১০টা হবে। দুজন সিপাহী আসলেন গারদের গেটে। আমাকে ডেকে তুললেন। আমার শরীরে কোনো শক্তিই ছিলো না। শরীরের ওপর জোর করেই উঠলাম। আমাকে বাইরে বের করা হলো। আবারো চোখ হাত সেভাবেই বেঁধে দিল। এবার আমাকে ওরাই জুতা পরতে বললো। আমি জুতা পরে নিলাম। দুজন দুদিক দিয়ে আমাকে ধরে হাটতে শুরু করলো। টের পেলাম, আমাকে নিয়ে থানার বাইরে বের করেছে। আমাকে বললো, পা উপরে তোল, গাড়িতে ওঠ। আমি উঠলাম। শীতের রাত। মফস্বল শহরে বেশ ঠাণ্ডা। আমি বললাম, “আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”। ওরা চুপচাপ। কেনো কথা বললো না। কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর গাড়ি থামলো। অনেক মানুষের কোলাহল টের পেলাম। ধীরে ধীরে আমাকে ধরে হাঁটালো। আমি বুঝতে পারছিলাম, কোনো মাটির পথ ধরে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমি বললাম, “আপনাদের কী কোনো বাজে পরিকল্পনা আছে আমাকে নিয়ে? তাহলে আমাকে মায়ের সাথে একটু কথা বলার সুযোগ দেন, আমার বিধবা মা অনেক অসুস্থ”। ওরা কোনো কথা বললো না। ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে আমাকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। পায়ে লতাপাতা জড়িয়ে যাচ্ছিল। এবার থামলো ওরা। আমার চোখ খুলে দিল। আমি দেখলাম অন্তত ৫০ জন পুলিশ সদস্য। অনেকে সাদা পোশাকে। অধিকাংশ পোশাক পরিহিত। আমি দেখলাম, “ওরা আমাকে আমাদের পুরনো বাড়ির কবরস্থানে নিয়ে এসেছে”। এরপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “কোথায় অস্ত্র রেখেছিস বল?”। আমি বললাম আমার কাছে কোনো অস্ত্র নেই। একটু সামনে এগিয়ে নিয়ে একটি পুরনো কলাপাতা দেখিয়ে আমাকে বললো, “এ পাতাটা সরা”। আমি না সরালে, ওরাই সরিয়ে দিয়ে একটি হলুদ প্যকেট দেখিয়ে বললো,  “এটা খোল”। আমি অস্বিকৃতী জানালে ওরাই খুললো। ভেতর থেকে একটি রিভলবার বা পিস্তল বের করে আমাকে ধরিয়ে দিতে চাইলো, বললো, “এটা কী, তোর কাছে না কি অস্ত্র নেই?” আমি ধরলাম না। এর পর একটি ব্রিফকেসের ওপর সেই রিভলবার বা পিস্তল রেখে আমাকে ব্রিফকেস ধরিয়ে দিয়ে ছবি তুললো। 

বাংলা আউটলুক:  এর পর ? 

সালাউদ্দিন কুমার: এর পর আমাকে আবারো সদর থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেই রাতে আর আমাকে কিছুই বললো না। সকালে আমাকে আদালতে পাঠালো। তিন দিনের রিমান্ড আবেদন করলো। আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলো। তবে রিমান্ডের এই তিন দিনে আমাকে আর মারেনি। তবে, আমাকে রিমান্ড শুনানি বা আদালতে প্রথম যে দিন তোলা হয়, কোনো বারই আদালত আমাকে দেখতে চায়নি।

বাংলা আউটলুক:  কতদিন জেলে ছিলেন? 

সালাউদ্দিন কুমার: ৪ মাস ৩দিন পর ৬ মার্চ আমি কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হই। কারাগারে নেয়ার পরেও কোনো চিকিৎসা দেয়নি। সেই ব্যাথা শরীরে নিয়েই আমাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে আবারো রাজপথেই সক্রিয় আছি। 

বাংলা আউটলুক:  এর পরও কেন রাজনীতির সাথে?     

সালাউদ্দিন কুমার: রাজনীতির মধ্যেই আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা আর এগিয়ে চলা। জাতীয়তাবাদ আমার বাবার কাছে থেকে উত্তরাধিকার প্রাপ্ত আমি। আমাকেই তো জাতীয়তাবাদের এই ঝান্ডা বয়ে নিয়ে যেতে হবে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন জাতীয়তাবাদী আদর্শ আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশপ্রেমের হাত ধরেই আমি এগিয়ে যেতে চাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। 

বাংলা আউটলুক: আপনাকে ধন্যবাদ।

সালাউদ্দিন কুমার: বাংলা আউটলুককেও ধন্যবাদ।      

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন