Logo
Logo
×

নির্বাচন ২০২৪

ভোট,রাজনীতি এবং কূটনীতি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

Icon

প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০১:৫০ এএম

ভোট,রাজনীতি এবং কূটনীতি: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বাংলাদেশে একটি সাধারণ নির্বাচন শেষ হয়েছে। এর মাধ্যমে পঞ্চম দফায় ক্ষমতার মসনদে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার দল আওয়ামী লীগ সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২২৩ টি আসন নিশ্চিত করেছে। ঢাকা আশা করছে ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে ধারাবাহিক নির্বাচনী বিজয়ের পর তার টানা চতুর্থ মেয়াদ শুরু হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে ধারাবাহিকতা থাকবে। ঢাকা তার অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিদেশী বিনিয়োগ এবং উন্নয়নমূলক সহযোগিতার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সাম্প্রতিক এ নির্বাচনটি ঢাকার এ প্রত্যাশাকে জটিল করে তুলতে পারে। শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) বাংলাদেশের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী প্রেক্ষাপট নিয়ে অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (ওআরএফ) গবেষক সোনিহী বোসের লেখা নিবন্ধ বাংলা আউটলুকের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।  

বাংলাদেশ এবং তার কৌশলগত অংশিদারিত্ব 

বঙ্গোপসাগরের তীরে এবং ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের মিলনস্থলের কাছাকাছি অবস্থিত বাংলাদেশ ভূ-কৌশলগতভাবে ইন্দো-প্যাসিফিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এর অবস্থান এটিকে গুরুত্বপূর্ণ শিপিং লেন তত্ত্বাবধান করতে দেয়। যার মাধ্যমে তেল আমদানি উপসাগরীয় দেশগুলি থেকে বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগর হয়ে পূর্ব এশিয়ায় পাঠানো হয়। বাংলাদেশ এ অঞ্চলে একটি শাক্তিশালী অবস্থান তৈরি করার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি ও জনসংখ্যার বিচারেও বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ।  

বঙ্গোপসাগরে ঢাকার অব্যবহৃত হাইড্রোকার্বন রিজার্ভ জ্বালানি সহযোগিতায় সম্ভাব্য মিত্র হিসেবে এর যোগ্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি, সস্তা শ্রমমূল্য, কঠোর পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণের অভাব এবং উন্নয়নমূলক অংশীদারিত্বের প্রচারে আগ্রহী সরকার একটি আকর্ষণীয় বিনিয়োগ গন্তব্য হিসাবে এর সম্ভাবনাকে আরো  বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইন্দো-প্যাসিফিকের প্রধান শক্তিগুলির মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), চীন, ভারত এবং জাপান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বাণিজ্য সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ এবং উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সহায়তা সহ এর বৈদেশিক আয়ের সব খাতে সবচেয়ে বড় অবদানকারী। মজার বিষয় হল, ফোর্বসের মতে, এই চারটি দেশ ২০২৪ সালে তাদের জিডিপির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে রয়েছে৷ চীনের জন্য বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদস্থল এবং এর ফ্ল্যাগশিপ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

শ্রীলঙ্কা ভারতের দীর্ঘদিনের সহযাত্রী। তবে সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ তার ‘ইস্ট এশিয়া মৌলড বা পূর্ব এশিয়ার ছাঁচ' থেকে বেরিয়ে ভারত মহাসাগরে তার সামুদ্রিক উপস্থিতি জোরদার করার জন্য চীনের সেরা বিকল্প। এর বাইরে দক্ষিণ এশিয়ার মতো বাংলাদেশও চীনা পণ্যের একটি বিশাল বাজার। সেই সূত্রে চীনও বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার।

এ অঞ্চলে চীনের উত্থানের ফলে ভূ-রাজনৈতিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ঢাকার গুরুত্ব বেড়েছে। এটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওয়াশিংটনের অন্যতম প্রধান অংশীদার। অপরদিকে তৈরি পোশাকের কারনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধান গন্তব্য। 

এদিকে জাপানের কাছেও বাংলাদেশের গুরুত্ব রয়েছে। জাপানের বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে এবং তাদের বাজারে প্রবেশাধিকার লাভ করতে পারে। বিপরীতভাবে জাপানও বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগি। 

এই দেশগুলো বিপরীতে যারা বাংলাদেশকে কৌশলগত মিত্র হিসাবে বিবেচনা করে তাদের মধ্যে ভারতের জন্য ঢাকা একটি 'প্রাকৃতিক অংশীদার'। ভৌগলিকভাবে এটি ভারতের স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বে একটি সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার। ভারত তাই 'অ্যাক্ট ইস্ট' এবং 'নেইবারহুড ফার্স্ট' নীতিগুলি প্রচার করতে বাংলাদেশকে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশের জন্য ভারত তার তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং নেপাল ও ভুটানের সাথে সংযোগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট অঞ্চল। ধীরে ধীরে অস্ট্রেলিয়াও উন্নয়নমূলক সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে তার অংশীদারিত্ব জোরদার করার চেষ্টা করছে। কারণ তারা উত্তর-পূর্ব ভারত মহাসাগরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখাকে জাতীয় স্বার্থ বলে মনে করে। এসব কারনে ওই দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

রাজনৈতিক পক্ষ ও ভারসাম্যের কূটনীতিতে গুরুত্ব 

উপরোক্ত গুরুত্ব বিবেচনায় এই শক্তিগুলি ঢাকাকে রাজনৈতিক পক্ষ নেওয়ার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন তাদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতার কারণে বাংলাদেশ এই দেশগুলির সাথে তার মিথস্ক্রিয়ায় ভারসাম্যের কূটনীতি গড়ে তুলেছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক, ঢাকার অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং রাজনৈতিক অ-সংলিপ্ততার প্রমাণের বাইরে এই কূটনৈতিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। যদিও আউটলুকের ইউএস-এর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির মতো একই রকম পরিভাষা এবং অগ্রাধিকার রয়েছে এটি বেইজিংকে কোনওভাবে বিক্ষুব্ধ না করার জন্যও সতর্ক রয়েছে কারণ পরবর্তীটি ইন্দো-প্যাসিফিককে তার প্রভাব ধারণ করার জন্য একটি আমেরিকান চক্রান্ত বলে মনে করে। 

যাইহোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সাথে সাদৃশ্যের কারণে বেইজিংয়ের সাথে ঢাকার ক্রমবর্ধমান সারিবদ্ধতার বিষয়ে উদ্বেগের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে শান্ত করার জন্য আউটলুক প্রকাশকে প্রায়শই ঢাকার কৌশলগত কৌশল হিসাবে বোঝানো হয়েছে। 
এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে সমর্থন করতে বা ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফোরাম বা কোয়াডের (বেইজিং এটিকে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার চীন-বিরোধী গ্রুপিং বলে মনে করে) এর মতো উদ্যোগে অংশ নিয়েছে।  

গত কয়েক বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সরকারের উপর আরও প্রভাব বিস্তারের জন্য ঢাকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে। ২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র্যা পিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সাতজন প্রাক্তন এবং বর্তমান উচ্চ-স্তরের কর্মকর্তার উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের পরিবারসহ কথিত অপহরণের শিকার পরিবারের সাথে দেখা করেছেন। 

বাইডেন প্রশাসনও বাংলাদেশকে তার গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো থেকে বিরত ছিল এবং ১২ তম সাধারণ নির্বাচনের আগে সর্বশেষ পদক্ষেপে বাংলাদেশী ব্যক্তিদের মার্কিন ভিসা প্রদানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে ক্ষুন্ন করার সন্দেহ করেছিল। প্রাথমিক সম্মতি সত্ত্বেও হাসিনা শীঘ্রই গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার পরিচালনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে শাস্তি দেন। ফলস্বরূপ বর্তমান ইউএস-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে একটি স্পষ্ট ঘর্ষণ রয়েছে। 

উল্লেখ্য, করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় বাংলাদেশে ভ্যাকসিন সরবরাহের পরপরই চীন কোয়াডে যোগদানের বিরুদ্ধে দেশটিকে সতর্ক করার সুযোগ নিয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানো এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার যে পরামর্শ সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দিতে চীন দেরি করে। 

পররাষ্ট্র নীতিতে নির্বাচন পরবর্তী চ্যালেঞ্জের মূল্যায়ন 

শেখ হাসিনা সরকার গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পেরেছে। যে কারনে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শক্তিধর দেশগুলো শেখ হাসিনার ক্ষমতারোহনের পক্ষে ছিলেন। যে কারনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপকে উপেক্ষা করে তারা বলে আসছিলো নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতও হাসিনা সরকারের উপর খুব বেশি চাপ না দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করেছিল। শেখ হাসিনা পরাজিত হলে এখানে মৌলবাদী শক্তিগুলির উত্থানের পাশাপাশি এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে বলেও বাইডেন প্রশাসনের কাছে দিল্লি বার্তা পাঠায়। 

ফলে ঢাকার সঙ্গে পূর্বের দেশগুলোর সম্পর্ক জোরদার হবে এমনটি আশা নিশ্চিত হওয়া গেলেও ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক মধুর হবে সেটি বলা যায় না। কেননা নির্বাচনের পর ওয়াশিংটন ঢাকাকে কড়া বার্তা দিয়েছে। ওই নির্বাচনকে তারা অনিয়মের পরিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। 

যদিও হাসিনা সরকার এখনো যুক্তরাষ্ট্রের এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থান ঢাকাকে বেইজিংয়ের দিকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে ঝোঁকার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে বলেও মনে করা হচ্ছে। তবে ঢাকার সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্কের মাখামাখি হলে সেটি দিল্লির জন্য নিশ্চয়ই স্বস্তির কারণ হবে না।

 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন