গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয় : একটি সাজানো নির্বাচন আর গণতন্ত্রের হারের দিন
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৩৯ এএম
বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনা একইসঙ্গে খারাপ ও ভালো সময় নিয়ে এসেছেন। তার অধীনে গেল ১৫ বছরে বাংলাদেশের দারিদ্র্যতার হার কমে অর্ধেকে নেমেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৩০০ শতাংশের বেশি। তবে এসব অর্জন ঢাকা পড়ছে তার একদলীয় শাসনে। তিনি বাংলাদেশকে অনেকটা একদলীয় রাষ্ট্র হিসেবে কায়েম করেছেন।
গত বছরে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির মধ্যে সরকারবিরোধী একটি আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। গত বছরের নভেম্বরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সতর্ক করে বলেছিল, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের জেলে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি হত্যাও করা হচ্ছে। এর সবকিছুর কারণ ছিল নির্বাচন, যেটি গত রবিবার (৭ জানুয়ারি) হয়ে গেল।
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধীদল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ওই নির্বাচন বর্জন করেছে। ফলে অনুমিতভাবেই শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে।
এই নির্বাচনকে অর্থহীন বলা যায়, কারণ ভোটের হার ছিল মাত্র ৪০ শতাংশ। এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ ছিল না বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। যদিও শেখ হাসিনার মিত্র হিসেবে পরিচিত ভারত ও চীন নির্বাচনের তার দলের জয়কে স্বাগত জানিয়েছে।
১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশ দীর্ঘদিনের সামরিক শাসন থেকে মুক্ত হয়। দেশে তখন সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশটির তৈরি পোশাক খাত বেশ উন্নতি করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেশি এবং নারীদের কর্মসংস্থানের দিক থেকেও বাংলাদেশ এগিয়ে। স্বাধীনতার মূল্যবোধ সামনে রেখে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়েছিল দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অসুস্থ অবস্থায় গৃহবন্দী হয়ে আছেন। তার সহযোগীদের হয় জেলে বা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। তার আগে তিনিও কারাগারে ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন প্রথাগত রাজনীতি চর্চার বাইরে বাংলাদেশকে একটি একদলীয় শাসনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেটিকে অনেকে বাংলাদেশের সাফল্যের পেছনে কারণ হিসাবে দেখছেন। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়, গৃহবিবাদ, দুর্ভিক্ষের মতো প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে। এমন একটি দেশে মূলত ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের জন্য কাজটা করেছে বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও)। তারা রাজনীতিবিদদের চেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশেই বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্যাকের প্রতিষ্ঠা। ব্র্যাক এখন বিশ্বব্যাপী তার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ব্র্যাকের বার্ষিক আয় ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শাস্তি দিয়েছে। এটি করা হয়েছে ঠিক নির্বাচনের আগে।
গত বছরে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দণ্ড দেওয়া হতে পারে—এই আশঙ্কায় ১০০ জনেরও বেশি নোবেল পুরস্কারজয়ীসহ ১৭৫ জন বিশ্বনেতা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি লেখেন। এদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও।
ওই বিশ্বনেতারা বাংলাদেশে “বিচার বিভাগীয় হয়রানি” বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিচারকাজ সঠিকভাবে পরিচালনা করা হলে ড. ইউনূস খালাস পাবেন বলেও জানান তারা।
তবে ৮৩ বছর বয়সী ড. ইউনূস আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চক্ষুশুল ছিলেন। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “ড. ইউনূস গরিবের রক্ত চুষে খায়”। অথচ, ড. ইউনূস লাখো মানুষকে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার মাধ্যমে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছিলেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রে যা খুশি তাই করার সুযোগ থাকে না। তবে শেখ হাসিনা সেটিই করে যাচ্ছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হয়। যাতে করে কাউকে রাজপথে নামতে না হয়, সরকারের জবাবদিহিতা বজায় থাকে। শেখ হাসিনার বর্তমানে ৭৬ বছর পার করছেন। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়ার বয়স ৭৮। এখন বাংলাদেশ যেদিকে যাচ্ছে সেটি মোটেই সুখকর না, এভাবে চলতে থাকলে কঠিন মূল্য দিতে হবে-এই বিষয়টি দুইজনকেই উপলব্ধি করতে হবে।
দেশে যে মতপ্রকাশ কিংবা বিরোধীমতের ওপর ভয়ের সংস্কৃতি সরকার তৈরি করেছে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিরোধীরা যাতে গঠনমূলক সমালোচনা করার সুযোগ পায় সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। রাজনৈতিক বিষয়গুলো শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে হবে। মোটাকথা হলো- দীর্ঘমেয়াদী গণতান্ত্রিক শাসনের পরিবর্তে স্বৈরাচার শাসনকে প্রাধান্য দেওয়া বোকামি ছাড়া কিছু নয়।