যোগসাজশের মাধ্যমে ডলার ও কাঁচামালের আমদানি খরচ বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে বোতলজাত পানির দাম বাড়িয়েছে দেশের নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলো। এরই মাধ্যমে আধা লিটারের বোতলজাত পানির দাম বাড়িয়ে তারা ৪২০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা করছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের (বিসিসি) অনুসন্ধানে এর প্রমাণ মিলেছে।
প্রতিযোগিতা কমিশন এ অপরাধে প্রভাবশালী ৭ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। কমিশনের সদস্য মো. হাফিজুর রহমান কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ঢাকা ওয়াসাসহ মোট ৮ কোম্পানির উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ করা হয় অনুসন্ধান পর্যায়ে। এরমধ্যে ওয়াসা ছাড়া বাকি ৭টি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিযোগিতামূলকভাবে দাম নির্ধারণ না করে পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২ এর ধারা ১৫(১), ১৫(২)(ক)(অ) ও ১৫(২)(খ) লঙ্ঘন করেছে কোম্পানিগুলো।
কোম্পানিগুলো হলো, কোকাকোলা বাংলাদেশ বেভারেজ লিমিটেড, ট্রান্সকম বেভারেজ, মেঘনা বেভারেজ, পারটেক্স বেভারেজ, রূপসী ফুডস (সিটি গ্রুপ), আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ এবং প্রাণ বেভারেজ লিমিটেড।
মো. হাফিজুর রহমান বলেন, অনুসন্ধান দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা যোগসাজশ করে পানির দাম বাড়িয়েছে। তারা সবাই এক সঙ্গে আধা লিটার বোতলজাত পানির দাম ২০ টাকা করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রেতাদের কাছে আধা লিটার পানির বোতল ১০ টাকায় দিচ্ছে আর বিক্রেতারা খুচরা বিক্রি করছেন ডাবল দাম ২০ টাকায়। এতে প্রতি বোতলে তাদের ১০ টাকা লাভ হচ্ছে। যেসব উৎপাদনকারী কম দামে বিক্রি করতে চাচ্ছে এদের কারণে তারা বাজারে টিকতে পারছে না।
কমিশনের বোতলজাত পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বোতলজাত পানির উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রথম সারির (মার্কেট শেয়ারের ভিত্তিতে) কোম্পানিগুলো ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে হঠাৎ করে আধা লিটার পানির বোতলের দাম ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা নির্ধারণ করে। এই দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার ও কাঁচামালের কারণে বেড়ে যাওয়া আমদানি খরচকে দায়ী করে। তবে কোম্পানিগুলোর উৎপাদন খরচ বিশ্লেষণ করে কমিশন দেখতে পায়, নামমাত্র উৎপাদন খরচ বাড়লেও দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে মূলত কোম্পানিভেদে মুনাফা বাড়ানো হয়েছে ৭১.২৩ শতাংশ থেকে ৪২০ শতাংশ পর্যন্ত। প্রফিট মার্জিন বেড়েছে ডিস্ট্রিবিউটর ও খুচরা বিক্রেতার।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ট্রান্সকম এবং সিটি গ্রুপ ছাড়া বাকি ৫টি কোম্পানি। তবে ট্রান্সকম এবং সিটি গ্রুপের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। চলতি মাসের ১৮ তারিখে মামলার শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
এ বিষয়ে পারটেক্স গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. নাহিদ ইউসুফ বলেন, শুনানিতে নিজেদের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করবেন।
কমিশনের তথ্যমতে, স্পা ব্র্যান্ড নামের অধীনে আধা লিটার পানির দাম ৫ টাকা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৪২০ শতাংশ মুনাফা করেছে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। প্রতিষ্ঠানের ১৮.৩৩ শতাংশ উৎপাদন খরচ ও ভ্যাট-ট্যাক্স এর কারণে ৩১.৭৮ শতাংশ খরচ হলেও কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪২০ শতাংশ। দাম বৃদ্ধির আগের আকিজের আধা লিটার পানি বিক্রি করে খুচরা বিক্রেতা পেতেন ৫.৬২ টাকা, তবে দাম বৃদ্ধির পর সেটি ৯ টাকা হয়েছে।
কমিশন বলছে, কোকাকোলার কিনলে ব্র্যান্ডেড ৫০০ মি.লি. বোতলজাত পানির উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১.৬২৪ টাকা। এটি শতকরা হিসেবে ২৭.৬৭ শতাংশ এবং ভ্যাট-ট্যাক্স ও সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি ৩৩.৮৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে ৫ টাকা মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে কোম্পানি তাদের মুনাফা বাড়িয়েছে ২১১.৬২ শতাংশ। এতে ডিস্ট্রিবিউটর পর্যায়ে মুনাফা বেড়েছে ৩০.১৩ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে ২৬.৯৮ শতাংশ।
এদিকে কিনলের আধা লিটারের একটি পানির বোতল ১৫ টাকা বিক্রি করে খুচরা বিক্রেতা আগে ৬.৬৭ টাকা মুনাফা করতেন, এখন সেটির দাম ৫ টাকা বাড়ানোর পর মুনাফা করছেন ৮.৪৭ টাকা।
একইভাবে, ট্রান্সকম বেভারেজের মুনাফা ৭১.২৩ শতাংশ এবং মেঘনা বেভারেজ লিমিটেডের মুনাফা ১৭৭.৭৮ শতাংশ বেড়েছে বলে উঠে এসেছে কমিশনের তদন্তে।
কমিশনের পর্যবেক্ষণ বলছে, সিটি গ্রুপ অপর্যাপ্ত তথ্য দেওয়ায় ও প্রাণ কোনো প্রকার তথ্য সরবরাহ না করায় তাদের মুনাফার পরিমাণ বিশ্লেষণ করা যায়নি। শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠান, পারটেক্স বেভারেজ দাম বাড়িয়ে ডিস্ট্রিবিউটর ও খুচরা বিক্রেতাদের কমিশন বাড়ালেও কোম্পানির মুনাফা বাড়ায়নি।
কমিশনের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার শান্তি ব্র্যান্ডের পনির উৎপাদন খরচ বাড়েনি এবং তারা প্রতিষ্ঠানের, ডিস্ট্রিবিউটর এবং খুচরা বিক্রেতার কমিশনও বাড়য়ানি। এতে করে অবশ্য প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায় ধাক্কাও খাচ্ছে। ১৫ টাকায় পানি বিক্রি করে লাভ কম হওয়ায় তাদের পানি খুচরা বিক্রেতারা দোকানে রাখতে চান না বলে জানা গেছে।