টাকা তোলার চাপ, এক ব্যাংক ছুটছে আরেক ব্যাংকের কাছে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৪, ০১:৫৫ এএম
ঈদুল আজহা উপলক্ষে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তোলার চাপ বাড়ছে। গ্রাহকদের এই বাড়তি চাহিদা মেটাতে অনেক ব্যাংকই হিমশিম খাচ্ছে। আন্তঃব্যাংকেও চাহিদানুযায়ী অর্থ মিলছে না। তাই এক ব্যাংক ছুটছে আরেক ব্যাংকের কাছে। এতে চড়ছে আন্তঃব্যাংক কলমানি ও শর্ট নোটিশে ধারের সুদের হার।
একদিনের ব্যবধানে গতকাল কলমানিতে গড় সুদের হার বেড়েছে দশমিক ৪ শতাংশ। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে শর্ট নোটিশে সুদের হারও ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আন্তঃব্যাংকের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও অর্থ ধার বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, নিয়মিত কর্মদিবসের তুলনায় আজ বৃহস্পতিবার লেনদেন ৩০ শতাংশ বেড়েছে। আগামী সোমবার (১৭ জুন) মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন করা হবে।
সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হাসানুর রহমান বলেন, মূলত টাকা উত্তোলনের জন্য ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকের ঢল নেমেছে। নগদ টাকা তোলার চাপে সেবা দিতে কর্মকর্তারা হিমশিম খাওয়ায় বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে গ্রাহকদের।
রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা, পল্টন, মগবাজার, ফার্মগেট, গুলশাসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের ভিড় প্রত্যক্ষ করা হয়েছে। সকাল থেকেই ব্যাংকের শাখাগুলোর ক্যাশ ও ডিপোজিট কাউন্টারের সামনে গ্রাহকদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। নতুন টাকা গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন চালান, জমা ও অন্যান্য সার্ভিস বিল জমা দেওয়ার লাইনও লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে বাড়তি গ্রাহকের চাপে বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে হয়েছে ব্যাংকগুলোর ক্যাশ কাউন্টার কর্মকর্তাদের।
ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার ব্যবস্থাপক কাজী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঈদের আগে শেষ কর্মদিবসে সব সময়ই ভিড় লেগেই থাকে। মানুষ গ্রামে গিয়ে ঈদ উদযাপন করবে, কোরবানির পশু কিনবে, তাই টাকা তুলে নিচ্ছে। আবার কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য নগদ অর্থ উত্তোলন করছে গ্রাহকরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ঈদের আগে শেষ কর্মদিবসে সাধারণত ১ কোটি ৩০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা লেনদেন হয়। ‘এ বছরও ঈদুল আজহার আগেও একই পরিমাণ অর্থ লেনদেন হবে, এ ধরনের নগদ উত্তোলনের চাপ সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংককে নগদ তারল্য সহায়তা দিচ্ছে।’
ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ ও রপ্তানি বিল কেনার জন্য ব্যাংকগুলো খোলা থাকবে। এছাড়া রাজধানীর পশুর হাট এলাকায় রাত ১০টা পর্যন্ত ব্যাংক খোলা থাকবে।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট বহুদিন ধরে চলছে। সম্প্রতি আরও প্রকট হয়েছে। এর মূলে রয়েছে ব্যাংকগুলোর ডলার ক্রয়ের বিপরীতে নগদ অর্থ ভল্টে চলে যাওয়া, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার বৃদ্ধি, একীভূতকরণ আতঙ্ক ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নগদ টাকা তুলে নেওয়ার চাপ, নতুন আমানত আসা কমে যাওয়া, বিতরণ করা ঋণ যথাসময়ে ফেরত না আসা ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া সংকোচনমুখী মুদ্রানীতিতে বাজারে মুদ্রার সরবরাহ কমে তারল্য সংকট আরও প্রবল হয়েছে।
সংকটের সময় এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে, আবার ব্যাংক থেকে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাময়িক সময়ের জন্য টাকা ধার নেয়। সাধারণত এক দিনের জন্য এই ধার দেওয়া-নেওয়া হয়। এই কার্যক্রম যে ব্যবস্থায় সম্পন্ন হয় তা আন্তঃব্যাংক কলমানি বাজার নামে পরিচিত। এর বাইরে শর্ট নোটিশে এক দিনের বেশি সময়ের জন্যও ব্যাংকগুলো নিজেদের মধ্যে অর্থ লেনদেন করে থাকে।
প্রতি বছর ঈদের আগে ব্যাংকগুলোতে নগদ লেনদেনের চাপ বাড়ে কয়েকগুণ। কোরবানির ঈদের কারণে গতকাল বুধবার বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা ও এটিএম বুথে নগদ টাকা তুলতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। আজ বৃহস্পতিবার শেষ ব্যাংকিং কার্যদিবস। ফলে অন্যদিনের তুলনায় আজও ব্যাংকের শাখা এটিএম বুথগুলোতে বাড়তি ভিড় হবে। এতে আন্তঃব্যাংকে লেনদেন ও সুদের হার আরও চড়ার আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ঈদের আগে নগদ টাকা তোলার চাপ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ব্যাংকের বাইরে (কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক) টাকা বেড়ে গেছে। বর্তমানে অন্তত ১৫-১৬ শতাংশ অর্থ ব্যাংকের বাইরে রয়েছে। মানুষ ব্যাংকের পরিবর্তে হাতে টাকা বেশি রাখছে। এটা ভালো সংকেত নয়। এই অর্থ ব্যাংকে থাকলে ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতি ভালো থাকত। তখন টাকা তোলার চাপ বাড়লেও সমস্যা হতো না। কী কারণে কারেন্সি আউটসাইড বেড়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেকেই অনেক কথা বলছে। কেউ বলছে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোনো গ্রাহককে ব্যাংক কখনো বলেনি যে, আপনি টাকা নিয়েন না আমরা দিতে পারব না। আরেকটা বিষয় হলো- উচ্চ মূল্যস্ফীতি। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ায় সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন অনেকেই। এর বাইরে ব্ল্যাক ও ক্যাশ টাকার লেনদেনও হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গতকাল আন্তঃব্যাংক কলমানিতে লেনদেন হয়েছে ৪ হাজার ১২২ কোটি টাকা। এ দিন গড় সুদহার ওঠে ৯.৩৯ শতাংশ। আগের দিন মঙ্গলবার লেনদেন হয়েছিল ৪ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। আর সুদের হার ছিল ৯.৩৫ শতাংশ। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ৫ জুন থেকে এই বাজারে টানা গড় সুদের হার বাড়ছে। গত ৪ জুন গড় সুদের হার ছিল ৮.৯৭ শতাংশ। এরপরের কার্যদিবসে বেড়ে হয় ৮.৯৮ শতাংশ। গত ৬ জুন তা ৯ শতাংশে ওঠে। ৭ জুন সুদ বেড়ে হয় ৯.০৯ শতাংশ। এরপর ৮ জুন ৯.২৪ শতাংশ, ১১ জুন ৯.৩৫ শতাংশ এবং গতকাল ১২ জুন ৯.৩৯ শতাংশে ওঠে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক বছর ধরেই ঈদের আগে কলমানি সুদের হার মোটামুটি স্বাভাবিক থাকছে। এবারও সুদের হার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের মধ্যে থাকবে।