বাংলাদেশের বিলিয়নিয়ররা কোথায়
সম্পদের বিস্ফোরণ ও চরম বৈষম্য
গুলশানের একটি রেস্তোরার ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে অত্যাধুনিক বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অভিজাত গুলশান ক্লাব বরাবর তাকালে একটি ১৪ তলা ভবন দেখা যায়, যার নির্মাণকাজ শেষের দিকে। কমলা রঙের হেলমেট ও নিয়ন হারনেস বেল্ট পরা নির্মাণশ্রমিকরা শেষ প্রলেপ দিচ্ছেন। ভবনটির অলংকৃত সম্মুখভাগ চকচক করছে।
থ্রি নামে পরিচিত এই বিল্ডিংটি অভিজাত বাংলাদেশি রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার বিটিআই নির্মাণ করছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং।
ভবনের ১২টি অ্যাপার্টমেন্ট, প্রতিটি ৭০০০ বর্গফুটের বেশি। বায়োমেট্রিক সুরক্ষা ব্যবস্থাসহ সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। আছে এআই-ভিত্তিক আলো।
নির্মাণ শুরু হওয়ার আগেই সমস্ত অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ২০২১ সাল পর্যন্ত একেকটি ফ্ল্যাটের দাম ২০ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল। কিন্তু পরে আর্থিক মন্দায় সেই দাম ১৮ কোটিতে নেমে এসেছে।
যেহেতু বিটিআই চেয়ারম্যান ফয়জুর রহমান খানও বিল্ডিংটিতে একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। তিনি অন্য ফ্ল্যাটগুলো ঢালাওভাবে বিক্রি না করে ক্রেতাদের আবেদন বিশেষভাবে যাচাই করেন। ৫০টিরও বেশি আবেদন থেকে অন্য ক্রেতাদের বাছাই করেন তিনি। অর্থাৎ দেশে ১৮ কোটি টাকায় ফ্ল্যাট কেনার মানুষ আরো আছে।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান নিষ্পত্তিযোগ্য আয় অজানা নয়। জনাকীর্ণ শপিং মল, যেমন যমুনা ফিউচার পার্ক যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম, প্যাকেজ করা খাবার থেকে শুরু করে গাড়ি ও স্মার্টফোন পর্যন্ত সমস্ত কিছুর বিজ্ঞাপন দেওয়া নতুন বিলবোর্ডগুলি তার প্রমাণ।
কিন্তু এই বিটিআই ভবন, সম্ভবত অন্য কিছুর চেয়েও বেশি, বাংলাদেশের ধনীদের ক্রমবর্ধমান সম্পদের কথা বলে। তাদের সংখ্যা দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে মুষ্টিমেয়।
বাংলাদেশের বিলিয়নিয়র বিভ্রান্তি
বাংলাদেশের ধনী ১০ শতাংশ মানুষ এখন দেশের মোট সম্পদের ৪১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে যা, তারা বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি, পোশাক, গয়না, বিদেশি দামি খাবার ও অন্যান্য খাতে ব্যয় করে।
অক্সফামের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষ গত দুই বছরে প্রায় দ্বিগুণ সম্পদ সংগ্রহ করেছে।
২০২০ সাল থেকে বিলিয়নিয়রদের (১০০ কোটি ডলার বা ১২ হাজার কোটি টাকা) সম্পদ আকাশচুম্বী হয়েছে। সারা বিশ্বে ১ শতাংশ মানুষ মহামারি ও আর্থিক মন্দার মধ্যে মানুষের সংকটের সময় বিস্ময়করভাবে ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার (৬৩ শতাংশ) সংগ্রহ করেছে, সেখানে অন্য ৯৯ শতাংশ মানুষ সংগ্রহ করেছে মাত্র ১৬ ট্রিলিয়ন (৩৭ শতাংশ)।
আপত্তিজনক হলো, বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়া সত্ত্বেও, ওই সময় পর্যন্ত ফোর্বসের বার্ষিক বিশ্ব বিলিয়নিয়রদের তালিকায় কোনো বাংলাদেশি ছিল না।
বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, যিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাণিজ্যের মাধ্যমে ভাগ্য গড়েছেন, তিনিই প্রথম বাংলাদেশি যিনি ফোর্বসের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন।
প্রেক্ষাপটে বলতে গেলে, বাংলাদেশের চেয়ে ১০০ গুণ কম জিডিপির দেশ আফ্রিকায় একজন বিলিয়নিয়র রয়েছেন। তিনি হলেন এসওয়াতিনি।
তদুপরি, কমপক্ষে একজন করে বিলিয়নিয়র রয়েছেন বিশ্বের ৭৬টি দেশে। এই ৭৬ দেশের মধ্যে ৪০টির অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে ছোট।
উদাহরণস্বরূপ, চিলির অর্থনীতি বাংলাদেশের ৭৮ শতাংশের সমান। সেখানে রয়েছেন সাতজন বিলিয়নিয়র। একইভাবে, সাইপ্রাসে চারজন বিলিয়নিয়র রয়েছেন, যদিও তাদের অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির ১৫ ভাগের ১ ভাগ।
সাংবাদিক শেখ রাফি আহমেদ, যিনি বাংলাদেশের বিলিয়নিয়রদের বিষয়ে প্রতিবেদন করেছেন। বাংলাদেশের সেই বিলিয়নিয়রদের ‘নিখোঁজ’ বলে অভিহিত করেছেন শেখ রাফি। তিনি দাবি বলছেন, অনেক বিলিয়নিয়র বাংলাদেশে আসলেই আছে, কিন্তু অফশোর অ্যাকাউন্ট এবং রিয়েল এস্টেটে তারা তাদের সম্পদ লুকিয়ে রেখেছেন। এই ধরনের অনুশীলনের জন্য প্যান্ডোরা পেপারসে তালিকাভুক্ত ১১ বাংলাদেশির দিকে ইঙ্গিত করেছেন শেখ রাফি। রাফি মনে করেন, পাচার ও কর ফাঁকি বাংলাদেশে ব্যক্তিগত সম্পদের সঠিক হিসাবকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
‘এ কারণেই সম্ভবত বাংলাদেশি বিলিয়নিয়রদের অনুপস্থিত দেখা যাচ্ছে,’ বলছেন শেখ রাফি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) নাজনীন আহমেদ বলেন, আমদানি-রপ্তানির সময় অতিরিক্ত ও কম-ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে মূলধন পাচারের হার উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশ থেকে সম্পদ পাচারের মাত্রা এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে, ২০১৭ সালের একটি গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি রিপোর্ট ‘অবৈধ আর্থিক প্রবাহের’ জন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়।
নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশে গোপন কোটিপতি আছে, কিন্তু তারা এখানে তাদের টাকা রাখে না।’
(আল-জাজিরা থেকে ভাষান্তরিত)