খাদ্যপণ্যে কোম্পানিগুলোর ‘মোড়ক ফাঁদ ‘, ঠকছে ক্রেতা

কয়েক বছর আগে বাজারে খোলা (৫০ কোজি বস্তার) চাল-আটা-ময়দা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সবরাহ ছিল পর্যাপ্ত। সংকট ছিল না। সেগুলো বস্তা খুলে কেজি কেজি করে বিক্রি করা হতো। তবে সম্প্রতি আশ্চর্যজনকভাবে বদলে গেছে দেশের বাজার ব্যবস্থা। বাজারে এখন আর আগের মতো খোলা খাদ্যপণ্য পাওয়া যায় না। এখন সেই একই পণ্য পাওয়া যাচ্ছে বড় বড় কোম্পানিগুলোর চটকদার মোড়কে। যেখানে ৫০ কোজি বস্তার আটা কেজি করে বিক্রি হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকায়। আর একই মানের দুই কেজি প্যাকেটের আটা দাম ১০০-১১০ টাকা। কেজি পড়ছে ৫০ টাকা করে। এতে ঠকছে ক্রেতারা। দ্বিগুন মূনাফা করছে কোম্পানিগুলো।
বিক্রেতারা বলছেন, খোলা আগের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়া যায় না। তাই দামে চড়া হলেও কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
গতকাল রোববার রাতে রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে নিত্যপণ্যের দাম দরের খোঁজখবর নিয়েছে বাংলা আউটলুক। বিশেষ করে চাল ও আটার বাজারে প্যাকেট ও খোলা পণ্যের দামের পার্থক্য দেখতে চেয়েছে আউটলুক। তাতে দেখা গেছে, চাল ও আটার বাজারে বসুন্ধরা, তীর, ইফাদ, সানশাইন, আকিজ, পুষ্টি প্রায় শতাধিক কোম্পানি মোড়কজাত পণ্য বিক্রি করছে। এসব কোম্পানি ১ কেজি, ২ কেজি ও পাঁচ কেজির প্যাকেট আটা পাওয়া যাচ্ছে। তবে ১ এবং ৫ কেজিও প্যাকেট সচরাচর নয়। প্রায় সবই ২ কেজির প্যাকেট। ২ কেজির আটা পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। তবে তীর আটা বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা।
আর মহল্লার দোকানে সেটি বিক্রি হচ্ছে প্রতি প্যাকেটে ১০ টাকা বেশি করে। তবে একই আটা খোলাটা বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৪০ টাকা। সাধারণ পলিব্যাগে প্যাকেট করা এসব আটা ও কোম্পানির প্যাকেটজাত আটার মধ্যে গুণগত কোনো পার্থক্য নেই বলে জানালেন বিক্রেতারা।
খিলগাঁও পাইকারি বাজারের দোকানি ফয়সাল আহমেদ বলেন, মানুষ এখন ব্রান্ডের জিনিস বেশি পছন্দ করে। তাই টাকা বেশি হলেও কিনে। তবে কোম্পানির আটার সঙ্গে সাধারণ প্যাকেট করা আটার কোনো পার্থক্য দেখি না। কোম্পানিগুলো তো আর গম চাষ করে না। তারাও তোম গম আমদানি করে কিংবা দেশ থেকে কেনে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোলা আটা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকায়। একই আটা প্যাকেটজাতের পর কিনতে হয় ৫৫-৬০ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি কেজি আটায় দামের পার্থক্য হচ্ছে ২০ টাকা। খুচরা বিক্রেতারাও বলছেন, প্যাকেটজাত আটায় কোম্পানিগুলো অস্বাভাবিক মুনাফা করছে।
খিলগাঁওয়ের ব্যবসায়ী জামাল খান জানান, নারায়ণগঞ্জের মিলের খোলা আটা বিক্রি করছেন প্রতি কেজি ২৮-৩০ টাকা দরে; আর নামি কোম্পানির আটা ৩৫-৩৮ টাকায়। অথচ একই আটা প্যাকেটজাত হিসেবে বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়।
রোববার রাত ১০টার দিকে খিলগাঁও বাজারে কেনাকাটা করছিলে মধ্য বয়সী এক দম্পতি। অন্যান্য জিনিসপত্রের পাশাপাশি একটি নামি কোম্পানির ২ কেজির দুই প্যাকেট আটাও কেনন তারা। তারা জানান, প্যাকেটের পণ্য এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাম বেশি তারপরও বিভিন্ন কারণে এসব কথিত ব্রান্ডের পণ্য কিনতে হয়।
এদিকে চালের বাজারেও লক্ষ্য করা গেছে কোম্পানিগুলোর থাবা। এক্ষেত্রেও বসুন্ধরা, পুষ্টি, আকিজসহ অন্যান্য বড় বড় কোম্পানিগুলো এগিয়ে রয়েছে। খুচরা বাজারে চালের দামের সঙ্গেও তফাৎ দেখা গেছে প্যাকেট বদ্ধ চালে। যদিও বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে অসংখ্য কোম্পানির চাল থাকায় সেগুলোই বাজারে খোলা হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। তবে ভালো ও বড় কোম্পানিগুলো ২৫ কেজির বস্তা খুলে বিক্রি করছে না।
খিলগাঁওয়ের সাত্তার বাণিজ্যালয়ের ম্যানেজার তামিম হোসেন জানান, তীর কোম্পানির সম্পাকাটারি নাজির ২৫ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১৭৫০ টাকা। এই চাল যারা খুচরা করে বিক্রি করে তারা প্রতি কেজির দাম রাখছেন ৭৫ টাকা করে। প্রতি কেজিতে খুচরা ব্যবসায়ীরা ৫ টাকা মুনাফা করছেন। এটি অনেক বেশি বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে প্যাকেটজাত পণ্যে ভোক্তা সাধারণকে হয়রানি হচ্ছে বিষয়টি স্বীকার করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটি বলছে, এটি কোম্পানিগুলোর নতুন কৌশল। এর মাধ্যমে তারা ভোক্তার মনে প্রভাব বিস্তার করে তথা কথিত ব্রান্ডমুখী করে তুলছে।
সংগঠনের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো আটা-ময়দা ও চালের দাম নির্ধারণ করছে। সুরক্ষার দোহাই দিয়ে তারা অতি মুনাফা করছে। এটি রোধে নিয়ন্ত্রণ করার ওপর জোর দেন তিনি।