Logo
Logo
×

অর্থনীতি

গ্রাহকের ওপর বোঝা না চাপিয়ে বিদ্যুৎখাত কি ঠিক হবে?

Icon

আবু জাকির

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৪, ০৭:০৮ পিএম

গ্রাহকের ওপর বোঝা না চাপিয়ে বিদ্যুৎখাত কি ঠিক হবে?

প্রতীকী ছবি

জ্বালানি খাতে ভুর্তুকি তুলে নেওয়ার সরকারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে, চলতি বছরে বিদ্যুতের মূল্য কয়েকবার বাড়ার পাশাপাশি আগামী বছরও বাড়বে। আর এই ভুর্তুকি বাতিলের পরিকল্পনা নিতে হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে। 

গত মার্চে দাম নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার স্বাভাবিকতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে এক নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার। ওই সময় পাইকারি পর্যায়ে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম বাড়ে ৫ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ে ৩ শতাংশ। 

বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি) তাদের ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে এই মূল্য বৃদ্ধির পেছনে যুক্তি হিসেবে, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচের তুলনায় বিক্রয় মূল্যের পার্থক্যের কথা তুলে ধরেছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিপিডিবি প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে ৪ দশমিক ৬৩ টাকা লোকসান দেয়। কারণ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় ১১ দশমিক ৩৩ টাকা। কিন্তু বিক্রয় হয় ৬ দশমিক ৭ টাকা। খরচের এই অসামঞ্জস্যতার কারণে গত অর্থ বছরে বিপিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকায়। ওই প্রতিবেদনে অবশ্য উল্লেখ করা হয়েছে, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক উৎস থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের কারণে এই লোকসান হয়। 

মার্চের ওই মূল্যবৃদ্ধি কেবল শুরু। কারণ চলতি বছরে আরও তিনবার বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করা হবে বলে ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে। এই খবরটি অনেক নাগরিকের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা। বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। 

মার্চে মুল্যস্ফীতি গিয়ে ঠেকেছে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশে। ফলে ভোক্তারা ইতোমধ্যে বর্ধিত এই মূল্যস্ফীতি জনিত আর্থিক সংকট নিয়ে ভুগছেন। তাই নির্দিষ্ট আয়ের অনেক পরিবারের জন্যই বিদ্যুতের এই মূল্যবৃদ্ধি মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আসবে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এপ্রিলের মূল্যস্ফীতির তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি। তবে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনাগুলো আগামী মাসগুলিতে দাম আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। যা বাংলাদেশি জনগণের উপর বাড়তি আর্থিক চাপ তৈরি করবে। 

মূল্যবৃদ্ধি টোটকা সমাধান হবে

সরকার মনে করছে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি প্রাথমিকভাবে ভর্তুকি কমাবে। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আরও দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগের তাগিদ দিয়েছেন। তারা সর্তক করছেন, শুধু মূল্যবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করা হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য স্বস্তি দেবে, কিন্তু তাতে ভুগতে থাকা বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতের মূল সমস্যাতে দৃষ্টি পড়বে না। 

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এসএম শামসুল আলম বাংলা আউটলুককে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের গুরুতর সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে চাপাচাপি করে জনগণের টাকা ও সম্পদ নিতে মূল্যবৃদ্ধি সাময়িক সময়ের বা টোটকা সমাধান হবে। 

সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানির বোর্ড সদস্যদের উচ্চ বেতন এবং নেতিবাচক বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির সমালোচনা করে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে অন্যায্য এবং অনিয়ন্ত্রিত ব্যয় হচ্ছে।

তার মতে, ভোক্তাদের ওপর মূল্য বৃদ্ধির এই বোঝা চাপানোর আগে এই আর্থিক অব্যবস্থাপনাগুলো ঠিক করতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, এই খাতের দীর্ঘমেয়াদী টেকসই নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে ক্যাপাসিটি চার্জের সঙ্গে যুক্ত উচ্চ ব্যয় মোকাবিলা করা এবং বিদ্যুতের একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার গড়ে তুলতে হবে।  

দেশের বিদ্যুৎ খাতের আর্থিক অবস্থার উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছে বিপিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের কাছ থেকে উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের ওপর নির্ভরশীলতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। যা বিপিডিবির বাজেটে চাপ তৈরি করে এবং মূল্য বৃদ্ধিতে প্ররোচিত করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি কোম্পানি থেকে বিদ্যুৎে কিনতে বছরে ৮২ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা খরচ করে বিপিডিবি। সেখানে সংস্থাটির নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ১৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকার। বেসরকারি উৎপাদকদের উপর এই অত্যধিক নির্ভরতা খরচকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলে। কারণ বেসরকারি উৎস থেকে কেনা বিদ্যুতের গড় খরচ পড়ে প্রতি ইউনিটে ১৪ দশমিক ৬২ টাকা। যেখানে বিপিডিবির নিজস্ব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ৭ দশমিক ৬৩টাকার প্রায় দ্বিগুণ।

প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিভিন্ন উৎসের খরচের তারতম্যের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়। সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন সবচেয়ে সাশ্রয়ী, প্রতি ইউনিটে ৬ দশমিক ৮৫ টাকা খরচ হয়। তারপরে আছে ভারত থেকে ৮ দশমিক ৭৭ টাকায় আমদানি করা বিদ্যুৎ। সচেয়ে বেশি পড়ে ভাড়া করা বিদ্যুকেন্দ্রগুলোতে। সেখান ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের মূল্য পড়ে প্রতি ইউনিট ১২ দশমিক ৫৩ টাকা। 

বিদ্যুতের বর্ধিত মূল্য সাধারণ ভোক্তাদের ওপর মারাত্মকভাবে চাপ সৃষ্টি করবে। কিন্তু বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির এই পরিকল্পনার পেছনে মূল কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জে সরকারের উচ্চ ব্যয় এবং রাজস্ব বাড়ানোর অসুবিধার দিকে ইঙ্গিত করেছেন।  

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তৈরির জন্য সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। তার মতে, এই অতিরিক্ত সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি যেগুলে অলস পড়ে থাকে সেগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় উচ্চ ভর্তুকির বড় একটি অংশই এই ক্যাপাসিটি চার্জ। 

গোলাম রহমান বলেন, আইএমএফের উচিত এই দিকগুলোতে জোর দেওয়া। ভোক্তাদের ওপর অন্যায়ভাবে এই বোঝা তৈরি করা মূল্য বৃদ্ধির সমর্থন না করে আইএমএফের উচিত, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে এবং এই খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো। 

হিতে বিপরীত হবে মূল্যবৃদ্ধি?

সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক সেমিনারে অর্থনীতিবিদ খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম একটি সমীক্ষা তুলে ধরেন। সমীক্ষায় তিনি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নীতিগত পার্থক্যের চিত্র তুলে ধরেন। 

ওই সমীক্ষায় দেখা যায়, সব বিরোধী দল ক্যাপাসিটি চার্জ বাদ দেওয়ার পক্ষে। কারণ এটি এমন এক ব্যবস্থা যা বিদ্যুৎ ব্যবহার করুক বা না করুক সরকারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ খরচ করতে হয়। তিনি উল্লেখ করেন, ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার বিষয়ে কোনো পদক্ষেপের উল্লেখ নেই।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সামগ্রিক খরচ কমাতে ভাড়ায় চালিত ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানান মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, যথাযথ ব্যবস্থা নিলে বিদ্যুতের দাম আসলে কমানো সম্ভব। সরকারের অযথা ব্যয় মেটাতে দাম বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বার বার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দিক থেকে হিতে বিপরীত হবে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা ক্রমবর্ধমান খরচ এবং বিদেশি প্রতিযোগিতার সঙ্গে লড়ছে। এখন এই মূল্য বৃদ্ধি তাদের প্রফিট মার্জিন আরও কমার আশঙ্কা তৈরি করছে। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

ড. ইজাজ বলেন, বিদ্যুৎ বিল বেশি মানে পরিবারগুলোর আয় থেকে অন্যখাতের খরচের অংশ কমাবে। আবার ভোক্তারা কম ব্যয় করলে ব্যবসায়ীদের বিক্রয় কমতে পারে, যা তাদের চ্যালেঞ্জগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

তিনি বলেন, এসবের সম্মিলিত প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে গুরুতরভাবে খারাপ করে তুলতে পারে, যা সম্ভাব্য সামগ্রিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন