আর্থিক গোলযোগের মধ্যেই ৭৫০ কোটি টাকা চায় পিপলস লিজিং
দেশের আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অনস্থার সমার্থক যেন বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং লিমিটেড। অসংখ্য গ্রাহকর অর্থ আত্মসাৎকারী প্রায় ২২ বছরের পুরাতন এই প্রতিষ্ঠান এখন প্রায় পথে বসতে চলছে। এবার সেই প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কর্তৃপক্ষ নতুন করে কার্যক্রম শুরু করতে সরকারের কাছে ফের ৭৫০ কোটি টাকার সহায়তা চেয়েছে।
১৯৯৭ সালে মাত্র ৫০ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা হয়েছিল। বিপত্তি শুরু প্রায় ১০ বছর আগে পিপলস লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদ বদল হওয়ার পর থেকেই। পর্ষদ বদলের মাত্র তিন বছরে মধ্যে নামে বেনামে লুট হয় ২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ যোগসাজসে এ অর্থ আত্মসাৎ হয়। অভিযোগ আছে দুর্নীতিগ্রস্ত সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরীও প্রতিষ্ঠানটি থেকে বড় ধরনের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত। ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণ ৬৬ শতাংশে উঠে যায়, পরে ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়নি গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ।
পিপলস লিজিংয়ের অর্থ কেলেঙ্কারির মূল হোতা প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার। বর্তমানে তিনি ভারতের কারাগারে আছেন। এর আগে তার নামে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি হয়। অভিযোগ রয়েছে, এই পি কে হালদারই আর্থিক এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৩৫০০ কোটি টাকা সরিয়ে ভারত এবং কানাডায় নিয়ে গেছেন। তবে বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য প্রকাশ করার পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী নয় সরকার।
এদিকে গুরুতর আর্থিক কলেঙ্কোরি কারণে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া পিপলস লিজিং নতুন কার্যক্রম শুরু করতে সরকারের কাছে ৭৫০ কোটি টাকার সহায়তা চেয়েছে। পিপলস লিজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাগির হোসেন খান অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহের কাছে এ সহায়তা চেয়েছেন।
এক চিঠিতে বলা হয়, জনস্বার্থে পিপলস লিজিং সচল এবং লাভজনক করতে সরকারের কাছে চাওয়া আর্থিক সাহায্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির কাজে আসবে এবং প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক হবে। ২০১৪ সালের পর থেকে কোম্পানির ঋণের টাকা আদায় না হওয়ায় এই কোম্পানির ক্ষতি পরিমাণ বাড়ছে।
এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে কোম্পানিটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মেমোরেন্ডামে কোম্পানির কাঠামোগত সংস্কারের জন্য সরকারের আর্থিক সহায়তা নেওয়ার কথা বলা আছে। পিপলস লিজিং দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনার আওতায় সরকারের কাছে এ তহবিল চেয়েছে।
অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভারতের কারাগারে থাকা পি কে হালদারসহ অর্থ আত্মসাৎকারী সবাইকে অতিসত্তর গ্রেপ্তারের নিদের্শনাসহ কর্তৃপক্ষকে বিদেশ থেকে অর্থ ফিরিয়ে আনতে বার বলা হয়েছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আর এর পেছনে মূল কারণ হলো পি কে হালদার ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে স্বীকার করেছেন এস আলম বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাবটি পাস করিয়ে নেওয়ার সময় ক্ষমতা বলয়ের শীর্ষে থাকা এক ব্যক্তিকে ১৫০০ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে পি কে হালদার নিজে এই লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদেশ পাচার হওয়া অর্থ এবং গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার পর পিপলস লিজিং লিমিটেড সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা চাইতে পারতেন। তখন এ বিষয় নিয়ে বিবেচনা করা একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতো।
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এ দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি বোঝা বড় কঠিন। কোনো উপরের মহল থেকে কোনো সিগন্যাল পেয়েই পিপলস লিজিং সরকারের কাছে এ অর্থ চেয়েছে। হয়তো এ অর্থ পেয়েও যেতে পারে ।
অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবতে থাকা পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের জন্য ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিনই মামলার শুনানি শেষে অবসায়নের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয় আদালত।
আমানতকারীদের আন্দোলনের মুখে যদিও ২০২১ সালের জুন মাসে শুরু হওয়া পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয় এবং কোম্পানিটি পুনরুজ্জীবিত করতে ১০ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয় উচ্চ আদালত।
সেই সঙ্গে আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাসহ পর্ষদের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানকে একগুচ্ছ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পিপলস লিজিংয়ের বর্তমান কর্তৃপক্ষ ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্ষন্ত ১৫০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করেছে এবং ৫০ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। বর্তমানে ৫০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে ।
প্রসঙ্গত: বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিংকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করার অনুমোদন দেয় ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর। এরপর থেকে গ্রাহকের কাছ থেকে মেয়াদি আমানত ও বিভিন্ন ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার করে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল এ কোম্পানি।