Logo
Logo
×

অর্থনীতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের একত্রীকরণের নির্দেশ মানতে চায় না পরিচালনা পর্ষদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৪, ০৩:৪১ এএম

বাংলাদেশ ব্যাংকের একত্রীকরণের নির্দেশ মানতে চায় না পরিচালনা পর্ষদ

রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের লোগো

বেসরকারি ব্যাংকের মতো এবার সরকারি বিশেয়ায়িত ব্যাংক রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) সঙ্গে একত্রীকরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশে আগ্রহ দেখাছে না। ব্যাংকটির পর্ষদ বাংলাদেশ ব্যাংকর একত্রীকরণের নিদের্শনার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পূর্বানুমোদন চায়।

মার্চ মাসের ২ তারিখ রাকাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক( এমডি) নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে  চিঠি দিয়ে জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক কথায় রাকাব এবং বিকেবি একত্রীকরণ আলোচনা শুরু করতে চান না। চিঠিতে রাকাবের এমডি এই দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের একত্রীকরণের বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিভাগের পূর্বানুমোদন কামনা করছেন।  

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, দেশের সরকারি ও বেসরকারি পাঁচ ব্যাংক একীভূত করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি কাউকে না জানিয়েই ব্যাংকগুলোর একত্রীকরণের সিদ্বান্ত নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এটা শুধু মার্জার নয়। এখানে সাধারণ ব্যাংকারদের ক্যারিয়ার এবং জীবন যাপনের বিষয়টি চলে আসে। সাধারণ ব্যাংকারদের চাকরি হারানোসহ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সৃত্র জানিয়েছে, ব্যাংক পাড়া ও দেশের র্অথনীতিতে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করেছে ‘মার্জার ইফেক্ট’। ব্যাংকের আমানতকারী ও গ্রাহকরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। মার্জারের ঘোষণা আসার পর গত কিছুদিনে আমানত তুলে নেওয়ার হিড়িকে অস্বাভাবিকভাবে পুঁজি কমেছে অন্তত ২০টি ব্যাংকের। সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি আমানত তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা।

রাকাবের এমডির আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, গত ১৭ এপিল এ বিষয়ে রাকাবের বোর্ড মিটিং ডাকা হয়েছিল। এই বোর্ড সভায় জানানো হয় ১৬ এপ্রিল রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের উদ্যোগে রাজশাহী শহরে রাকাবের সঙ্গে বিকেবির মার্জার না করার জন্য বড় মানববন্ধন হয়েছে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, রাকাব বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের ৩৮৩টি শাখার মধ্যে ৮৭ শতাংশ অর্থাৎ ৩৩৩টি শাখা ইউনিয়ন বা গ্রামভিত্তিক। মার্জারের ফলে রাকাবের এসব শাখার মাধ্যমে যে বিকেন্দ্রীভূতভাবে সেবা পাওয়া যায় তা প্রদান বিলম্বিত হতে পারে। যার ফলে দেশের খাদ্য ভান্ডার খ্যাত কৃষি নির্ভর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হওয়াসহ দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও ব্যাহত হতে পারে।

বিভোক্ষকারীদের দাবি, এটাকে যেন অন্য ব্যাংকের সঙ্গে মার্জার করা না হয়। এই বিভোক্ষকারীরা রাকাবের পর্ষদ সভায় রাকাব  ও বিকেবি একত্রীকরণ বিষয়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক পরামর্শসহ ও রাকাবের সক্ষমতা ও সার্বিকভাবে অন্যান্য বিষয়াদি বিবেচনা করে সুচিন্তিত মতামত ও সিদ্ধান্ত প্রদানের অনুরোধে করে। 

গত ১৭ এপিলের পর্ষদ সভায় বলা হয়েছে , অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রবেশ করায় দেশের বিশেষায়িত ব্যাংক ভিন্নভাবে কার্যক্রম গ্রহণের চেষ্টা করছে এবং এই ব্যাংকের সার্বিক পারফরমেন্সের বেশ উন্নতি হচ্ছে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আশা করছে বার্ষিক হিসাবের সমাপনী জুনে রাকাব সকল আর্থিক সূচকে উন্নতিসহ আর্থিকভাবে ব্রেক ইভেনে পৌঁছাবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের চাওয়া এবং একীভূতকরণ সিদ্ধান্ত অনুসারে, রাকাব ও বিকেবি  জরুরি পর্ষদ সভা ডেকে নিজ নিজ পর্ষদ সভায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একত্রীকরণের বিষয়টি নীতিগতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করবে ।

পর্ষদ সভায় আরও সিদ্বান্ত হয়, একত্রীকরণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবল ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ হওয়া আবশ্যকতা রয়েছে  নতুবা একত্রীকরণের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে। পর্ষদ সভায় পরিচালকরা অভিমত ব্যক্ত করেন, রাকাব শতভাগ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব কাজই আর্থিক  প্রতিষ্ঠান বিভাগের লিখিত অনুমোদন সাপেক্ষে করে থাকে। তাই পর্ষদ সর্বসম্মতিক্রমে অভিমত পোষণ করে রাকাবকে বিকেবির সঙ্গে একত্রীকরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকার তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সম্মতি অথবা পূর্বানুমোদন প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে এই সরকারের বিশেষায়িত ব্যাংক একত্রীকরণ সংক্রান্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সম্মতি জন্য পত্র প্রেরণ করতে হবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন হওয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে রাকাব ও বিকেবির একত্রীকরণ বিষয়ে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সম্মতি কামনা করবে।

এদিকে, গত ৫ মে, রাকাব ও বিকেবির একীভূতকরণ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে রংপুরে মানববন্ধন হয়েছে। স্থানীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে এ মানববন্ধনের আয়োজন করে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটি রংপুর।

কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, রাকাব এখন রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ লাভজনক ব্যাংকটিকে একটি লোকসানী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হচ্ছে। এর পেছনে যারা জড়িত, তারা উত্তরাঞ্চলের ভালো চান না।

বক্তারা বলেন, রাকাবকে কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হলে বড় ঋণ পেতে ঢাকায় যেতে হবে, যা এ অঞ্চলের কৃষি ব্যবসায়ীদের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হবে। অন্যদিকে কৃষি ব্যাংক বিপুল অংকের লোকসান মাথায় নিয়ে রাকাবকে কাছে টানার চেষ্টা করছে।

মার্জার নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলা আউটলুককে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূত করা নিয়ে তড়িঘড়ি করছে। এতে আমানতকারী, স্টেকহোল্ডার, ব্যাংকার ও পরিচালকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। রাকাবের চিঠি দিয়ে বুঝা যায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে না জানিয়ে বিকেবির সঙ্গে মার্জার করতে যাছে বাংলাদেশ ব্যাংক ।

তিনি আরও বলেন, সঠিকভাবে একীভূত না হলে ব্যাংক খাতের ওপর আস্থা কমে যাবে, গ্রাহক টাকা তুলে নেবেন। বিপদে পড়বে পুরো ব্যাংক খাত।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বাংলা আউটলুককে বলেন, জোর করে ব্যাংক একীভূতকরণের কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এটা মোটেও ভালো কাজ হচ্ছে না।

এ পর্যন্ত পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে পাঁচটি বড় ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মার্চ মাসের প্রথম বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক সবচেয়ে দুর্বল পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণ করেছে সবার আগে।

এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছিল, বেসিক ব্যাংক একীভূত হবে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে। তারপর সোনালী ব্যাংক অধিগ্রহণ করেছে বিডিবিএলকে। এরপর ঘোষণা দেওয়া হয় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের একীভূতের।

সবশেষে ঈদের ছুটির আগের দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে বেসরকারি ব্যাংক ইউসিবি ও ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত হওয়ার।

কী শর্তে দুর্বল ব্যাংকগুলোর অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ হলো, তা এখনো জানা যায়নি। তবে সিদ্ধান্তগুলো যে বিশেষজ্ঞ বা ওই ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পছন্দ হয়নি, তা বোঝা যায়। বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া আরও এগোনোর পর বোঝা যাবে সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে কি না। আরও পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে ‘মার্জার’-এ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে।

দেশের সরকারি ও বেসরকারি পাঁচ ব্যাংক একীভূত করতে ৬০ থেকে ৭০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এই অর্থ ব্যয় করতে হবে আগামী পাঁচ বছরে। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ কোথা থেকে আসবে, এ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূত হওয়ার যে নির্দেশনা দিয়েছে, তা নিয়েও আপত্তি তুলেছে একাধিক ব্যাংক। আমানতকারীরাও আস্থা না রাখতে পেরে তুলে নিচ্ছেন আমানত। এতে কয়েকটি ব্যাংকের অবস্থা ইতোমধ্যে আরও খারাপ হয়ে গেছে।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন