Logo
Logo
×

অর্থনীতি

বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প কি ধসে পড়ছে

আলী রীয়াজ

আলী রীয়াজ

প্রকাশ: ০৭ মে ২০২৪, ০৭:০৫ এএম

বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প কি ধসে পড়ছে

প্রতীকী ছবি

মাত্র বছর তিনেক আগে, ২০২১ সালে, বাংলাদেশকে একটি বিরাট বিজয়ী দেশ হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছিল বিশ্ব গণমাধ্যমে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করছিল, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তখন দেশটির অর্থনৈতিক সাফল্য উদযাপন করেছিল। কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার সাফল্য।

কিন্তু মাত্র বছর তিনেকের মধ্যে সেই চিত্র আমূল পাল্টে গেল। তিন বছর ধরে ক্রমাগত মহাবিপর্যয়ের যেতে লাগল দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাগুলির তথ্য বলছে, দেশটির অগ্রগতি বিরাট বাধার মুখে পড়েছে। কাকতালীয়ভাবে নয়, এই পরিবর্তনগুলি এ কারণে ঘটছে যে, দেশে এমন একটি সরকার রয়েছে যা তার নাগরিকদের কাছে কম দায়বদ্ধ।

 

ক্রমক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতির বৃহত্তর ছবি

গত ২ এপ্রিল প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে . শতাংশ। যেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৭.০৮ শতাংশ। তার আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি আরও বেশি ছিল, ৯.৩ শতাংশ। অর্থাৎ নাটকীয়ভাবে বদলে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতির চিত্র।

যারা বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিবিধি অনুসরণ করেন তারা বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে বিস্মিত হননি।

সরকার ৭.৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল, কিন্তু গত জানুয়ারিতে তা থেকে কমিয়ে ৬.৫ শতাংশ করল, তখনও তারা দেশের অর্থনীতির নাড়ি ধরতে পারল না। অর্থ বিশ্লেষকরা জোরালোভাবে বলছেন, চলতি অর্থবছরে সরকারের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনযোগ্য নয়।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশের গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় দশমিক শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টানা দুই বছর নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে এবং আগামী বছর খুব বেশি আলাদা নয়।

এই সংকট হঠাৎ করে দেখা দেয়নি। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে এটা স্পষ্ট হতে থাকে। দুই বছর আগে মন্দা এড়াতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের কাছে গিয়েছিল। সরকার নতুন বিদেশি ঋণ পেয়েছে, যা বিদ্যমান বৈদেশিক ঋণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।

গত বছর শেষের দিকে বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ফলে ঋণ পরিশোধের ব্যয় অধিক হারে বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে দেশটি এই ঋণ পরিশোধে দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।

অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ঋণ পরিশোধ করতে সরকারকে আরও ঋণ নিতে বাধ্য করছে৷’ অর্থাৎ দেশ আবার দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে পড়তে শুরু করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিবৃতি অনুসারে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ সাড়ে ছয় গুণ বেড়েছে। এর মধ্যে এক বছরে এটি ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমাতে আইএমএফের চাপের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি গোপন উপায় বের করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক হিসাব থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ মুছে ফেলবে। কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না। ব্যাংক-কোম্পানি আইনের একটি সাম্প্রতিক সংশোধনী খেলাপিদের সহযোগী কোম্পানিগুলিকে ঋণ নেওয়া চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেবে। এটা কতটা ভয়ানক তা সরকার বুঝতে পারছে না অথবা এর পেছনে যারা রয়েছে তারা জেনে-বুঝেই এটা করছে। কারণ পকেট ভারী করার পর তারা সব দায় থেকে মুক্ত থাকবে।

আরেকটি বিতর্কিত পদক্ষেপে, বাংলাদেশ ব্যাংক তার ব্যাংকিং খাত সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে দুর্বল ব্যাংককে শক্তিশালী ব্যাংকের সাথে একীভূত করছে। এ পদক্ষেপও বিপজ্জক হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

এটি খুবই পরিষ্কার যে, যারা এই দুর্বল ব্যাংকগুলি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারা তাদের এসব ব্যাংক থেকে বিপুল টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দেননি। এসব টাকা সাধারণ জনগণের টাকা। সরকার এসব টাকা আদায় করছে না। বরং যারা এসব টাকা নিয়েছে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে নতুন আইন ব্যাংক একীভূত করার মধ্য দিয়ে।

নাগরিকদের অর্থনৈতিক দুর্দশা

বিস্তৃত অর্থনৈতিক সংকট বাংলাদেশ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত এবং সমাজের দরিদ্র অংশের জন্য গুরুতর পরিণতি ডেকে আনছে। যদিও ফেব্রুয়ারির সরকারি পরিসংখ্যান দাবি করে মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে, বাজারে খাদ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অনেক বেশি। বিশ্ববাজারে খাদ্য জ্বালানির দাম কমলেও বাংলাদেশ এর সুফল ভোগ করতে পারেননি। এর পরিবর্তে গত মার্চে আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। শুধু ২০২৩ সালেই সরকার তিনবার বিদ্যুৎ গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে।

গত বছর মাঝামাঝিখাদ্য নিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩’ পরিচালনা করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। জরিপের তথ্য থেকে সাধারণ মানুষের দুর্দশা বোঝা যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় পৌনে চার কোটি (৩৭.৭ মিলিয়ন) মানুষ মাঝারি থেকে গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, চার ভাগের তিন ভাগের বেশি পরিবার খাদ্যসহ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসের খরচ মেটাতে ঋণ নিচ্ছে। সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ে একটি সমীক্ষা দেখায়, ২৮ শতাংশ পরিবার গত বছর এপ্রিল থেকে নভেম্বরের মধ্যে টাকা ধার নিয়েছিল৷ বেশিরভাগ পরিবারই অনানুষ্ঠানিক উৎস থেকে ধার করেছে৷

বিবিএস জরিপ অনুসারে, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে প্রতি পরিবারে ঋণের গড় পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যেখানে ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বেড়ে মাত্র ৩৪ শতাংশ৷

এই হিসাব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতির সুস্পষ্ট চিত্র দেয়।

একই সময়ে সাধারণ অসুস্থতা ও শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে। কমেছে শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের হার।

 

কেন এমন হলো

এসব অবনতি হঠাৎ করে হয়নি। দেশ এমন একটি অবৈধ শাসনব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হচ্ছে যেখানে বারবারউন্নয়নেরধোয়া দিয়ে সেই অবৈধতাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। তা করা হচ্ছে গণতন্ত্র রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বলি দিয়ে।

জবাবদিহিমূলক শাসনের অনুপস্থিতি এমন একটি গোষ্ঠীশাসন বিকাশের সুযোগ দিচ্ছে যা অর্থনীতির চাকা আটকে রাখছে। সরকার নির্দিষ্ট কিছু লোকজন নিয়ে একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে যার ওপর ভিত্তি করে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলি অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না। ফলে এমন একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর উদ্ভব হতে পেরেছে। ক্রমবর্ধমান এই গোষ্ঠীর কাছে ক্রমবর্ধমানভাবে আটকে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি।

এটা অপ্রত্যাশিত নয়, কর্তৃত্ববাদী বৃদ্ধির বুদবুদ ফাটিয়ে দিতে পারে এমন ভয়ানক সতর্কবাণী সত্য হতে চলেছে। যেহেতু দেশের শাসনব্যবস্থা একটি হাইব্রিড শাসন থেকে স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়েছে, বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর, সামাজিক উন্নয়ন সরকারের কাছ থেকে কম মনোযোগ পেয়েছে। কারণ সরকাকে তার নাগরিকদের ওপর নির্ভর করতে হয় না। নাগরিকদের উপেক্ষা করা যায়।

যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীর সাথে যে আশাবাদ ছিল তা অচিরেই দূরের স্মৃতির মতো মনে হতে পারে।

(আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে অনূদিত)

 

আলী রিয়াজ আটলান্টিক কাউন্সিল সাউথ এশিয়া সেন্টারের অনাবাসী সিনিয়র ফেলো এবং ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইস্ট অধ্যাপক।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন