রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য আমাদের ‘দুঃখিত ও ক্ষমা চাই’ শব্দগুলো শুনতে হবে: জার্মান রাষ্ট্রদূত
ইউএনবি
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৩ পিএম
রাজনৈতিক সমঝোতা প্রচেষ্টার জন্য মনের পরিবর্তন এবং রক্তাক্ত ও প্রতিশোধপরায়ণ অতীতের স্মৃতি মুছে ফেলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত আচিম ট্রস্টার। জার্মান ঐক্য দিবস উপলক্ষে গতকাল সোমবার (৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় দূতাবাসে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘সমঝোতার জন্য আমাদের দুঃখিত শব্দটি শুনতে হবে। যে অপরাধ ও ভুল করা হয়েছে তার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। আমারও ভুল হতে পারে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখন পর্যন্ত আমি এটি এখানে শুনিনি।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, তদন্ত ও সত্য স্বীকার করা ছাড়া সমঝোতা সম্ভব নয়।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরেন। রাষ্ট্রদূত ট্রস্টার সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত, অভিজ্ঞ ও চিন্তাশীল রাজনীতিবিদ, যিনি এই দেশের শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যত সম্পর্কে যা বলেছেন তা 'অত্যন্ত মর্মস্পর্শী' এবং 'প্রত্যয়ী' বলে মনে করেন। তাকে তিনি শ্রদ্ধাও করেন বলেও জানান।
রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এটি এমন একটি ধারণা যা সাম্প্রতিক অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকা বা রুয়ান্ডার মতো দেশগুলোতে ভাল কাজ করেছে, তবে ইউরোপেও সমানভাবে কাজ করেছে। বাংলাদেশে এমনটি না হওয়ার এবং উন্নত সাম্প্রদায়িকতায় অবদান রাখার কোনো কারণ আমি দেখি না।’
ট্রস্টার উল্লেখ করেন যে, তারা সবাই এমন একটি ভবনে দাঁড়িয়ে ছিলেন যা দুটি দেশের যৌথ মালিকানাধীন, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শত্রু ছিল। ‘ফ্রান্স ও জার্মানি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পুনর্মিলনই হচ্ছে আমাদের জনগণের শান্তিপূর্ণ অস্তিত্বের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ এবং একটি মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ইউরোপের জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষার একটি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, 'আমি মনে করি ফ্রান্স ও জার্মানি, পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক্ষেত্রে সাফল্যের সাক্ষ্য।’
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জেনেভায় মানবাধিকার বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধির কার্যালয়ের সহায়তায় ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের ঘটনাবলীর যথাযথ তদন্ত শুরু করে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাইরের অনেক মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করছে। জার্মান সরকার ওএইচসিএইচআরের এই কার্যক্রমে ৫০ হাজার ইউরো দিয়েছে।
জার্মান রাষ্ট্রদূত বলেন, 'আমি আস্থাবান যে, চ্যালেঞ্জিং সময়েও বাংলাদেশ ও জার্মানির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সুসম্পর্ক বিকশিত ও প্রস্ফুটিত হওয়ার ধারা অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, জার্মানি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ ও মিশনকে সমর্থন করে এবং অতীতের মতো এবারও সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছে।
দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষে জার্মান ফেডারেল চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে লেখা চিঠিতে বলেন, 'আপনার দেশের উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আপনি দায়িত্ব গ্রহণ করছেন। আমি আপনাকে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সামনের কাজগুলোর জন্য দুর্দান্ত শক্তি এবং সাফল্য কামনা করি।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, জার্মানি গত ৫২ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রশংসনীয় উন্নয়নে একটি প্রমাণিত অংশীদার এবং এর সাফল্যে অবদান রাখতে পেরে আমরা গর্বিত।
সর্বশেষ সরকারি আলোচনার সময়, জার্মানি প্রধানত নবায়ণযোগ্য জ্বালানি, শক্তি দক্ষতা এবং জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতার ক্ষেত্রে দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার জন্য অতিরিক্ত ১৭৬ মিলিয়ন ইউরো দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে উদারভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে, বাংলাদেশের ওপর যে ভারী বোঝা চাপানো হচ্ছে তা জার্মানি খুব ভালো করেই বুঝতে পারে।
জার্মানি নিজেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহু মানুষকে আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়েছে৷ জার্মানি বর্তমানে তার সীমান্তের মধ্যে ৩১ লাখেরও বেশি শরণার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থীদের যত্ন নিচ্ছে।
জার্মানি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশকে সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। ২০১৭ সাল থেকে শরণার্থী শিবিরের আশেপাশে মানবিক কার্যক্রমে ৩০৫ মিলিয়ন ইউরো দিয়েছে দেশটি।
রাষ্ট্রদূত ট্রস্টার বলেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও জার্মানির সম্পর্ক আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে। জার্মানি বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস পণ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ। অন্যান্য প্রতিশ্রুতিশীল খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণের অনেক সুযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি।
জার্মান সরকার দেশে দ্রুত নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছে এবং যে সংস্কার শুরু হয়েছে তা স্বীকার করেছে। মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যাংকিং খাত।
দূতাবাসের পক্ষ থেকে জার্মান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং তারা সবাই বাংলাদেশের প্রতি অব্যাহত আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কার এজেন্ডার সাফল্যকে সাধুবাদ জানাবেন তারা। এর ফলে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের ব্যবসা জোরদার ও সম্প্রসারিত করতে পারবেন। জার্মান সরকার ধরে নিয়েছিল যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সহযোগিতার সাধারণ ভিত্তি - দ্বিপক্ষীয়ভাবে পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তার সহযোগিতার কাঠামোটি বিস্তৃত হয়েছে।
রাষ্ট্রদূত বলেন, তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের অংশীদার এবং তারা যৌথভাবে এর সর্বোত্তম ব্যবহার করতে আশাবাদী, বাংলাদেশের জনগণের সুবিধার জন্য, স্বাধীনতা, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এবং সকলের জন্য আরও সমৃদ্ধির জন্য হঠাৎ করে যে সুযোগ এসেছে তা গ্রহণ করতে।
ট্রস্টার বলেন, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে আমরা এই মূল্যবোধে বিশ্বাস করি এবং আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশের সমাজের একটি বড় অংশ এই আকাঙ্ক্ষার জন্য চূড়ান্ত পর্যন্ত প্রচুর ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকার করতে ইচ্ছুক ছিল। আমরা এই দুঃখজনক ক্ষতির জন্য শোক করছি এবং তাদের এবং তাদের অসামান্য সাহসকে আমাদের স্মৃতিতে রাখব।’
জার্মান রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের অনেক নাগরিক মনে করেন, তাদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।