বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতনকে ভারতের জন্য কৌশলগত ক্ষতি এবং চীনের জন্য সম্ভাব্য লাভ হিসেবে বর্ণনা করেছেন অনেকে। তবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা চীনকে এই অঞ্চলে বৃহত্তর প্রভাব অর্জনে বাধা দিতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং বাংলাদেশের প্রতি ভারতের স্থায়ী গুরুত্ব চীনের প্রভাবশালী প্রবেশের পরিধি সীমিত করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনে ভারতের জন্য একটি গুরুতর কৌশলগত ক্ষতি হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, ভারতের ক্ষতি চীনের জন্য দারুণ কৌশলগত লাভ। যদি বেইজিং বাংলাদেশে তার অবস্থানের উন্নতি করতে পারেও, সেই উপসংহারটি অতিরঞ্জিত।
বাংলাদেশের সংকট চীনকে ভারতের ওপর একটি সুবিধা এবং তার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু বেইজিং গুরুতর বাধার সম্মুখীন হচ্ছে যা এর সুবিধাকে ভোঁতা করে দেবে, এর প্রভাব বিস্তারকে ধীর করে দেবে এবং এই সুযোগকে কাজে লাগানো কঠিন করে তুলবে।
কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভের পর শেখ হাসিনার সরকারের পতন নয়াদিল্লির জন্য একটি বড় ধাক্কা। হাসিনার শাসনামলে ভারত শুধু ঢাকার সাথে তার সম্পর্ককে কার্যকরভাবে দাঁড় করিয়েছিল তাই নয়, হাসিনাবিহীন বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতায় রয়েছে ছাত্র, বিএনপি সমর্থক ও ইসলামপন্থীরা, যারা প্রতিবাদ আন্দোলন করেছে হাসিনার বিরুদ্ধে এবং ক্ষুব্ধ রয়েছে ভারতের বিরুদ্ধে।
হাসিনার সরকার ছিল ভারতের জন্য একটি মূল্যবান কৌশলগত সম্পদ। ২০২১ সালের যৌথ বিবৃতিতে উভয় পক্ষের মতে, এটি পূর্বে সমস্যাযুক্ত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে স্থিতিশীল করেছে এবং সম্পর্কের একটি 'সোনালি অধ্যায়' খুলেছে। ১৫ বছরের মেয়াদে হাসিনা আন্তঃসীমান্ত জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করেছেন, বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দিয়েছেন এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি কার্যকলাপ সম্পর্কে নয়াদিল্লির দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
ভারতের জন্য, ভারতের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সংযোগ এবং অর্থনৈতিক একীকরণের জন্য বাংলাদেশের সাথে অংশীদারিত্বও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভারতের জন্য একটি বড় জয়, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে রেল লাইনের পরিকল্পনা, যা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের যোগাযোগ সহজতর করবে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ভারতের জন্য হুমকিস্বরূপ।
হাসিনার সরকার বেইজিং এবং নয়াদিল্লির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ভারতের দিকে ঝুঁকেছিল। বাংলাদেশে অনেক সফল চীনা প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও এই ঝোঁক স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন ঢাকা চীন-সমর্থিত এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সোনাদিয়া গভীর-সমুদ্র বন্দর বাতিল করে, সম্ভবত ভারতীয় চাপে।
ক্রমবর্ধমান বিপর্যস্ত হাসিনা সরকার ২০২৪ সালে নয়াদিল্লির উপর দৃঢ়ভাবে ঝুঁকে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীনের বদলে ভারতকে বেছে নিয়েছিল। ফলে বেইজিং গত জুলাইয়ে হাসিনার চীন সফরের সময় ঠাণ্ডা আচরণ করে এবং ৫ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে মাত্র ১ বিলিয়ন সহায়তা দেয়, যা তার অসন্তোষের ইঙ্গিত। ক্ষুব্ধ হাসিনা তার সফর সংক্ষিপ্ত করেন।
বাংলাদেশে অভ্যুত্থান চীনকে ভারতের ওপর সুবিধা এবং তার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেয়। চীন, তার পর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থানসহ, বাংলাদেশে নয়াদিল্লির উপর একটি সুবিধা ভোগ করে।
একটি নতুন বাংলাদেশ সরকার চীনকে তার প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেয়। এটি কেবল বেইজিংকে ভারতের পূর্ব ফ্রন্টে তার প্রভাব বাড়াতে দেবে না, এটি বঙ্গোপসাগর এবং উত্তর ভারত মহাসাগরেও এর উপস্থিতি বাড়াবে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে, মালদ্বীপে সাম্প্রতিক চীনা প্রবেশের মধ্য দিয়ে, চীন নয়াদিল্লিকে দক্ষিণ এশিয়ায় বন্দী রাখতে সাহায্য করবে এবং বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক থিয়েটারে বেইজিংকে চ্যালেঞ্জ করতে কম সক্ষম হবে ভারত।
তবে চীনের পক্ষে তার সুবিধা ব্যবহার করা এবং সুযোগটি কাজে লাগানো কঠিন হবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বিপ্লবের ইন্ধন, একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বিকল্পের অভাব হল চীনা প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে প্রধান বাধা।
বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা করার জন্য, বেইজিংয়ের ঢাকায় একটি স্থিতিশীল সরকার প্রয়োজন যেটি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে, বিশেষ করে যেহেতু চীন বাংলাদেশের সাথে তার সম্পর্ককে আওয়ামী লীগ সরকারের উপর কেন্দ্রীভূত করেছিল, সেখানে একটি শক্তিশালী ইসলামি আন্দোলনের উপস্থিতি, যা ভবিষ্যতের সরকারে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে এবং যারা মাঝে মাঝে চীনের সমালোচনা করেছে, বেইজিংয়ের জন্য এটি একটি অনিশ্চয়তা।
বাংলাদেশের কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেইজিংয়ের জন্য আরেকটি বাধা। এর অর্থ হল, চীনকে বাংলাদেশকে বড় ঋণ দিতে হতে পারে। সীমিত তাৎক্ষণিক সুবিধাসহ ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি ব্যয়বহুল এবং উচ্চ ঝুঁকির বাজি। তদুপরি, অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সংমিশ্রণ বাংলাদেশে বড় চীনা বিনিয়োগ প্রকল্পগুলিকে জটিল করে তোলে এবং চীনা ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যেটি ভারতের অসন্তুষ্টির জন্য ক্রমবর্ধমান অগণতান্ত্রিক হাসিনা সরকারের বিরোধিতা করেছিল, চীনের প্রভাবের আরেকটি সীমাবদ্ধতা। ওয়াশিংটন, যারা প্রতিবাদ আন্দোলনের সমর্থক ছিল, অন্তর্বর্তীকালীন নেতা মোহাম্মদ ইউনূসের ঘনিষ্ঠ এবং বাংলাদেশ সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে এর প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনীয় আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিশ্চিত করতে ঢাকার মার্কিন সহায়তারও প্রয়োজন হবে।
ভারত বাংলাদেশের জন্য সমালোচনামূলকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এটি একটি সত্য যে, ঢাকা বেইজিংয়ের সাথে নিজেকে কতটা সারিবদ্ধ করতে পারে তার সীমা আছে। অস্থিতিশীল এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার সাথে দীর্ঘ ঝগড়া সহ্য করতে পারে ভারত, যেহেতু এশিয়ার বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য বাংলাদেশ। নয়াদিল্লি ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন শুরু করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশে বেইজিংয়ের সুবিধা আরও কমে যাবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মার্কিন প্রভাব এবং ঢাকার ওপর ভারতের অন্তর্নিহিত প্রভাব বাংলাদেশকে চীনের কাছাকাছি যাওয়াকে সীমিত করবে। বাংলাদেশের বিপ্লব সম্ভবত ভারতের তুলনায় বেইজিংয়ের আপেক্ষিক অবস্থানকে উন্নত করবে কিন্তু চীনের বিজয় হবে না, যা কেউ কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। [ইস্ট এশিয়া ফোরাম ডট অর্গ থেকে অনুবাদ]
• ইভান লিডারেভ, এশিয়ান নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ, চীন-ভারত সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ। তিনি এলএসই আইডিয়াস-এ ম্লাদেনা এবং দিয়াঙ্কো সোতিরভ ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।