বেইজিং কূটনীতির গল্প
চীনের 'নেকড়ে যোদ্ধারা' কি হারিয়ে গেছে?
টাইলার জোস্ট
প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৪, ১০:৫৯ এএম
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বেইজিংয়ে সংবাদ সম্মেলনে, মার্চ ২০২২
বছর পাঁচেক আগে চীনের কূটনীতিকরা কূটনৈতিক হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। হাই-প্রোফাইল রাষ্ট্রদূত এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্ররা টুইটারে (এক্স), প্রেস কনফারেন্সে এবং বদ্ধ ঘরে বসেও ঠোঁটকাটা, ব্যঙ্গাত্মক, নেতিবাচক বিবৃতি দিতে শুরু করেছিলেন। আগের মতো কৌশলী ও সতর্কতামূলক বক্তৃতাশৈলীর বৈপরীত্য এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে, দেশে-বিদেশে পর্যবেক্ষকরা চীনা দূতদের একটি রঙিন নতুন উপাধি দিয়েছিলেন, ‘নেকড়ে যোদ্ধা!’
নেকড়ে যোদ্ধা কূটনীতির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল জনসাধারণের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির মাধ্যমে বিদেশি সমালোচকদের নিরস্ত করা। এ জন্য প্রায়ই তারা আবেগপ্রবণ ভাষা ব্যবহার করতেন।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানে চীনের একজন সিনিয়র কূটনীতিক টুইটারে বলেছিলেন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সাথে টেটা ব্যবসা করেছেন। টেটা বড়শিজাতীয় অস্ত্র যার থাকে ধারালো ফলা যে-কারণে এটা ঢোকে সহজে, কিন্তু বের হবার সময় মাংস ছিঁড়ে আসে।
একই বছর নভেম্বর সুইডেনে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘আমরা আমাদের বন্ধুদের ভাল ওয়াইন দিয়ে আপ্যায়ন করি, কিন্তু আমাদের শত্রুদের জন্য শটগান রয়েছে।’
২০২১ সালের মার্চে আলাস্কায় কূটনৈতিক আলোচনার সময় চীনের সিনিয়র কূটনীতিক ইয়াং জিচি প্রকাশ্যে পররাষ্ট্র সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের উদ্দেশে কটূক্তি করেছিলেন। ‘চীনের সমাজ ব্যবস্থার বদনাম’ না করার জন্য সতর্ক করেছিলেন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র মার্কিন প্রতিনিধিদলের বিরুদ্ধে ‘বারুদের গন্ধে ভরা বৈরী পরিবেশ’ তৈরির সমালোচনা করেছিলেন।
গত তিন বছরে চীনা কূটনীতিকরা ধীরে ধীরে ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে ফিরে এসেছেন। সম্ভবত প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নির্দেশে, তারা তাদের প্রকাশ্য বিবৃতি কমিয়েছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও উন্নয়নশীল বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে মনোনিবেশ করেছেন। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে সংযুক্ত সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলি সক্রিয় রয়েছে, তবে তাদের মেসেজ এখন কম দ্বন্দ্বমূলক। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস কনফারেন্সগুলোও অনেক বেশি নমনীয় হয়ে উঠেছে।২০২৯-২০ সালে যে কূটনীতিকদের বিবৃতি আন্তর্জাতিক সংবাদ তৈরি করছিল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অবসর নিয়েছেন বা নতুন অ্যাসাইনমেন্টে চলে গেছেন।
অনেক পণ্ডিত-নীতিনির্ধারক চীনা জনগণের জাতীয়তাবাদ ও শির ব্যক্তিত্ববাদী নেতৃত্বকে নেকড়ে যোদ্ধা কূটনীতির উত্থানের জন্য দায়ী করেছেন। তার পরও যেকোনো অভ্যন্তরীণ কারণের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল চীনের আন্তর্জাতিক পরিবেশের পরিবর্তন। কোভিড-১৯ মহামারির আগের বছর বা তারও আগে, চীনা নেতারা বিদেশি সমালোচনার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সমালোচনা যা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) শাসনের জন্য হুমকি হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল।
এই তিন বছরে চীনের কূটনৈতিক কণ্ঠ যেমন নরম হয়েছে তেমনি কূটনীতিতে চীনের দৃষ্টিভঙ্গিরও বদল হয়েছে।
সামনের দিনগুলোতে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই তাদের জনসাধারণের মন্তব্যের প্রভাব বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ যদি বেইজিং আবার নিজেকে অবরুদ্ধ মনে করে তাহলে নেকড়ে যোদ্ধারা ফিরে আসতে পারেন, যা চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনার সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
নেকড়ে যোদ্ধার উত্থান
উনিশ আশির দশকের শেষের দিকে চীনের প্রবীণ কূটনীতিকদের অধিকাংশেরই কলেজ ডিগ্রি ছিল। তারা নিয়মিত শ্বেতপত্রের খসড়া তৈরি ও প্রেস কনফারেন্স করতেন। দেশের কূটনীতিকরা বিদেশিদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও দক্ষ হয়ে ওঠেন। তবে ২০১২ সালে শি জিনপিং সিসিপির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সময়টি চীনা কূটনৈতিক অনুশীলনের আসল টার্নিং পয়েন্ট। শি তার কূটনীতিকদের বিশেষ নির্দেশনা দেন। এই কূটনীতিকরা ধীরে ধীরে আক্রমণাত্মক বক্তব্যের উপায়-প্রক্রিয়া খুঁজে পান।
‘উলফ ওয়ারিয়র ২’ নামে একটি জনপ্রিয় অ্যাকশন ফিল্ম সিরিজের দ্বিতীয় কিস্তি মুক্তি পায় ২০১৭ সালে। সিরিজটি চীনের স্বার্থ রক্ষার জন্য অপ্রচলিত মিশনের জন্য অভিযুক্ত একটি কাল্পনিক বিশেষ অপারেশন ইউনিট অনুসরণ করে। এই চলচ্চিত্রের ট্যাগলাইন হল ‘যদি কেউ হাজার মাইল দূরে থেকেও চীনকে অপমান করে তাহলেও তাকে তার মূল দিতে হবে!’ ২০২০ সালের মধ্যে দেশে-বিদেশে ওই সিরিজের দর্শকরা চীনের কূটনীতিকদের ‘নেকড়ে যোদ্ধা’ (উলফ ওয়ারিয়র) হিসাবে বর্ণনা করেন।
নেকড়ে যোদ্ধা কূটনীতির একটি বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য ছিল ‘আমাদের’ ও ‘তাদের’ মধ্যে বিভাজনের উপর জোর দেওয়া। চীনা কূটনীতিকরা চীনা নেতাদের তুলনায় বিদেশি কর্মকর্তাদের ভণ্ড, নীতিহীন বা যুক্তিহীন বলে চিহ্নিত করেন। ২০২১ সালের জুনে ফ্রান্সে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, ‘আমাকে নেকড়ে যোদ্ধা বলে সম্মানিত করা হয়েছিল।’ এবং তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “এই জাতীয় কূটনীতিকরা চীনকে ‘পাগলা কুকুর’ থেকে, বিদেশি সমালোচকদের হাত থেকে, রক্ষা করছেন।”
চীনা দূতদের উদ্দীপক বিবৃতি প্রায়ই দর্শকের চোখে পড়ে। বিদেশি শ্রোতারা সাধারণত নতুন কূটনৈতিক শৈলীকে অসভ্য ও কৌশলহীন বলে মনে করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্ডিত পররাষ্ট্রনীতির ভাষ্যকাররা চীনের নেকড়ে যোদ্ধাদের ‘আবেগপ্রবণ’, ‘উৎসাহী’, ‘কঠোর’, ‘সংঘাতময়’ ও ‘আক্রমনাত্মক’ বলে বর্ণনা করেন।
তবু, চীনা কূটনীতিকদের মতে, তাদের বিবৃতি তাদের চারপাশের শত্রুতার প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া। আরেকজন চীনা কূটনীতিক মন্তব্য করেছিলেন, ‘নেকড়ে যুদ্ধের প্রয়োজন এই সত্য থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যে, এই পৃথিবীতে নেকড়ে আছে।‘
আগের অবস্থায় ফেরত
নেকড়ে যোদ্ধা কূটনীতি ২০২১ সালের দিকে হ্রাস পেতে শুরু করে। কারণ সে সময় আন্তর্জাতিক পরিবেশ বেইজিংয়ের প্রতি কম প্রতিকূল হয়ে ওঠে। ওই বছর মার্কিন হোয়াইট হাউস ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট আশ্বাস দেয় যে, ওয়াশিংটনের লক্ষ্য বেইজিংয়ের শাসন পরিবর্তন করা নয়। ২০২২ সালের মে মাসে ব্লিঙ্কেন নিশ্চিত করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে অদূর ভবিষ্যতে একে অপরের সাথে চলতে হবে। আর সম্প্রতি ডেপুটি সেক্রেটারি অফ স্টেট কার্ট ক্যাম্পবেল স্পষ্টভাবে বলেছেন, চীনের শাসন পরিবর্তন করতে চাওয়া হবে বেপরোয়া ও সম্ভবত নিষ্ফল।
(ফরেন অ্যাফেয়ার্স ডটকমে প্রকাশিত টাইলার জোস্টের বিশ্লেষণ থেকে। ইলার জোস্ট: ব্রাউন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক, ‘Bureaucracies at War: The Institutional Origins of Miscalculation’-এর লেখক।)