Logo
Logo
×

সারাদেশ

‘অনুভূতিতে আঘাত করা’ ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করার অভিযোগ

যুবককে হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে পরিবার ও এলাকাবাসীর ওপর চাপ, আতঙ্ক

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৪ পিএম

যুবককে হাতে তুলে দেওয়ার দাবিতে পরিবার ও এলাকাবাসীর ওপর চাপ, আতঙ্ক

উ‌দ্বিগ্ন দাসপাড়ার বা‌সিন্দারা

কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার উমর মজিদ ইউনিয়নের এক হিন্দু যুবককে নিজেদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে একদল যুবক। ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ সৃষ্টিকারী একটি পোস্ট শেয়ারের জেরে এই চাপ সৃষ্টি করেছে তারা। এসবের নেতৃত্বে অভিযুক্ত যুবকের এক সময়ের সহপাঠীর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ইউনিয়নের বালাকান্দি দাসপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনায় ইউনিয়নের দাসপাড়ার হিন্দু পরিবারগুলোর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কয়েক দফায় দাস পাড়ার বাসিন্দাদের হুমকি দিয়ে যুবককে হাতে তুলে দিতে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। এই চাপ সৃষ্টির নেপথ্যে অভিযুক্ত যুবকের সাবেক এক সহপাঠী জড়িত বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

এদিকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনদের অভয় দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এরপরও আতঙ্ক কাটেনি দাসপাড়ার বাসিন্দা জেলে পরিবারগুলোর। নানা শঙ্কায় দিনযাপন করছেন তারা।


দাসপাড়া গ্রামের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ওই পাড়ার বাসিন্দা এক হিন্দু যুবক বেসরকারি চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকেন। মঙ্গলবার তিনি ইমাম হোসেইন নামে একটি ফেসবুক আইডির পোস্ট নিজ আইডিতে শেয়ার করেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে ‘ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ অভিযোগ তুলে এলাকার কিছু যুবক উত্তেজিত হয়ে তার বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেন। তাকে দ্রুত সময়ে হাজির করে তাদের হাতে তুলে দিতে বলেন। দাসপাড়ার একাধিক বাসিন্দাসহ জেলেদের সরদারকে একই হুমকি দেন ওই যুবকেরা। এদের নেতৃত্বে ছিলেন সাজেদুল নামে স্থানীয় এক যুবক। সাজেদুল পেশায় চায়ের দোকানি এবং অভিযুক্ত হিন্দু যুবকের এক সময়ের সহপাঠী বলে জানা গেছে। তিনি বর্তমানে ইউনিয়নের যতিনের হাট বাজারে চায়ের দোকানের ব্যবসা করেন।

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফেসবুকে পোস্ট শেয়ার করার পর থেকে সাজেদুল পোস্টের স্ক্রিণশট নিয়ে তা ফটোকপি করে এলাকায় বিভিন্নজনের কাছে প্রচার করছিলেন। তিনি স্থানীয় কিছু যুবক ও উঠতি বয়সি কিশোরদের সংগঠিত করে জেলেপাড়ার বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। তার নেতৃত্বে অভিযুক্ত যুবককে হাজির করার জন্য তার পরিবার ও জেলে সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। অন্যথায় গ্রামে হামলার আশঙ্কার কথাও জানান তারা।

এলাকায় উত্তেজনা এবং পরিবার ও গ্রামবাসীর নিরপাত্তার কথা বিবেচনায় অভিযুক্ত যুবক তার শেয়ার করা পোস্ট সরিয়ে ফেলেন এবং ক্ষমা চেয়ে আরেকটি পোস্ট দেন। কিন্তু এরপরও সাজেদুল ও তার সাথীরা বিষয়টি নিয়ে চাপ অব্যাহত রাখেন।

বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) দুপুরে দাসপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, অভিযুক্ত যুবকের বাড়িতে জেলেদের সরদার ফেলু দাস সহ কয়েকটি জেলে পরিবার একত্রিত হয়ে সংকট সমাধানের পথ খুঁজতে আলোচনা করছেন। তাদের চোখে মুখে আতঙ্ক। অভিযুক্ত যুবকের অসুস্থ বাবা কথা বলতে গিয়ে আতঙ্কে কেঁদে উঠছেন। মায়ের আতঙ্কিত চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

যুবকের বাবা বলেন, ‘ কাল রাত থাকি বাড়িত কয়েকজন আসি ছেলেক হাতত তুলি দিবার কইতেছে। আইজ সকালে আসি কইতেছে থানাত যায়া আমাক নিজের ছেলের নামে মামলা করতে। আমার পায়ের তলাত মাটি নাই। আমি কী করমো। ছেলে যদি অপরাধ করি থাকে আইনে তার শাস্তি হইবে। ওমার হাতত তুলি দেওয়া লাগবে ক্যান! ‘ছেলের বউটা অন্তঃসত্তা। ভয়ে তাক বাড়ি থাকি অন্য জাগাত রাখছি। ছেলেক হাজির করার জন্য গ্রামবাসীক চাপ দিবার লাগছে।

দাসপাড়ার বাসিন্দা ও জেলেদের সরদার ফেলু দাস বলেন, ‘আমি কারও নাম বলতে চাই না। আমরা আতঙ্কে আছি বাবা। কী করবো বুঝতে পারতেছি না। সবাই ওদেরকে চেনে। ওরা কাল রাতে আসি ঘুরি গেইছে। ছেলেক আনি চায়। না হইলে আমাদের সমস্যা হইবে বলি হুমকি দেয়। পরে রাইতে চেয়ারম্যান আসি সবাইকে শান্ত থাকপার বলি গেইছে।’

জেলে পরিবারে কথা বলার সময় সেখানে উপস্থিত হন রাজারহাট থানার ওসি রেজাউল করিম রেজা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আহসানুল কবির আদিলসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তারা অভিযুক্ত যুবকের পরিবার ও দাসপাড়ার জেলে পরিবারদের সাথে কথা বলে তাদেরকে নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন। ফোন নাম্বার দিয়ে যেকোনও প্রয়োজনে তৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দেওয়ার পরামর্শ দেন। একই সাথে মুসলিম বাসিন্দাদের শান্ত থাকার পরামর্শ দেন।

দাসপাড়া থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে দেখা মেলে উত্তেজনায় নেতৃত্ব দেওয়া সাজেদুলের সাথে। তাকে বেশ অস্থির দেখায়। পকেটে ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশটের ফটোকপি। পরিচয় জানতে চাইলে নিজের পরিচয় দিয়ে সাজেদুল বলেন, ‘ সে (অভিযুক্ত যুবক) অপরাধ করেছে। সে আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে তার অপরাধ প্রমাণ হয়েছে। তাকে শাস্তি পেতে হবে।’

পোস্ট সরিয়ে ক্ষমা চেয়ে যুবকের পোস্ট দেওয়া প্রশ্নে সাজেদুল বলেন, ‘আমি ক্ষমা করলেতো সবাই ক্ষমা করবে না। তাকে আসতে হবে। পোস্ট সরিয়ে নিলেই হবে না। সে আমাদের ধর্ম নিয়ে কটূক্তির পোস্ট শেয়ার করে সমান অপরাধ করেছে। তাকে উপস্থিত হয়ে এলাকাবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আর বিষয়টি নিয়ে আমরা থানায় অভিযোগ দেব।’

দাসপাড়ার বাসিন্দাদের আতঙ্কে রাখার প্রশ্নে সাজেদুল বলেন, ‘যখন সরকার পতন হয় তখন ভারত কী কী বলছে। এসব এরা শোনে নাই। এখন কেন ভয় পাবে। তারা ওই ছেলেকে হাজির করুক।’

রাজারহাট থানার ওসি রেজাউল করিম রেজা বলেন, ‘বাসিন্দাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা সকলের সাথে কথা বলেছি। যিনি ফেসবুকে পোস্টটি শেয়ার করেছেন তার অপরাধ হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কেউ যেন আইন হাতে তুলে না নেন সেজন্য সকলকে সতর্ক করা হয়েছে।’

বুধবার সন্ধ্যায় দাসপাড়ায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুপুরের পর সেনাবাহিনীর সদস্যরা দাসপাড়া পরিদর্শন করে বাসিন্দাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। যেকোনও সমস্যা বোধ করলে সেনাবাহিনীকে খবর দেওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন।

জেলা প্রশাসক নুসরাত সুলতানা বলেন,‘ খবর পাওয়ার পর আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিষয়টি অবহিত করেছি। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত ও স্বাভাবিক রয়েছে। নিরাপত্তা সংকট নেই। তারপরও পুলিশকে বাড়তি নজরদারি রাখতে বলা হয়েছে।’

পু‌লিশ ও স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তার বিষ‌য়ে আশ্বস্ত করলেও বুধবার সন্ধ্যার পর দাসপাড়ার কা‌ছে যতি‌নেরহাট বাজা‌র এলাকায় অভিযুক্ত যুব‌কের শা‌স্তির দা‌বিতে মি‌ছিল ক‌রে‌ছে '‌বিক্ষুদ্ধ কয়েকজন যুবক'।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন