বইমেলার পর্দা নামছে। ৩১ দিনের মেলা হয়ে উঠেছিল পাঠক-দর্শনার্থী ও লেখকদের মিলনমেলা। স্টলে স্টলে এখন ব্যস্ততা বিদায়ের। করোনাভাইরাস মহামারির পর বইমেলা চিরায়ত রূপ হারিয়েছিল; বই বিক্রি নেমে গিয়েছিল তলানিতে। গত দুই বছরের তুলনায় এবার বই বিক্রি বেড়েছে ঠিকই, তবে পুরোনো রেকর্ড এখনও ছুতে পারেনি।
এবার লেখক-প্রকাশকদের প্রত্যাশা ছিল বেশি। এবারই প্রথম মেট্রোরেলের সুবিধায় যাতায়াত করেছেন বইপ্রেমীরা। মেট্রোরেলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনটি একেবারেই বইমেলার সঙ্গে লাগোয়া। ফলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সব এলাকার যাত্রী অনায়াসেই এসেছেন মেলায়। যার প্রভাব পড়েছে উপস্থিতিতেও।
মেলায় বিশেষ করে শেষ প্রান্তিকে এসে বিক্রি বেড়েছে। পরে প্রকাশকদের পক্ষ থেকে মেলার সময় বাড়ানোর দাবি করা হলে মেলার সময় বর্ধিত করা হয়। যদিও এই বর্ধিত সময়ের প্রথম দিন অর্থাৎ গতকাল শুক্রবার মেলায় তেমন ভিড় ছিল না। রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ছাপ পড়েছিল বইমেলায়।
সাধারণত মেলার শেষ দিনগুলো ও বিশেষ করে ছুটির দিনে প্রকাশকদের প্রত্যাশা থাকে বেশি। মেলার শেষ দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটির দিনও ছিল, কিন্তু প্রত্যাশিত বেচাকেনা হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা।
বাংলা একাডেমির তথ্য বলছে, এ বছর বইমেলায় নতুন বইয়ের সংখ্যা ৩ হাজার ৮০০টির বেশি। আর বই বিক্রি হয়েছে ৬০ কোটি টাকার, গত বছর বিক্রি ছিল ৪৭ কোটি টাকার।
যদিও দেশে মহামারির আগের সময়ের বিক্রির তুলনায় বই বিক্রির বৃদ্ধিকে বলা চলে নগণ্য। ২০২০ সালে রেকর্ড ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল।
এবারও নতুন বই দিয়ে অনেক লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে। নতুন বইয়ের মধ্যে কবিতার বই ছিল বেশি। মেলায় এ বছর বেশকিছু বই পাঠকদের আকৃষ্ট করেছে। ছোট প্রকাশনীর সঙ্গে বড় প্রকাশনা সংস্থা থেকে ফিকশন ও নন-ফিকশনের মানসম্মত অনেক বই প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। গবেষণা ও অনুবাদ মিলিয়ে এবারও বেশ কিছু নতুন বই বের হয়েছে। পাঠকদের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা রহস্য-রোমাঞ্চ ঘরানার গ্রন্থও বের হয়েছে।
অন্যান্য বছরের মতো এবারও অমর একুশে বইমেলায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টল, প্যাভিলিয়ন ছিল। সবমিলিয়ে ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৯৩৭ ইউনিট স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে প্যাভিলিয়ন ছিল ৩৭টি।
মেলার স্টল বিন্যাস নিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে কর্তৃপক্ষ। আবার লিটল ম্যাগ কর্নার নিয়েও অভিযোগ ছিল; যা নিয়ে লিটল ম্যাগের সম্পাদকরা অসন্তোষও জানান।
মেলার পরিবেশ নিয়েও ছিল অভিযোগ। মেলা প্রাঙ্গণে ছিল প্রচুর ধুলা। কিছু প্রকাশনীর ডাবল স্টল নেওয়া নিয়েও কথা উঠেছে। টয়লেট বিড়ম্বনাও ছিল উল্লেখ করার মতো। ফলে, প্রতিবারের মতো এবারও বাংলা একাডেমির দিকে অব্যবস্থাপনার অভিয়োগের তীর।
স্থান পরিবর্তনের বিতর্ক
বাংলা একাডেমির ছোট প্রাঙ্গণ থেকে বইমেলা ক্রমেই বিস্তৃত হয়েছে। এই মেলা সংস্কৃতির বিকাশেও রেখে চলেছে ক্রমবর্ধমান ভূমিকা। দেশের লেখক-প্রকাশক ও পাঠকদের আস্থা ও ভালোবাসার এই মেলার স্থান নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
বিগত এক দশক ধরে বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। তবে এবার মেলার মাঝেই আলোচনা শুরু হয়েছে পরবর্তী বছরে মেলার স্থান হিসেবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বরাদ্দ না দেওয়ার ব্যাপারে।
বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে পূর্বাচলে নিয়ে যাওয়া হবে বলেও শোনা যাচ্ছে। যদিও মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি বা সরকারের পক্ষ থেকে এখনো চূড়ান্ত কিছু জানানো হয়নি।
বর্তমানে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায় বইমেলা হচ্ছে। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরির অংশ হিসেবে মার্চ মাস থেকে কিছু প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাইছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এমন পরিস্থিতিতে বইমেলার স্থান নিয়ে নতুন করে জটিলতা ও আলোচনা তৈরি হয়েছে।
বইমেলার সরিয়ে নেওয়ার এ সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করছেন প্রকাশকরা। আর এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘গণপূর্ত তো এবারও মেলার আগে জায়গাটি বরাদ্দ দিতে আপত্তি করেছিল। পরে বইমেলার সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে অনুমতি দিয়েছে। আগামী বছর অনুমতি দেবে না বলছে, পরে হয়ত দিতেও পারে। এটা এখনই বলা যাচ্ছে না।’
শনিবার বিকেলে অমর একুশে বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠান হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। সম্মানীয় অতিথি ছিলেন নবনিযুক্ত সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।
নবনিযুক্ত সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজাহার খান বইমেলা স্থানান্তরের বিষয়ে বলেন, বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলা এখন ঐতিহ্য হয়ে গেছে। এই বইমেলা সরানোর বিষয়ে কথা উঠেছে। আমরা কোনো না কোনো ব্যবস্থা করে বইমেলা এখানে রাখার ব্যবস্থা করবো।
প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, সারা পৃথিবী ঘুরে এসেও এমন একটি বইমেলা খুঁজে পাবেন না। এ বইমেলা আমাদের আবেগের মেলা, জাতিসত্তার মেলা। এই বইমেলা জাতি হয়ে ওঠার বইমেলা, আমাদের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসার বইমেলা।