ঢাকা শহরের পার্কগুলো হতে পারে চিকিৎসা কেন্দ্র

ড. ফয়সাল কবীর শুভ
প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৫০ পিএম
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ মহানগর ঢাকা শহরে—যেখানে দূষণ, যানজট এবং নাগরিক অব্যবস্থাপনা নিত্যদিনের সঙ্গী—সেই শহরের মাঝেই লুকিয়ে আছে এক শক্তিশালী কিন্তু অবহেলিত স্বাস্থ্য সমাধান: নগর সবুজ পরিসর বা ‘Urban Green Space’’। পেশাদার নগর পরিকল্পনাবিদদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যানার্সের অর্থ্যায়নে বাংলাদেশি ও আমেরিকান গবেষকদের যৌথ গবেষণায় সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এ প্রকাশিত ‘Noncommunicable Diseases, Park Prescriptions, and Urban Green Space Use Patterns in a Global South Context: The Case of Dhaka, Bangladesh’ শীর্ষক একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, এই সবুজ পরিসরগুলো যদি চিকিৎসকদের চিকিৎসাপত্রের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা হতে পারে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ‘ননকমিউনিকেবল ডিজিজ’ (NCD) বা দুরারোগ্য অসংক্রামক রোগ মোকাবেলায় এক যুগান্তকারী উপায়। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টার, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ ওলংগং, যুক্তরাষ্ট্রের ক্লেমসন ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অফ উতাহ'র চার গবেষক এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন।
ঢাকার ১০টি পার্কে ১৬৯ জন মধ্যবয়সী নাগরিকের উপর ২০১৮ সালে পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, পার্কের নান্দনিকতা বা নিকটবর্তী অবস্থান যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলছে রোগীর স্বাস্থ্য অবস্থা এবং চিকিৎসকের পার্ক ব্যবহারের পরামর্শ।

চিত্রঃ গবেষণা চালানো ১০ টি পার্ক
চিকিৎসার নতুন দিগন্ত: ‘পার্ক প্রেসক্রিপশন’
এই গবেষণায় আলোচ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হচ্ছে—“পার্ক প্রেসক্রিপশন” (ParkRx)—যেখানে চিকিৎসকরা তাদের রোগীদের নির্দিষ্টভাবে পরামর্শ দেন যেন তারা নিয়মিত প্রাকৃতিক পরিবেশে সময় কাটান। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশগুলোতে ParkRx ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হলেও, গ্লোবাল সাউথ বা উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে এই ধারণা বাস্তবিকভাবে কতটা কার্যকর তা এই প্রথমবার বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে ঢাকার প্রেক্ষাপটে।
গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল:
রোগীরাই সবচেয়ে নিয়মিত ব্যবহারকারী: দুরারোগ্য অসংক্রামক রোগে (যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ) আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুস্থদের তুলনায় তিন গুণ বেশি নিয়মিতভাবে পার্ক ব্যবহার করেন।
চিকিৎসকের নির্দেশই বড় অনুপ্রেরণা: ParkRx পাওয়া ব্যক্তি পার্কে যাওয়ার প্রবণতা দেখিয়েছেন ছয় গুণ বেশি।
পরিচিত পরিবেশে মন টানে বেশি: যারা দীর্ঘদিন ধরে একই পার্কে আসছেন, তাদের পার্ক ব্যবহারের হার ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
সবুজের পরিমাণ ও সৌন্দর্য গৌণ: ঢাকায় পার্কের প্রাপ্যতা, অবস্থান বা সৌন্দর্য—এই প্রচলিত বিষয়গুলো পার্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেনি।
উন্নত দেশের শহর বনাম ঢাকা: দুই শহরের দুই চিত্র
উন্নত বিশ্বের শহরগুলোতে পার্ক ব্যবহারের অন্যতম শর্ত হচ্ছে তা পরিষ্কার, আকর্ষণীয় এবং কাছাকাছি থাকা। অথচ ঢাকায় যেখানে প্রতি ১০০০ জনে গড়ে মাত্র ০.০৩৯ হেক্টর সবুজ জায়গা রয়েছে, সেখানে পার্কগুলো অনেকটাই অযত্নে পড়ে আছে। তবুও এই গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা নাগরিকেরা প্রতিদিন সকাল-বিকাল এসব পার্কে যাচ্ছেন, কারণ তাদের জন্য এটি জীবনধারণের একটি অংশ।
ঢাকার মতো স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত চাপে থাকা শহরে, এই প্রবণতা আমাদের সামনে এক অভূতপূর্ব সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
নীতিনির্ধারকদের জন্য সুপারিশ:
ParkRx কে আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা ব্যবস্থার অংশ করুন: চিকিৎসকদের মাধ্যমে নিয়মিত পার্ক ব্যবহারের পরামর্শ রোগী ও স্বাস্থ্য খরচ—উভয়ের উপরই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
নগরের সবুজায়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ বাড়ান: যদিও গবেষণায় সৌন্দর্যের প্রভাব ততটা দেখা যায়নি, তবুও একটি পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ পার্ক দীর্ঘমেয়াদে আরও বিস্তৃত স্বাস্থ্য উপকারিতা দিতে পারে।
সবুজে যেন গরিবেরা স্থানচ্যুত না হন: উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নতুন পার্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যেন তা ধনী শ্রেণির দখলে চলে না যায় এবং গরিবদের বিতাড়িত না করে। মোদ্দা কথা, পার্কগুলোকে একটা গুরত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা মনে করে তা শহরের সকলের হাঁটা দূরত্বের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে।
পার্ক-ভিত্তিক সামাজিক গোষ্ঠীগুলোকে উৎসাহ দিন: ডায়াবেটিক রোগীদের হাঁটার দল, ব্যায়ামের দল, বা সাংস্কৃতিক ক্লাব—এসব গড়ে তুললে পার্ক ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পাবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এইরকম সংগঠনগুলোকে আর্থিক অনুদান দিয়ে হলেও নিয়মিত তাদের কার্যক্রম চালু রাখা উচিত।
সবুজের ছোঁয়ায় সুস্থ জীবন
এই গবেষণা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ঢাকার মতো বিশৃঙ্খল শহরে কীভাবে চিকিৎসক-নির্দেশিত সবুজ পরিবেশে সময় কাটানো একটি কার্যকর ও সহজলভ্য চিকিৎসার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। ParkRx-এর ধারাবাহিক বাস্তবায়ন একদিকে যেমন স্বাস্থ্যসেবা খাতে চাপ কমাবে, তেমনি নাগরিকদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতাও নিশ্চিত করবে।
সবশেষে বলা যায়, পার্ক কেবল বিনোদনের জায়গা নয়—এটি হতে পারে ঢাকার মতো শহরে একটি স্বাস্থ্যকর জীবনের মূল চাবিকাঠি।
লেখক, ড. ফয়সাল কবীর শুভ, সিডনী প্রবাসী নগরবিদ এবং উপরোল্লিখিত গবেষণার একজন গবেষক।