Logo
Logo
×

বিশ্লেষণ

বিএনপির বিরুদ্ধে মিডিয়ার পুরনো কৌশল ফিরে এসেছে

Icon

মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০১:১৯ পিএম

বিএনপির বিরুদ্ধে মিডিয়ার পুরনো কৌশল ফিরে এসেছে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের গণআন্দোলনের পর বড় পরিবর্তন এসেছে। অনেকেই ভেবেছিলেন, এই আন্দোলন সব রাজনৈতিক দলকে একসাথে এনে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। রাজনীতিতে এখন এক ধরনের মিডিয়া ক্যু চলছে, যেখানে ভুল তথ্য ছড়িয়ে বিভিন্ন দলগুলোকে দুর্বল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এইসব কার্যক্রম নতুন কিছু নয়। জুলাই ২০২৪-এর গণআন্দোলনের আগে, আওয়ামী লীগ ২ থেকে ২.৫ লাখ সাইবার টিম গঠন করেছিল বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য। এই সাইবার বাহিনী ভুল (misinformation) ও মিথ্যা (disinformation) তথ্য ছড়িয়ে, নানা গল্প বানিয়ে দলগুলোর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়েও একই ধরনের প্রচারণা চালানো হয়েছিল, যেখানে দেশি-বিদেশি মিডিয়া চার দলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিদিন পালাক্রমে নানা নেতিবাচক তথ্য প্রচার করেছিল। ২০০৬ সালে জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার সময়, অনেকেই মনে করত জোট সরকার মানেই অস্থিরতা ও দুর্নীতি। এই ধারণা মানুষের মনে বসে যায়, যার ফলে সেনা সমর্থিত সরকার আসার সুযোগ তৈরি হয়। এরপর রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে, আর বিএনপি ধীরে ধীরে কঠিন এক নির্মম রাজনৈতিক বাস্তবতা ও দীর্ঘ সংগ্রামের মুখোমুখি হয়।

তবে ২৪ এর গণআন্দোলনের পর আজও সেই পুরনো কৌশল চলছে, তবে এবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক ট্যাগিং, অনলাইন মিথ্যা প্রচারণা এবং সাইবার যুদ্ধ। এখন পুরনো ও নতুন রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে জনমত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এ কৌশলের মাধ্যমে সম্ভাব্য বিজয়ীদের দুর্বল দেখানোর জন্য অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে, বিএনপিই সবচেয়ে বেশি এই প্রচারণার শিকার হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক প্রচারণায় বিএনপিকে দেশজুড়ে সব অনিয়মের মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরছে। 

কেন বিএনপিকেই টার্গেট করা হচ্ছে?

গুপ্ত রাজনৈতিক দল, কিছু রাজনৈতিক নেতা, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ইউটিউবার, এমনকি কিছু ভুঁইফোঁড় সোর্স বিএনপিকে কখনো ভারতপন্থী, কখনো আওয়ামী লীগের গোপন বন্ধু, কখনো বিএনপিই বাংলাদেশের একমাত্র চাঁদাবাজ দল হিসাবে প্রচার করছে। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে বিএনপি নিয়মিতভাবে আওয়ামী লীগ ও ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে। তার নিজ দলের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি এবং বহিষ্কার করা সত্ত্বেও বিএনপির বিরুদ্ধে ক্রমাগত রাজনৈতিক ট্যাগিং ও লেবেল  দিয়ে  অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।  প্রশ্ন হলো—কারা এর পেছনে আছে এবং কেনই বা বিএনপি বারবার এরূপ টার্গেটে পরিণত হয়? এর উত্তর খুঁজতে হলে পুরনো শত্রুতা, রাজনৈতিক কৌশল এবং দেশি-বিদেশি স্বার্থের জটিল হিসাব-নিকাশ বুঝতে হবে।

১. পুরনো শত্রু: জাসদ ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা

বিএনপির বিরুদ্ধে একটি বড় গোপন শক্তি হলো বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) । ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর জাসদ ভেবেছিল তারা দেশের নেতৃত্বে আসবে। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাদের পেছনে ফেলে ক্ষমতা নেন, বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন এবং বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। এই পরাজয় জাসদের ছাড়াও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করে। অনেকে পরবর্তীতে বিএনপির সরকারের সাথে কাজ করলেও তাদের মধ্যে বিএনপির প্রতি এক ধরনের লুকানো বিদ্বেষ থেকে যায়। আজও অনেক ছুপা জাসদ ও আওয়ামী লীগ, বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিক নিজেদের নিরপেক্ষ বা বিএনপি-সমর্থক দেখালেও আসলে বিএনপিকে প্রতিনিয়ত দুর্বল ও হেয় করার চেষ্টা করে । এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন কিছু সাংবাদিক, কলাম লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক যারা একসময় বিএনপির ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এখন শুধু বিএনপির ব্যর্থতাগুলো তুলে ধরেন, কিন্তু অন্যান্য দলের একই ধরনের ভুলকে গুরুত্ব দেন না। আবার তারা কিন্তু সরাসরি বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলে না, কিন্তু ইনিয়ে বিনিয়ে এমনভাবে তারা প্রচার চালায় যাতে বিএনপিকে একটি দুর্বল, বিভক্ত, অপরিণামদর্শী ও ব্যর্থ দল হিসাবে দেখানো যায়।

২. বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখা: ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবী ও সিভিল সোসাইটির ভূমিকা 

বিএনপি সবসময় বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বকে গুরুত্ব দিয়েছে, যা অনেক সময় ভারতের কৌশলগত স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়েছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ সব সময় বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের অনায্য দাবিগুলো অনায়াসে মেনে নিত। তাছাড়া বাংলাদেশের অনেক বুদ্ধিজীবী, এনজিও, মিডিয়া ও সংস্কৃতি গ্রুপ ও ব্যক্তি আছে, যারা ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাংক, দাতা সংস্থা ও কৌশলগত প্রতিষ্ঠানের দ্বারা প্রভাবিত। এই প্রভাবের কারণে বিএনপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে একই ধরনের প্রচারণা দেখা গিয়েছিল, যখন বিএনপিসহ চারদলীয় জোট ক্ষমতায় ছিল। তখন—(ক) আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিএনপির শাসনকে দুর্বল ও ব্যর্থ দেখাতো; (খ) সিভিল সোসাইটির কিছু গোষ্ঠী মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও চরমপন্থার অভিযোগ তুলে বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট করত এবং (গ) কূটনৈতিক মহল আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে থাকত এবং বিএনপিকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখানো হতো । বর্তমানে ঠিক একই কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে বিএনপির বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে। আন্তর্জাতিক মহলে বিএনপিকে অনিশ্চিত, দুর্নীতিবাজ ও অস্থির রাজনৈতিক দল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যাতে তারা আওয়ামী লীগকেই নিরাপদ বিকল্প হিসেবে দেখে। এই পরিকল্পিত প্রচারণার কারণে বিএনপি সবসময় একটি সংকটের মধ্যে আটকে থাকে এবং সুস্পষ্টভাবে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে পারে না।

৩. বিএনপির মধ্যপন্থী রাজনীতির পথে পুনরায় ফিরে আসা ও তার প্রভাব

জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সময়, বিএনপি একটি মধ্যপন্থী দল হিসেবে পরিচিত ছিল, যা কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের চাপে না পড়ে জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে, বিএনপি বিভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে ইসলামপন্থী ও ডানপন্থী দলের সঙ্গে জোট গঠন করে। এখন দলটি আবারও সেই পুরনো মধ্যপন্থী অবস্থানে ফিরতে চাইছে, যাতে আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো যায় এবং দলকে আরও বিস্তৃত করা যায়।

এই পরিবর্তন বিএনপির পুরনো মিত্রদের অসন্তুষ্ট করেছে। যেসব ছোট দল বিএনপির সঙ্গে জোট করে সংসদে যাওয়ার সুযোগ পেত, তারা এখন নিজেদের দুর্বল মনে করছে। তারা মনে করছে, বিএনপি তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাই তারা বিএনপিকে আবার পুরনো জোটে ফেরানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল নিচ্ছে। তা কিভাবে? তারা বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার, অনলাইনে অপপ্রচার এবং নির্বাচনী চাপের কৌশল ব্যবহার করছে, যাতে করে—(ক) বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে আবার ছোট দলগুলোর সঙ্গে জোটে ফিরতে বাধ্য করা; (খ) বিএনপির নির্বাচনী কৌশল নষ্ট করা, যাতে তারা আসন ভাগাভাগির বিষয়ে সমঝোতা করতে বাধ্য হয় এবং (গ) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে বিএনপির সুনাম কাজে লাগানো, কিন্তু একই সঙ্গে নেতৃত্বকে দুর্বল করে নিজেদের রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখা।

৪. বিএনপির বিরুদ্ধে ডিজিটাল যুদ্ধের নেপথ্যে কারা?

বিএনপির বিরুদ্ধে অনলাইনে অপপ্রচার ও ডিজিটাল হামলা এখন আরও সুসংগঠিত এবং বিস্তৃত হয়েছে।  নতুন প্রযুক্তির সহায়তায় এআই-চালিত বট, ভুয়া সংবাদ নেটওয়ার্ক, এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুপরিকল্পিত আক্রমণ চালিয়ে বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এমনকি, অনেক ইউটিউব কনটেন্ট ক্রিয়েটর, যারা একসময় বিএনপির পক্ষে কথা বলত, এখন নিয়মিতভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। তারা সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবে অধিক ভিউ ও এনগেজমেন্ট পাওয়ার মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন তারা কেবল বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে এবং অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নয় কেন? এই প্রবণতাকে “ষড়যন্ত্র তত্ত্বের” আলোকে দেখলে মনে হয়, তারা হয়তো সচেতনভাবে বা অজান্তেই আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য বিএনপিকে দুর্বল করা এবং দেশের একমাত্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তিকে বিতর্কিত করে তোলা। 

এই ডিজিটাল অপপ্রচারের পেছনে আরও গভীর একটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। বিএনপি-জিয়া পরিবার দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়ে আসছে, যা অনেকের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদি বাংলাদেশ কখনো বিদেশি আগ্রাসনের শিকার হয়, তাহলে জিয়া পরিবারই একমাত্র দল যারা বাম-ডান ও ইসলামপন্থী দলগুলোকে একত্রিত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তাহলে কি বিএনপির পরিবর্তে জিয়া পরিবারকেই মূল লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে? এটি কি শুধুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নাকি আরও বড় কোনো আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার অংশ—জিয়া পরিবারকে মাইনাস করে বাংলাদেশকে আরো দুর্বল করে রাখা? আমরা কি অন্যভাবে ভাবতে পারি যে, কোনো বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বা গোয়েন্দা সংস্থা কি বাংলাদেশে একধরনের রাজনৈতিক পরীক্ষা চালাচ্ছে—দেখতে চাচ্ছে কিভাবে ইউটিউবার ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের ব্যবহার করে বাইরে থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়? শেষ পর্যন্ত, তাদের লক্ষ্য কি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, রাজনৈতিক ও অর্থনীতিকে বিদেশি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা? এ ধরনের পরিকল্পিত অপপ্রচার শুধু বিএনপির জন্য হুমকি নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্র, স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার এবং রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্যও ভয়ংকর এক সংকেত।

এই অপকৌশল কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে এরূপ ব্যবহার করা হয়েছে। ব্রাজিলে কট্টর ডানপন্থী নেতা জাইর বলসোনারোর সমর্থকরা অনলাইনে ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ওয়ার্কার্স পার্টিকে (PT) দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য রাজনৈতিক দল হিসেবে উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে নির্বাচনে বিজয় লাভ করেছিল। ভারতে ২০২১ সালে "টুলকিট কেলেঙ্কারি" নামে একটি ঘটনা ঘটে। ভারতের বিজেপি বলে, কংগ্রেস পার্টি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বদনাম করতে "টুলকিট" তৈরি করেছে।  বিজেপি নেতারা ও তাদের সমর্থিত মিডিয়া এটি প্রচার করে, যাতে মানুষের মনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সন্দেহ তৈরি হয়। অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে কংগ্রেস মোদির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ফলে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে এবং অনেক সমর্থক দূরে সরে যায়। এইভাবে মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে কংগ্রেসকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করা হয়। এখন বাংলাদেশেও বিএনপির বিরুদ্ধে একই ধরনের ডিজিটাল হামলা চলছে। 

৫. নতুন ছাত্র নেতৃত্বের দলের রাজনৈতিক কৌশল

বাংলাদেশের নতুন ছাত্র ও জনতার নেতৃত্ব দেশের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নতুন এক রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই ছাত্র সংগঠনগুলো বিএনপির বিরুদ্ধেও সক্রিয়ভাবে অবস্থান নিয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো, তারা নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং পুরনো দলগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে চায় না। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাই নতুন প্রজন্মের এই দলগুলো চায় একটি নতুন পরিচয় গড়ে তুলতে। তাদের ধারণা, বিএনপিকে সমর্থন করলে তারা জনগণের কাছে পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে যাবে। এজন্য তারা বিএনপিকে দুর্বল, অকার্যকর বা "পুরনো ধাঁচের দল" হিসেবে উপস্থাপন করে, যাতে তরুণ ভোটাররা বিএনপির দিকে না ঝোঁকে এবং তাদের নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

তবে শুধু ভাবাদর্শগত পার্থক্যই নয়, এই ছাত্র সংগঠনগুলোর ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিকল্পনাও বিএনপির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানের একটি বড় কারণ। তারা জানে, এখন ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকা কঠিন, তাই তারা নিজেদের রাজনৈতিক দরকষাকষির শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। বিএনপিকে দুর্বল করে তারা চায় ভবিষ্যতে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে। তাদের লক্ষ্য বিএনপিকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া, যেখানে বিএনপিকে আসন্ন নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি বা রাজনৈতিক সুবিধা দিতে বাধ্য করা যায়। কিছু ছাত্র সংগঠন হয়তো গোপনে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সমর্থনও পাচ্ছে, যারা চায় বিএনপি কখনোই শক্তিশালী হয়ে না উঠুক। স্পেনের পোদেমস পার্টির মতো, যারা প্রথমে বড় দলগুলোর বিরুদ্ধে ছিল, পরে জোট সরকারের অংশ হয়ে গেল, তেমনি এই ছাত্র সংগঠনগুলোও সরাসরি বিএনপিকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে চায় না, বরং বিএনপিকে দুর্বল করে নিজেদের শর্তে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চায়।

বিএনপির এখন করণীয় কি?

বিএনপিকে এখন আর শুধু ডিফেন্সিভ পজিশনে থাকলে চলবে না, বরং নিজের অবস্থান শক্ত করতে আরো সক্রিয় হতে হবে। নিজেদের ভাবমূর্তি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আধুনিক কৌশল নিতে হবে এবং নতুন পরিকল্পনা করতে হবে। প্রথমত, বিএনপিকে তরুণদের দল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রথমবারের মতো ভোট দেওয়া তরুণদের আকৃষ্ট করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, জেরেমি করবিনের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির মতো, বিএনপিরও তৃণমূল পর্যায়ে সক্রিয় হতে হবে, ডিজিটাল প্রচারণা বাড়াতে হবে এবং নতুন নেতৃত্বকে সামনে আনতে হবে। বিএনপিকে এমন তরুণ, শক্তিশালী নেতা আনতে হবে, যারা বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতে পারে এবং দলকে নতুনভাবে উপস্থাপন করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, বিএনপিকে অনলাইনে আরও শক্তিশালী হতে হবে এবং ভুয়া প্রচারণার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ডিজিটাল "ওয়ার রুম" তৈরি করেছিল, যেখানে তারা ভুয়া তথ্য সঙ্গে সঙ্গে খণ্ডন করত। বিএনপিরও উচিত এআই-ভিত্তিক তথ্য যাচাই ব্যবস্থা চালু করা এবং নিজেদের ডিজিটাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা (যেমন ইউটিউব চ্যানেল, পডকাস্ট, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম)। একই সঙ্গে, আল জাজিরা, রয়টার্স, বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রচার নিয়ে বিশ্ববাসী জানতে পারে।

তৃতীয়ত, বিএনপিকে ঢাকা ছাড়িয়ে দেশের গ্রামাঞ্চলে আরো শক্ত সংগঠন তৈরি করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের বিজেপি "বুথ লেভেল ম্যানেজমেন্ট" কৌশল ব্যবহার করে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সংগঠন তৈরি করেছে, বিএনপিকেও একইভাবে প্রতিটি এলাকায় সক্রিয় হতে হবে, ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ বাড়াতে হবে এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। এছাড়া, মোবাইল-ভিত্তিক রাজনৈতিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে গ্রামাঞ্চলে বিএনপির বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে এবং যেকোনো প্রচারের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে হবে।

চতুর্থত, বিএনপিকে নতুন কৌশলে জোট গঠন করতে হবে। বিএনপির দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ছোট দলগুলোর চাপে পড়া বিএনপির জন্য ভালো না। বরং অন্যান্য মধ্যপন্থী ও জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সঙ্গে কৌশলগত জোট গড়ে তুলতে হবে, যাতে নির্বাচনে সুবিধা পাওয়া যায়। একই সঙ্গে, ওয়াশিংটন, লন্ডন এবং ব্রাসেলসে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়িয়ে, লবিস্টদের সঙ্গে কাজ করে বিএনপির বিরুদ্ধে ভুয়া প্রচারণার জবাব দিতে হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করতে হবে।

সবশেষে, বিএনপির ভেতরে সংস্কার আনতে হবে, যাতে দল আরও সংগঠিত ও বিশ্বাসযোগ্য হয়। নতুন, কর্মক্ষম নেতাদের সামনে আনতে হবে, আর যারা অকার্যকর, তাদের সরাতে হবে। দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচন চালু করলে বিএনপি জনগণের কাছে স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

যদি বিএনপি এখনই নিজেদের কৌশল না বদলায়, তাহলে তারা মিডিয়া প্রচার, ডিজিটাল হামলা ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার চক্রে আটকে থাকবে। যদি এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে বিএনপি আবারও শক্তিশালী ও বাংলাদেশে একমাত্র প্রধান দল হয়ে উঠতে পারে এবং ভবিষ্যতে যেকোনো অবস্থায় জয়ের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। 

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়


Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন