আল জাজিরার প্রতিবেদন
চরম নিরাপত্তাহীনতা ও অপরাধ বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ

মেহেদী হাসান মারুফ
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৫, ০২:০১ পিএম

মাইদুল হাসান যখন প্রথমবার ছিনতাইয়ের শিকার হন, তখন মনে করেছিলেন, এর চেয়ে খারাপ কিছু হতে পারে না। কিন্তু মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে, ২১ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী আবারও হামলার শিকার হন এবং পুলিশ সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও কিছুই করেনি বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
হাসান, যিনি গত বছর শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের বিরুদ্ধে হওয়া ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, এখন ভাবছেন যে দেশটি কী অবস্থায় পৌঁছেছে। "এটাই কি আমার লড়াইয়ের ফল?" তিনি বলেন, "দেশ অপরাধের জালে ডুবে গেছে, কিন্তু কেউ যেন কিছুই ভাবছে না।"
১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে, রাজধানীর মিরপুরে অফিস থেকে ফেরার পথে একদল অপরিচিত লোক তাকে ঘিরে ধরে এবং তার ফোন, ওয়ালেট, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি ও হেডফোন কেড়ে নেয়।
এর পাঁচ দিন পর, ১৮ ফেব্রুয়ারি, তিনি আবারও হামলার শিকার হন। এবার হামলাকারীরা তাকে মারধর করে তার নতুন কেনা Google Pixel 7 ফোন ছিনিয়ে নেয়, যা তিনি ৪০০ ডলারের ঋণ নিয়ে কিনেছিলেন। পুলিশের উপস্থিতিতেই এই ঘটনা ঘটে, কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে দাবি করেন হাসান।
যখন তিনি থানায় অভিযোগ জানাতে যান, তখন এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সদস্য বলে পরিচয় দেন, তাকে অভিযোগ করতে নিরুৎসাহিত করেন। ওই ব্যক্তি বলেন, "আমি তোমার ফোন খুঁজে দেব," এবং থানার বাইরে নিয়ে গিয়ে তার কাছ থেকে ৩,৫০০ টাকা আদায় করেন। পরে হাসান জানতে পারেন, ওই ব্যক্তি একসময় ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন—যা রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার পরিচয় দেয়।
হাসান পরে অনলাইনে অভিযোগ দায়ের করেন, তবে কোনো প্রতিকার পাননি।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "এই দেশে ভুক্তভোগী হয়েও পুলিশের কাছেই হয়রানির শিকার হতে হয়। অপরাধীরা পুলিশের সামনেই দাপিয়ে বেড়ায়, কিন্তু পুলিশ কিছুই করে না। আমি কাঁদলাম, অনুরোধ করলাম, কিন্তু তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখল,"—ফেসবুকে তার দেওয়া এই পোস্ট মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়।
দেশজুড়ে অপরাধের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে ২৪২টি ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যা গত ছয় বছরে সর্বোচ্চ। একই মাসে খুনের ঘটনা ২৯৪টি নথিভুক্ত হয়েছে, যেখানে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এ সংখ্যা ছিল ২৩১।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজমুস সাকিব বলেন, "মানুষ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, কিন্তু এখন তারা ঘর থেকে বের হতেও ভয় পাচ্ছে। এটি আমাদের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার জন্য ভালো বার্তা নয়।"
সরকারের ব্যর্থতা ও প্রতিক্রিয়া
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এসব উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, "আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।"
কিন্তু বাস্তবতা অন্য কথা বলছে। রাজধানীর ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ২ কোটি ৮১ লাখ টাকার স্বর্ণ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তার পায়ে গুলি চালিয়ে ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যায়।
বাড়ছে অপরাধ, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ
একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর রাজধানীজুড়ে ক্ষোভ ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে চৌধুরীর পদত্যাগের দাবি তোলে আন্দোলনকারীরা। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশজুড়ে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, চাঁদাবাজির মতো সহিংস অপরাধের ঘটনা বেড়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ভয়ংকর সব ভিডিও ও ভুক্তভোগীদের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়েছে।
রিকশাচালক রহমত উল্লাহ (৫০) বলেন, “আগেও চুরি-ছিনতাই হতো, কিন্তু এখন তো মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ১৭ বছর ধরে রিকশা চালাচ্ছি, এমন ভয়ানক অবস্থা কখনো দেখিনি। আমার যাত্রীরাও হামলার শিকার হচ্ছে।”
তিনি জানান, আগে মাসে একবার টাকা জমিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবারে পাঠাতেন, এখন প্রতিদিনই মোবাইল ফাইন্যান্সিং সার্ভিস দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
তবে সরকার এখনো এই সংকট পুরোপুরি স্বীকার করতে চায়নি। আইনমন্ত্রী আসিফ নজরুল স্বীকার করেছেন, প্রশাসনের দুর্বলতা আছে, তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে। “কখনো পরিস্থিতি ভালো, কখনো খুবই খারাপ। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি,” বলেন তিনি।
বিক্ষোভে উত্তাল ক্যাম্পাস, ধর্ষণ ও নিরাপত্তাহীনতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ
দেশজুড়ে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে অন্তত ১০টি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থী ইতি আক্তার বলেন, “আমার বাবা-মা প্রতিদিন ভয় পান আমি বাইরে গেলে। আমাদের একটাই চাওয়া, স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চাই—না ধর্ষণের শিকার হয়ে, না ছিনতাইকারীর হাতে আহত হয়ে।”
আরেক বিক্ষোভকারী তানভীর রিফাত বলেন, “আগে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ছাত্রলীগকে জড়িয়ে নিরাপত্তাহীনতার কথা বলা হতো। এখন আওয়ামী লীগ নেই, কিন্তু অপরাধ কমেনি, বরং বেড়েছে।”
তিনি ঢাকার রাস্তাকে ব্যাটম্যানবিহীন "গথাম সিটির" সঙ্গে তুলনা করে বলেন, "আমরা যেটা ভেবেছিলাম, গণঅভ্যুত্থানের পর দেশটা নিরাপদ হবে। কিন্তু এখন মনে হয়, যেকোনো মুহূর্তে সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হতে পারে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, “একটা শহর কতটা নিরাপদ, সেটা বোঝার প্রধান উপায় হলো মানুষ ঘর-বাইরে ও যাতায়াতের সময় কতটা নিরাপদ বোধ করে। আর এখন কেউই নিরাপদ মনে করছে না।”
অপরাধ দমনে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’, কিন্তু অপরাধ কমেনি
৮ ফেব্রুয়ারি সরকার যৌথ সামরিক-পুলিশি অভিযানের মাধ্যমে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু করে অপরাধ দমনের চেষ্টা চালাচ্ছে। এ অভিযানে ৯,০০০-এর বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু সহিংস অপরাধের ঘটনা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মুবাশ্বার হাসান মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনিকভাবে দুর্বল। “নির্বাচিত সরকারের মতো সুসংহত শৃঙ্খলা এখানে নেই। সরকার বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের মানুষ নিয়ে গঠিত, যাদের লক্ষ্যও ভিন্ন।”
২৪ ফেব্রুয়ারির সংবাদ সম্মেলনের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ ২৪৮ জন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু "গ্রেপ্তার করলেই হবে না, আমরা যদি রাস্তায় নিরাপদ অনুভব না করি, তাহলে সেটা কোনো সমাধান নয়," বলছেন ২১ বছর বয়সী শিক্ষার্থী হাসান।
নিজেরা নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছে নাগরিকরা
নিরাপত্তাহীনতা এতটাই বেড়েছে যে বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়রা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দল গঠন করছে। ব্যাট ও লাঠি হাতে পাহারা দিচ্ছে এলাকার মানুষ।
২৫ ফেব্রুয়ারি একদল জনতা দুই ছিনতাইকারীকে ধরে মারধর করে এবং ঢাকা ফুটওভার ব্রিজের নিচে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখে। একই রাতে আরেকজন সন্দেহভাজন ছিনতাইকারী গণপিটুনিতে মারা যায়।
এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে, আর প্রশাসনের পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
আইনের প্রতি আস্থা কমায় গণপিটুনি ও অপরাধের বাড়বাড়ন্ত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলছেন, "যখন মানুষ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বিশ্বাস হারায়, তখনই তারা নিজেরাই বিচার করতে নামে।"
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানায়, শুধু জানুয়ারিতেই দেশে গণপিটুনিতে ১৬ জন নিহত হয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হাসিনা সরকারের পতনের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতাই অপরাধ বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক সাকিব বলেন, “অপ্রত্যাশিত ক্ষমতার পরিবর্তন আইনের শূন্যতা তৈরি করে, যা অপরাধীদের সুযোগ দেয়।”
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের প্রধান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুলিশের প্রতি জনসাধারণের আস্থা এখন কমে গেছে। “হাসিনার বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ চলাকালে পুলিশ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল। জনগণের কাছে পুলিশের ‘নৈতিক কর্তৃত্ব’ দুর্বল হয়ে পড়ায় তারা কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।”
পুলিশের অদল-বদল ও অপরাধীদের জামিনে মুক্তি পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে
হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঢাকার ৫০টি থানার ওসিদের বদলি করে, কারণ তাদের আগের সরকারের ঘনিষ্ঠ মনে করা হয়েছিল।
সাকিব বলেন, "নতুন কর্মকর্তারা তাদের এলাকায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় সংযোগ ও কৌশল তৈরি করতে পারেননি। ফলে অপরাধীরা এই শূন্যতা কাজে লাগাচ্ছে।"
ঢাকা মহানগর পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, "অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে জামিন পেয়েছে এবং তারা আবারও চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালু করেছে। আমরা আদালতে জামিন বাতিলের আবেদন করব, কিন্তু সমস্যাটা হলো, যারা ক্ষমতায় আছে তারাই অনেক অপরাধীর মুক্তির ব্যবস্থা করেছে।"
সাকিব মনে করেন, অপরাধীদের এই গণহারে জামিন দেওয়া ভয়ংকর বার্তা দিচ্ছে। "আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এটি ঘটলেও এত দ্রুত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মুক্তি দেওয়া উচিত হয়নি। জননিরাপত্তা বিবেচনা না করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।"
রাজনৈতিক সহিংসতায় লুট হওয়া অস্ত্র ছড়িয়ে পড়েছে অপরাধীদের হাতে
রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় লুট হওয়া অস্ত্র এখন অপরাধীদের হাতে চলে গেছে। এতে ঢাকা শহরে সশস্ত্র ছিনতাই বেড়েছে। মুখোশধারী সশস্ত্র অপরাধীদের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যা জনমনে আতঙ্ক বাড়িয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান বলেন, "একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বেশি কার্যকর হবে। জনগণের নির্বাচিত সরকার থাকলে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও শক্তিশালীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।"
নির্বাচন কবে হবে? তরুণদের প্রশ্ন
ইউনূস সরকারের মুখপাত্র শফিকুল আলম জানিয়েছেন, "২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে।" তবে তরুণদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি গভীর হতাশা তৈরি করেছে।
বিক্ষোভকারী রিফাত বলেন, "আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম একটি নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য, যেখানে রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু এখন আমরা অপরাধীদের দয়ার ওপর নির্ভর করছি—যারা হয়তো ভবিষ্যতের শাসকদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত!"
মেহেদী হাসান মারুফ ঢাকাভিত্তিক সাংবাদিক, যিনি নেত্র নিউজ-এর প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করছেন এবং আল জাজিরা ইংরেজির জন্য স্বাধীনভাবে বাংলাদেশ সংক্রান্ত সংবাদ কভার করেন। আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন তারেক খান