Logo
Logo
×

বিশ্লেষণ

কৃতিত্বের কাতুকুতু এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান

ড. মো. আদনান আরিফ সালিম

ড. মো. আদনান আরিফ সালিম

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৭ পিএম

কৃতিত্বের কাতুকুতু এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান

উত্তরাধুনিকতা কিছু না হোক আমাদের প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে, তাই আমরা প্রশ্ন করতে পারি। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের অতলে তলিয়ে গিয়েও লাভ হয় না। তারপরেও প্রশ্ন করে যেতে যায়। ঠিক যেমন কেউ যদি প্রশ্ন করে ‘বাঙলাদেশের বেশিরভাগ মেয়ে বেশ গর্ব করে তার মায়ের শাড়ি পরে,তারপর সেগুলো নিয়ে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে’। এমনকি অনেক মেয়েকে বিয়ের পর তার শাশুড়ির শাড়ি পরেও বেশ উৎফুল্ল হতে দেখা যায়। কিন্তু ছেলেদের সচরাচর কখনই তার বাবার লুঙ্গি পরে সেটা নিয়ে উল্লাস করতে দেখা যায় না, ঠিক তেমনিভাবে বিয়ের পর শ্বশুরের লুঙ্গির ক্ষেত্রেও বক্তব্য তথৈবচ। 

ডিম আগে নাকি মুরগি আগে এই প্রশ্নটা এখন বড্ড সেকেলে। তার বিপরীতে সবাই প্রশ্ন করতে পারেন ‘মানুষ এখন ছবি তোলার জন্য বিয়ে করে, নাকি বিয়ে করেছে সেই স্মৃতি ধারণ করার জন্য ছবি তোলে? যাই হোক এই বিয়ের ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে এর আগে ও পরের আরও অনেকগুলো আচারানুষ্ঠান যুক্ত হয়েছে গেছে। উদাহরণ হিসেবে ব্রাইডাল শাওয়ার কিংবা বেবি শাওয়ারের বাক্যালাপে উল্লেখের অনুপযুক্ত ফটোগ্রাফিও এখানে উদাহরণ হতে পারে। 

বিশেষত, আরেকটি অদ্ভুতুড়ে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে বেবি শাওয়ারের সময় হবু মায়ের বন্ধুরা যেভাবে যেখানে হাত রেখে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (বিশেষত, ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম) ঝড় তুলে থাকেন। একবার ভেবে দেখেন এই বেবি শাওয়ার অনুষ্ঠানে গিয়ে হবু বাবার বন্ধুরা যদি একইভাবে দলবেঁধে ছবি তুলতে যায়! তাহলে তাদের কোথায় হাত রাখবে? একবার ভাবতে গেলেও অনেকে শিউরে উঠবেন। 

এজন্যই সাম্প্রতিক জুলাই-আগস্টের শিক্ষার্থী জনতার বিপ্লবের কৃতিত্ব কার? সেই প্রশ্নটি অভিন্নরকম ব্যঞ্জনা তৈরি করে। আর হয়তো সেজন্যই বিপ্লবীদের কেউ কেউ হবু মায়ের উদরে হাত রেখে ছবি তোলার মতো পুরো কৃতিত্ব নিজের দাবি করছেন। কেউ কেউ হবু বাবার মতো নীরব থেকে গেছেন। ওদিকে রবি ঠাকুর নাকি বলেছিলেন “অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার ধরিয়া রাখার মত বিড়ম্বনা আর হয় না”। বর্তমান বাংলাদেশ মূলত এই কৃতিত্ব ধারণ কিংবা পরিত্যাগের বিড়ম্বনায় অপেক্ষাকৃত বিপন্ন সময় পার করছে। 

রুশতি সেনের লেখা বিভূতিভূষণের গল্পগুচ্ছের সেই ভূমিকার মতো ‘গল্পহীন কিছু গল্প’ ঘিরে ধরেছে আমাদের চারপাশকে। এক একটি অঘটন নতুন আরেক অঘটনের মাধ্যমে শেষ হয়, যার রেশ থাকতে থাকতে ভুলে গিয়ে চিন্তা করতে হয় নতুন করে। ফলে কোনো শিরিষের ডালপালা যেভাবে পত্রমোচী পক্ষকাল পার করার আগেই নতুন করে গড়ে নেয় নিজেকে, ঠিক সেভাবেই অদল-বদল ঘটে যাচ্ছে চিন্তাগুলোতে। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থান উত্তরকালের বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রতিবেশ ঠিক সেই পুকুরটির মতো যেখানে স্কুলফেরত বাচ্চারা সমানে ঢিল ছুড়তে থাকে। আর সেখানকার পানিতে অবিন্যস্ত আন্দোলন ঘটে একের পর এক। সর্বশেষ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ শেষ হতে না হতেই এম সি কলেজ ছাত্রবাসের তাণ্ডব, তারপর ফেসবুকের হোমপেইজ রিফ্রেশ করতেই তামিরুল মিল্লাতের অস্থিরতা নিয়ে পোস্টের পর পোস্ট। এর বাইরে বাংলাদেশের নানা স্থানে একের পর পর বিপ্লবের অংশীজনদের পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার সংবাদ বেশ ফলাও করে প্রচার হতে দেখা যাচ্ছে।

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক। সেখানে ছাত্রদল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ (যাদের রাজনৈতিক পরিচয় লুকানো বলে সন্দেহ করছে অনেকে); তারা যে সহিংস সংঘর্ষ জন্ম দিয়েছে তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত নিন্দনীয়। সেখানে ভিডিও ফুটেজ ও ফটোগ্রাফিক এভিডেন্স হিসেবে যে স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে তা বিগত ফ্যাসিবাদী আমলের হিংস্রতার কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে সবাইকে। ছাত্রদলের কর্মীদের সঙ্গে সংঘাতের সময় সেখানে তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের (পরিচয় নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে) উপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে যে হামলা করেছে তার পরিচয় প্রকাশ হয়ে যায়। তার পরিচয় উন্মোচনের পর যুবদল থেকে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে তাকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। কিন্তু তার এই বহিষ্কারের আগে অনেকে গুরুতর আহত হয়েছেন। ওদিকে হামলা, পাল্টা হামলার ফাঁকে একদল দুর্বৃত্ত গিয়ে আক্রমণ করেছে কুয়েটের মাননীয় উপাচার্যকে। শিক্ষাঙ্গণের মধ্যে এই ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন এবং ধ্বংসাত্মক। এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যে সরাসরি সন্ত্রাসী ডেকে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করানো অনেক তস্কর উপাচার্যকেও তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করেনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংঘাত অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও অবাস্তব কিছু নয়। তবে এবারের সংঘাত নতুন এক ভয়াবহ বার্তা নিয়ে হাজির হচ্ছে, যে বার্তা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ আমাদের দিয়েছিল। তাদের এই বার্তা ছিল মনুষ্যত্বচ্যুতি তথা বিমানবীকরণের (Dehumanization) সঙ্গে সম্পর্কিত। ঠিক যেমন ধারণা নাজি জার্মানিতে উৎপাদন করা হয়েছিল ইহুদী নিধনের জন্য অথবা ওয়্যার অন টেররের যুগে নির্মাণ করা হয়েছিল মুসলিম বিশ্বে তাণ্ডব ছড়াতে। শাহবাগ থেকে একরকম বৈধতা তৈরি করা হয় যে কেউ ছাত্রদল-ছাত্রশিবির, বিএনপি কিংবা জামায়াতের রাজনীতি করলে তার মানবিক সত্তা নাই। 

তাই শাহবাগী এই বয়ানের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীকালে ছাত্রদল কিংবা শিবির সন্দেহে অনেকের উপর হামলাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল ক্ষমতাসীনদের সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ। তারা এই রাজনৈতিক সন্দেহ থেকেই হিন্দুধর্মের অনুসারী হওয়ার পরেও দর্জি বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল প্রকাশ্য দিবালোকে। তারা অভিন্নরূপে শিবির সন্দেহ হওয়াতে খোদ বুয়েটে হলের মধ্যে রাতভর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেছিল শহীদ আবরার ফাহাদকে। এইরকম শতশত উদাহরণ দেওয়া সম্ভব ঐ সময়ের সংবাদ পর্যালোচনা করতে গেলে। আর সবগুলো আক্রমণ, হামলা ও হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি আয়নাঘরের মতো নারকীয়তার পক্ষে একরকম বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনোজাগতিক বৈধতা উৎপাদন করেছিল শাহবাগের মনুষ্যত্বচ্যুতি তথা বিমানবীকরণের (Dehumanization) উদ্দেশ্যে মঞ্চায়িত প্রকল্প। 

সম্প্রতি এই প্রকল্প নতুনভাবে শুরু হলে যে কেউ তার হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য যে কাউকে ‘ছাত্রলীগ’ কিংবা আগের মতো ‘শিবির’ ট্যাগ দিয়ে হত্যা করতে চাইবে। ৫ আগস্ট পার করে এসে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সাদা চোখে দেখার সুযোগ নাই। কারণ নতুন শহীদ মিনার তৈরির পর পুরাতনটাকে ভেঙ্গে ফেলার ভিডিওকে ফলাও করে দেখানো হয়েছে যে একদল লোক শহীদ মিনার ভাঙ্গছে। এমনি নানা ঘটনার ঘনঘটায় মিথ্যাচারের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তাই এখনকার এই ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’, ‘তৌহিদি জনতা’, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ কিংবা ‘জানাক’ ঠিক রাজনৈতিক নাকি অরাজনৈতিক নাকি আরোপিত কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে তা স্পষ্ট করে বলা কঠিন। 

তবে বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থী নাম নিয়ে যারা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত সুবিধা সামনে রেখে যাই করছে তাদের উচিত রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করা। যদি সেটা না করা হয় তাহলে হঠাৎ করে মঞ্চস্থ ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ ভার্সেস ‘ছাত্রদল’ কিংবা ভার্সেস শিবিরের যে গল্প তা বেশিদিন হালে পানি পাবে না। তবে কোনো রাজনৈতিক দল একই সঙ্গে প্রকাশ্য এবং গোপন দুটি ধারায় রাজনীতি করতে চাইলে সেটা নিঃসন্দেহে তাদের এবং অন্যদের জন্যও বিপদজনক।

এমনি পরিস্থিতিতে নন্দিত সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়েরের দীর্ঘ লেখাটি জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অংশীজনদের বিভিন্নরকম ভূমিকাকে নতুনভাবে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। স্ট্যানলি কোহেনের (Stanley Cohen) লেখা Folk Devils and Moral Panics বইটা পড়ে সমাজবিজ্ঞানের অনেক শিক্ষার্থী কিংবা গবেষক যখন নতুন করে পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করেছেন, সেখানে জুলকারনাইনের লেখা নিঃসন্দেহে একটা ছেদবিন্দু হিসেবে কাজ করবে। কোহেনের চিন্তা ধার করে সন্দেহ করাই যেতে পারে যে দেশের নানা প্রান্তে সংঘঠিত অঘটনগুলোকে হয় কেউ পরিকল্পিতভাবে করাচ্ছে যেখানে রাষ্ট্রীয় ইন্ধন রয়েছে, নচেৎ রাষ্ট্রতরফ থেকে এই ধরনের অঘটনগুলোকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে। 

তবে আন্দোলনের অংশীজনরা তাদের একক কৃতিত্ব দাবি করার পাশাপাশি পরস্পর কাদা নিক্ষেপের যে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সেই পরিস্থিতিতে জুলকারনাইনের লেখা নতুন আলোর সন্ধান দিতে পেরেছে। এক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের মতো একটা ধারণা স্পষ্ট যে জুলাই গণঅভ্যুত্থান কোনো ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর একক কৃতিত্ব নয়। এখানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আলাদা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আর তাই কৃতিত্বের কাতুকুতু সামনে রেখে জুলাইয়ের অংশীজনদের মধ্যে যে চলমান সংঘাত তা যত দ্রুত এবং যেভাবে সম্ভব বন্ধ করতে হবে। নচেৎ এই সংঘাত দেশকে নিরন্তর অশান্তির দিকে ঠেলে দেবে। 

৫ আগস্ট পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পূর্বের কৌশলের সংঘাতের রাজনীতি চালু রাখলে তা প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করবে। অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে কোনো পক্ষ থেকে সহিংসতা উস্কে দিতে থাকলে তা বর্তমানের উত্তাল পরিস্থিতিতে দেশবিরোধীদের ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ করে দেবে। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন