বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঝুঁকিতে: সুরক্ষার পথ কী
দ্য ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদন
শফি মো. মোস্তফা
প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:০২ পিএম
ঢাকায় গত ৯ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। ছবির ক্রেডিট: প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক রয়েছে, যে-সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক সৌহার্দ্য এবং উত্তেজনাও। সহযোগিতা এবং সংঘাতের এই জটিল সম্পর্কের মধ্যে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতা থেকে সরে যান। তার প্রস্থান এবং প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের উত্থানের পরে ভারত এবং আওয়ামী লীগের সম্পর্ক ব্যাহত হয়, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশে ইসকনের প্রাক্তন নেতা চিন্ময় দাশের গ্রেপ্তারসহ সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ইতিমধ্যে অস্থির পরিস্থিতিতে শুধু ইন্ধন দিয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এবং কূটনৈতিক সম্পত্তির উপর হামলা সেই উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে, দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্কের ভঙ্গুরতাকে তীব্রভাবে ফোকাস করেছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে ভারত ঐতিহ্যগতভাবে আওয়ামী লীগের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কয়েক দশক ধরে এই সম্পর্ক কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় উপকারী হলেও, বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং অংশগুলিকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। হাসিনার দীর্ঘমেয়াদি শাসন ভারতের প্রভাবকে আরও মজবুত করেছে, কিন্তু একটি একক রাজনৈতিক সত্তার প্রতি ভারতীয় পক্ষপাতিত্বের ধারণাও বাড়িয়ে দিয়েছে। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সাথে সাথে, কেবল একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদারের ক্ষতিই নয়, বরং অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে ভারত তার সম্পর্ক নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিশ্বাস পুনর্গঠনে চ্যালেঞ্জে মুখোমুখি হয়েছে। অমীমাংসিত দ্বিপাক্ষিক সমস্যা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধির ফলে সেই চ্যালেঞ্জ আরও তীব্র হয়েছে।
চিন্ময় রায়ের গ্রেপ্তার, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কারণে কূটনৈতিক স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রীর ঢাকা সফরের উদ্দেশ্য ছিল এই উদ্বেগগুলো দূর করা। বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার আলোচনা উভয় পক্ষের গভীর ক্ষোভের কথা তুলে ধরে।
বাংলাদেশ সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে ভারতের উদ্বেগ স্বীকার করে, কিন্তু তার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগত মন্তব্যকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতিগুলি একটি স্পষ্ট বার্তার উপর জোর দিয়েছে: বাংলাদেশ সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক সম্মান এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অ-হস্তক্ষেপ আশা করে। এই দৃঢ় অবস্থান বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে। এবং হাসিনার শাসনামলে নির্ধারিত প্যারামিটারের বাইরে ভারতের সাথে বাংলাদেশ তার সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার ইচ্ছার ইঙ্গিত দেয়।
এই কূটনৈতিক সংঘর্ষের অন্তর্নিহিত দীর্ঘস্থায়ী অমীমাংসিত সমস্যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ওপর চাপ অব্যাহত রাখছে। সীমান্ত হত্যা একটি গভীর বিতর্কিত বিষয় রয়ে গেছে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ঘন ঘন হত্যার ঘটনা বাংলাদেশি জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির অগ্রগতি হয়নি, যা বাংলাদেশের জনমতকে আরও উত্তেজিত করেছে। এই ব্যর্থতাগুলি, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং অ-শুল্ক বাধাগুলি—ভারত উপেক্ষা করছে, যা বাংলাদেশের জনগণ গভীরভঅবে উপলব্ধি করছে।
২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় বিতর্কিত সফরের সময় এই ধরনের অনুভূতির উত্থান সবচেয়ে স্পষ্ট হয়েছিল, যা সহিংস প্রতিবাদের সূত্রপাত করেছিল এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বৃহত্তর পরিবর্তন এনেছে। এসব নানা কারণে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সত্ত্বার সাথে শ্রেণিবদ্ধ হওয়ায় ভারতের ঐতিহাসিক কৌশলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতাকে স্পষ্ট করেছে। এমনকি জুলাই বিপ্লবের সময়ও রাস্তায় “দিল্লি না ঢাকা: ঢাকা, ঢাকা” স্লোগান দেওয়া হয়েছিল। যদিও এই প্রচারাভিযানগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রয়ে গেছে জনসংখ্যার কিছু অংশের মধ্যে। এর অনুরণন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের আধিপত্যের উপর গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতি-বিষয়গুলিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলমানদের প্রান্তিককরণ এখানে স্মরণীয়, যে-কারণে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের গভীর বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে তা ভারতের নজরে পড়েনি। ভারতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং বৈষম্যমূলক নীতি বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব জাগিয়েছে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রাথমিক বছরগুলিতে যে সদিচ্ছার চর্চা হয়েছিল তা নষ্ট করেছে। ভারতের রাজনৈতিক বক্তৃতায় মুসলমানদের অমানবিকীকরণও সীমান্তের ওপারে প্রবল প্রভাব ফেলেছে।
বর্তমান কূটনৈতিক অচলাবস্থা দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়। ভারতকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আওয়ামী লীগের উপর তার দীর্ঘদিনের নির্ভরতা বাংলাদেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলিকে বিচ্ছিন্ন করেছে। বিরোধী দল, সুশীল সমাজ এবং তৃণমূল সংগঠনগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি বিস্তৃত সম্পৃক্ততার কৌশল নিয়ে বিশ্বাস পুনর্গঠন এবং আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা অপরিহার্য। সীমান্ত হত্যা এবং পানি বণ্টন চুক্তির মতো বিতর্কিত সমস্যার সমাধান বাংলাদেশের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণের প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করবে। এই পদক্ষেপগুলি শুধু তাৎক্ষণিক অভিযোগের সমাধান করবে না, বরং আরও স্থিতিস্থাপক এবং টেকসই অংশীদারিত্বের ভিত্তি তৈরি করবে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এর মুসলিম জনসংখ্যার প্রতি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব প্রশমিত করতে এবং সম্প্রীতি ও বৈচিত্র্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আঞ্চলিক নেতা হিসাবে ভারতের ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে। এই পরিবর্তনের জন্য শুধু নীতি পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে না, বরং ভারতের বৃহত্তর রাজনৈতিক বর্ণনার পুনর্বিন্যাসও প্রয়োজন হবে, যা প্রায়শই আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক সংহতির মূল্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
শেখ হাসিনার পতন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের গতিশীলতাকে বদলে দিয়েছে। ঐতিহাসিক ক্ষোভের সমাধান এবং একটি দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার মাধ্যমে, বাংলাদেশ ও ভারত বর্তমান অচলাবস্থার বাইরে যেতে পারে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সহযোগিতা এবং শেয়ার করা সমৃদ্ধির বৈশিষ্ট্যযুক্ত ভবিষ্যতের দিকে কাজ করতে পারে। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে একটি স্থিতিশীল এবং গঠনমূলক অংশীদারিত্বের পুরষ্কারও অনেক।