সেকালের ‘জয় বাংলা’ একালের ‘জয় বাংলা’ এবং ‘বয় জংলা’
‘একটা কথায় ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে/ সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে’। কবি নবারুণের এই কথার ফুলকিকেই আমরা চিনি শ্লোগান হিসেবে। কিছু শ্লোগান রক্তে আগুণ জ্বালে, হৃদয়ে ধনুকের মতো টংকার তোলে, ব্রহ্মতালুতে গিয়ে আঘাত করে একান্ত আপন অনুষঙ্গে। যদি পরিপার্শ্বিক বাস্তবতায় সে শ্লোগানের সুর, তাল ও লয় ঠিক থাকে তবে মানুষ তাকে গ্রহণ করে অন্তরের অন্তস্থল থেকে। তবে সুরেলা এসব শ্লোগানই অসুরের হাতে পড়লে বিকৃত বাজখাঁই স্বরে চরম কর্কশভাবে আঘাত করে মন ও মননে। প্রিয় অনেক শ্লোগান, প্রিয়তম কবিতার লাইন আর অনেক মর্মস্পর্শী কথামালাও হয়ে ওঠে চরম বিরক্তির কারণ।
সম্প্রতি জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান নির্ধারণ করে দেয়া হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে স্থগিত হয়েছে। এতে করে আওয়ামীপন্থী অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চরম বিরক্তি প্রকাশ করছেন। ওদিকে প্রকাশ্যে সুশীল বেশ ধারণকারী হৃদয়ে আওয়ামী লীগের স্পন্দন বয়ে বেড়ানো ব্যক্তিরা চরম ক্রোধের মধ্যে এই শ্লোগানের মুক্তিযুদ্ধকালীন গুরুত্ব তুলে ধরে শুরু করেছেন ভয়াবহ আহাজারি। কিন্ত তারা এড়িয়ে যাচ্ছে ২০২২ সালের আগে এই শ্লোগানকে আইন করে জাতীয় শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়নি। আর সে সময় নিঃসন্দেহে তারাও কেউ আহাজারি করেনি।
যতদূর জানা যায়, ২০২০ সালের ১০ মার্চ জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। তারপর সেই রায়ের উপর ভিত্তি করে ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় রাতের ভোটে নির্বাচিত বিগত সরকারের পলাতক মন্ত্রিসভা। এরপর থেকে এটাকে অনেকটা বাধ্যতামূলক উচ্চারিত শ্লোগান হিসেবেই দেখতে হবে। তার ঐতিহাসিকতাকে এই রায় এবং সংসদীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে নগ্ন দলীয়করণ করা হয়েছে।
বাস্তবতার নিরীখে বলতে গেলে ‘জয় বাংলা, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, নারায় তাকবীর কিংবা জয় শ্রীরাম এসব শ্লোগান জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার কিছু না। এগুলো যার যার ভেতর থেকে আসে’। যেমন অনেকেই আছেন যাদের ঘাড়ে বাড়ি মারলেও জয় বাংলা শ্লোগান মুখে আসবে না। কিন্তু অবলীলায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ কিংবা নারায় তকবীর বলে যাচ্ছেন। বুদ্ধিজীবী নামধারী ফ্যাসিবাদ তোষণকারীদের কথা একপাশে রাখলেও অনেক আওয়ামীভক্ত আছে যারা জুলাই-আগস্টের গণহত্যার পরেও আবেগ নিয়ে জয় বাংলা বলে। তারা এটাতে এখনও গর্ববোধ করে।
অন্যদের কথা বলতে পারব না। আমিসহ আমার অনেক বন্ধু-বান্ধবের দেখেছি অভিন্ন সমস্যা। তারা অনেকেই শৈশবের অভ্যাস হিসেবে মুখ ফসকেও অনেক সময় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ কিংবা ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া, লও লও লও সালাম বলে বসে। অস্বীকার করব না, ৫ আগস্ট বিকালে বোর্ড বাজার এবং শিববাড়ি মোড়ে উল্লসিত জনতার মধ্যে অতি আবেগে চরম ভাঙ্গা গলাতেও শ্লোগান দিয়েছিলাম। যা হয়তো একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কোনোভাবেই উচিত হয়নি।
ইসকনের মিছিলে কে যেন মুখ ফসকে ‘জয় বাংলা’ বলে ফেলেছিল। আমিও ভুলে ঠিক সেভাবেই ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’বলে ফেলেছি। ভাগ্য ভালো উল্লসিত জনতা ক্ষেপে যায় নাই। কারণ জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের স্পিরিট যে পলাতক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগান তার অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করে! বাস্তবতার নিরীখে দেখলে ঠিক বিপরীতভাবে ‘জয় বাংলা’ সেই ফ্যাসিবাদের অস্তিত্বকে শক্তিশালী করে ।
আমি মনে করি ধর্মবিশ্বাস, রাজনীতি আর সংস্কৃতিতে জোর করার কিছু নাই। এখানে ব্যক্তি-স্বাধীনতা প্রকাশের সুযোগ দেওয়াটা প্রতিটি রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়। আর সেটা না করে গায়ের জোর খাটিয়ে জয় বাংলা শ্লোগানকে সংসদে বসে বসে ‘বয় জংলা’ করে দিয়েছে খোদ আওয়ামী লীগ নিজেই। মাঝখান থেকে নন্দিত একজন ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য ঠিক এই জিনিসটাই জনগণকে ধরিয়ে দিয়ে আলোচিত হয়েছেন। জয় বাংলা নিয়ে তাকে বিশেষ কিছু করতে হয়নি। শুধু এই শ্লোগান সামনে রেখে বাংলাদেশে চলমান অপকর্মগুলোকে সামনে এনেছেন তিনি।
আওয়ামী শোষণে আর সুশীলদের ধারাবাহিক তোষণে বিরক্ত অনেকেই জয় বাংলা শ্লোগানকে বিকৃত করে ‘বয় জংলা’ কিংবা এ ধরনের নানা বিষয় লিখছেন। সেগুলোর আদতে প্রয়োজন নেই। আপনাদের ভুলে গেলে চলবে না আওয়ামী লীগের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার আগে এই জয় বাংলা সত্যিই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতায় জয় বাংলা জাতীয় স্লোগানই ছিল। তবে সেই ‘জয় বাংলা’ কীভাবে ‘বয় জংলা’ হয়ে গেল তার পেছনেও রয়েছে অনেক কারণ। সেই শ্লোগানকে পুরোপুরি দলীয় চেহারায় দখল করাটার দায় নিঃসন্দেহে বাকশাল তথা আওয়ামী লীগের। তারপর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয় সাংবিধানিকভাবে সবকিছুর নিরঙ্কুশ আওয়ামীকরণের মধ্য দিয়ে। স্বৈরতন্ত্র ধীরে ধীরে যখন রূপ নেয় লাগামহীন ফ্যাসিবাদে তখন তাদের প্রতিটি অনুষঙ্গের মতো জয় বাংলা শ্লোগানও গণঘৃণার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যাই লেখা থাক আর কথিত ইতিহাসবিদ নামের পলিটিক্যাল হকারেরা যে ‘ডিসকোর্সের ট্যাবলেট’ তৈরি করু,ক কী এসে যায়! বাংলাদেশের জনগণ চোখে সামনে যা দেখেছে সেটাকে অস্বীকার করবে কীভাবে? জনগণ দেখেছে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তাদের স্বৈরতন্ত্র নিরঙ্কুশ করতে জয় বাংলা স্লোগান সামনে রেখেই মেতে উঠেছিল ভোট ডাকাতির উৎসবে। একটা সময়ে তারা অন্যায়-অবিচারের মন্ত্র বানিয়েছে এই শ্লোগানকে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ক্যাম্পাসে আববার ফাহাদদের মতো পোলাপানকে পিটিয়ে মেরে ফেলা, রাহাজানি, দূর্নীতি, টেন্ডারবাজি আর ধর্ষণের বৈধতার ক্ষেত্রে জয় বাংলাকে ব্যবহার করেছে সাইনবোর্ড হিসেবে। অন্যদিকে তারা এই শ্লোগানকে সামনে রেখেই পুরো জাতিকে মানুষের নিতম্বের মতো দুইভাগে ভাগ করে ফেলেছিল। আর সেই নিতম্বের ফোঁড়া আক্রান্ত পাশ ছিল জয় বাংলার পক্ষে, আর সুস্থ যে অংশে ভর দিয়ে বসা যায় তারা ছিল ‘জয় বাংলার’ বিপক্ষে।
বাংলাদেশের মানুষ দেখল পেঙ্গুইনের মতো কালো কোট পরা একদল লোক যেই ভোট দিনের বেলা দেওয়ার কথা সেটা রাতের বেলা দিয়ে ফেলছে। আপনি ভোট দিতে কেন্দ্রে গেলে বলছে, ‘আপনার ভোট দেওয়া হয়ে গেছে, বাড়ি চলে যান’। তারপর এরাই গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে ‘জয় বাংলা বলে’।
রাখাল বালক থেকে যে লোকটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়ে বসেছিল তার শ্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। রিজেন্ট হসপিটালের যে শাহেদ কিংবা ডা. সাবরিনা করোনার ভুয়া সনদ বিক্রি করেছে তাদের শ্লোগানও ছিল ‘জয় বাংলা’। চলচিত্র নায়ক থেকে ভাঁড় মনে যাওয়া যে লোকগুলো উল্টাপাল্টা মিথ্যা বকেছে তাদের শ্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের সারির যে গর্দভতুল্য ছোকরাটি শিক্ষকতার চাকরি বাগিয়ে অন্যায় করেছে, ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে, ছাত্রীদের সঙ্গে অনৈতিক শারীরীক সম্পর্ক তৈরি করে গণধিকৃত হয়েছে তাদের শ্লোগানও ছিল জয় বাংলা।
কোনো অধ্যাপকের জন্মস্থান দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলাতে কিন্তু সে শিক্ষার্থীদের সামনে শার্টের কলার উঁচিয়ে নিজের পরিচয় দেয় ‘আমি ঢাকার ছেলে’ বলে। তারপর পুরো বছরের পাঠ্যক্রম শেষ করে দেয় মাত্র পাঁচ-ছয়টি ক্লাস নিয়ে, তার শ্লোগান ছিল জয় বাংলা। যে অধ্যাপক কোনো পরীক্ষায় অংশ না নেওয়া শিক্ষার্থীকেও ৩.৫০-এর উপরে জিপিএ দিয়ে ফেলে তার শ্লোগানও জয় বাংলা। যে ডাক্তার রোগীদের চিকিৎসা না দিয়ে সরকারি হাসপাতাল থেকে বেতন নেয় তার শ্লোগান জয় বাংলা। ঠিক একইরকম শতসহস্র অনিয়ম খুঁজে পাওয়া যাবে যেখানে ‘জয় বাংলা’ হয়ে গিয়েছিল সকল কুচক্রীর রক্ষাকবচ। এরপরেও এই শ্লোগান জাতির সামনে বিভীষিকাময় হয়ে না ওঠার কোনো কারণ আছে?
আওয়ামী লীগের দলীয় পরিচয়ে বিভিন্ন পদধারী অনেকেই এখন নিরপেক্ষতার মুখোশে ইতিহাসের প্রসঙ্গ তুলে চরম মায়াকান্না শুরু করেছে। জাতির আত্মপরিচয় সংকটের যে প্রশ্ন তারা তুলেছে তার বিপরীতে তাদেরকেই বরং প্রশ্ন করা হোক, গণহত্যারকারীদের পলায়নের রাস্তা করে দেওয়া সামনে রেখে। তাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হোক , আদালত জয় বাংলা স্লোগানকে এখনও নিষিদ্ধ করেনি। এই শ্লোগান আওয়ামী লীগের অপকর্মের পথ ধরেই গণঘৃণার মুখে পড়েছে। তাই শ্লোগানের দূর অতীত নিয়ে কথা বলতে গেলে নিকট অতীতের অপকর্মগুলো নিয়েও বলতে হবে। যদি কেউ তা না বলে শুধুই দূর অতীতে অর্ধশতাব্দী আগের একপাক্ষিক বক্তব্য রাখে, মনে করতে হবে সে আওয়ামী লীগের কোনো না কোনো অপকর্মের অংশীজন অথবা তার প্রিয় রাজনৈতিক দলটিকে গণহত্যার ভয়াবহ অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়ে পূতঃপবিত্র প্রমাণের উদ্দেশ্যে মালকোছা মেরে মাঠে নেমেছে।