বাশারের পতন সিরিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যে কী পরিবর্তন আনতে পারে
সুন্নিবিরোধী শক্তির কাছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের অপ্রত্যাশিত পতন মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
বাশার আল-আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে ২০১১ সালে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর থেকে এক দশকেরও বেশি সময় অভ্যুত্থান, গৃহযুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সহ্য করেছে দেশটি।
এই নাটকীয় পরিবর্তন এই অঞ্চলে ক্ষমতার গতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এটি সিরিয়ার ভবিষ্যৎ এবং আসাদ-পরবর্তী পরিস্থিতি পরিচালনায় এর প্রতিবেশী এবং বৈশ্বিক স্টেকহোল্ডারদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
সিরিয়ার ভবিষ্যৎ কী?
আসাদ সরকারের পতনের সাথে সাথে সিরিয়া এখন খণ্ডিত এবং তিনটি প্রভাবশালী উপদলের মধ্যে বিভক্ত, যার প্রত্যেকটিতে রয়েছে বহিরাগতরা।
১. হায়াত তাহরির আল-শামের নেতৃত্বে একটি বাহিনী রয়েছে যারা তুরস্ক সমর্থিত। তারা এখন মধ্য সিরিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। হায়াত তাহরির দল একটি সাধারণ ধর্মীয় পরিচয় বহন করে। কিন্তু তাদের মধ্যে থাকা সুন্নি উপদলগুলির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ইতিহাস রয়েছে। ফলে একটি সমন্বিত সরকার গঠন বা দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বজায় রাখার সামনে সেগুলো একটা বাধা।
তাছাড়া তাদের সঙ্গে রয়েছে ইসলামিক স্টেট এবং আল-কায়েদা থেকে আসা প্রাক্তন জিহাদিরা। আরও রয়েছে সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির মতো ধর্মনিরপেক্ষ গোষ্ঠী রয়েছে, যারা ২০১১ সালের বিদ্রোহের পর আসাদের সেনাবাহিনী থেকে বিভক্ত হয়েছিল।
২. কুর্দি বাহিনী: কুর্দি গোষ্ঠীগুলি উত্তর-পূর্ব সিরিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, যার উত্তরে তুরস্ক এবং পূর্বে ইরাক সীমান্তবর্তী। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছে। তারা এই এলাকায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। এই সমর্থন তুরস্কের সাথে উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করেছে।
৩. আলাউইট বাহিনী: আসাদ-পন্থী আলাউইট উপদল, যারা প্রাথমিকভাবে পশ্চিম সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত ইরান, ইরাক ও লেবাননের হিজবুল্লাহ জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে শক্তিশালী সম্পর্ক বজায় রাখে। তারা এই এলাকাগুলিতে আসাদের শক্ত ঘাঁটি হিসাবে কাজ করতে পারে, যারা সাম্প্রদায়িক বিভাজন স্থায়ী করে।
পারস্পরিকভাবে গ্রহণযোগ্য মধ্যস্থতাকারী না থাকায় এই গ্রুপগুলির মধ্যে তীব্র বিভাজন এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সিরিয়া এখন দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতা এবং সংঘাতের মুখোমুখি হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে কী প্রভাব পড়বে?
আসাদ সরকারের দ্রুত পতন মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান খেলোয়াড়দের জন্য গভীর চিন্তার বিষয়। তারা এখন কিভাবে কোন পদক্ষেপ নেবেন তা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
আসাদ সরকারের মিত্ররা ব্যস্ত ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। ইরান ও তার প্রক্সি শক্তিগুলি ব্যস্ত ছিল ইসরায়েলের সাথে তাদের চলমান বিরোধ নিয়ে। ফলে বিদ্রোহীরা সারা সিরিয়া থেকে রাজধানী দামেস্ক-অভিমুখে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার একটি কৌশলগত সুযোগ পেয়েছে।
তুরস্ক ইতিমধ্যেই উত্তর সিরিয়ার একটি ভূখণ্ড কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, যেখানে তার সামরিক বাহিনী সিরিয়ার কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এখন তুরস্ক সিরিয়ায় রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যার ফলে কুর্দি সংখ্যালঘুদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করা আরও চ্যালেঞ্জ হবে।
ইসরায়েলও কৌশলগতভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে। এখন হিজবুল্লাহকে ইরানের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ লাইনগুলি সম্ভবত বিচ্ছিন্ন করা হবে, জঙ্গি গোষ্ঠীটিকে বিচ্ছিন্ন করা হবে এবং সম্ভবত এটি আরও দুর্বল হবে। ইসরায়েল গত মাসে হিজবুল্লাহর সাথে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু "ইরানের হুমকি" মোকাবেলায় ফোকাস পরিবর্তনের উপর জোর দিয়েছেন।
এদিকে সবচেয়ে বেশি হারতে হয়েছে ইরানকে। আসাদ ইরানের আঞ্চলিক প্রক্সি নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিলেন। বাশার সরকারের পতনের ফলে ইসরায়েল ইতিমধ্যে হামাস ও হিজবুল্লাহর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করেছে। ফলে ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব এখন মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
সিরিয়ার বিভক্তি তার প্রতিবেশী দেশগুলি—তুরস্ক, ইরাক, জর্ডান ও লেবাননের জন্য উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। উদ্বাস্তু প্রবাহ, আন্তঃসীমান্ত সহিংসতা এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে পারে। তুরস্ক ইতিমধ্যে ৩০ লাখের বেশি সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকেই আশা করছে, তারা আসাদের সরকার চলে যাওয়ায় এখন দেশে ফিরবে।
এই অস্থিতিশীলতা ইরাক ও লেবাননের ভঙ্গুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। জাতিগত ও ধর্মীয় লাইনে সিরিয়ার আরও অন্যান্য গোষ্ঠী স্বায়ত্তশাসনের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উৎসাহিত হতে পারে। এর ফলে বিভাজন সৃষ্টি এবং সমগ্র অঞ্চলে সংঘাত দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
যদিও অনেক সিরিয়ান আসাদের পতন উদযাপন করেছে, তবে তাদের জীবনে অনেক উন্নতি হবে কিনা তা দেখার বিষয়। সিরিয়ায় একটি ঐক্যবদ্ধ এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার না হলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সম্ভাবনা কম। ফলে বিধ্বস্ত সিরিয়ার অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে, মানবিক সংকট আরও গভীর করবে এবং সম্ভাব্য চরমপন্থাকে উসকে দেবে। সূত্র: দ্য কনভারসেশন