ভারত শেখ হাসিনাকে নিয়ে কী করতে পারে? আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে যেসব পথ খোলা আছে
আকলব্য আনন্দ ও শৈলেশ কুমার
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৭ পিএম
২০২৪ সালের ২২ জুন বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ফাইল ছবি: X (Twitter)/@narendramodi।
গত ১২ নভেম্বর, বাংলাদেশের বিশেষ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কয়েকশ বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলকে একটি রেড নোটিশ জারি করতে বলে। এরপর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ বিচারের জন্য তাকে বাংলাদেশের হস্তান্তর করার জোর দাবি উঠেছে।
এই দাবিটি বৈধ বলে মনে হয় এবং যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে এটি বেশ গ্রহণযোগ্য প্রথা। অন্তত এভাবেই ২০১৪ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। অন্য কয়েকটি দেশেও অনুরূপ উদাহরণ রয়েছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সদস্য।
বিদ্যমান তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেক শিক্ষার্থী রাষ্ট্রীযন্ত্রের হাতে নিহত হয়েছেন। প্রথম দিকে, সরকার কর্তৃক সংঘটিত এ ধরনের কাজ রোম সংবিধির ৭ অনুচ্ছেদের অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে গণ্য হয়। হাসিনা সরকারের হাতে সংঘটিত সহিংসতার আরও অনেক নজির রয়েছে। যেমন নির্যাতন, হত্যা, গুম করা। বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক এবং নিয়মতান্ত্রিক আক্রমণ এবং এই অপরাধের মাত্রা হাসিনার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে একটি মামলাকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তোলে।
যেহেতু বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য, তিনটি উপায়ে আইসিসির এখতিয়ার কার্যকর করা যেতে পারে—রাষ্ট্র দ্বারা, প্রসিকিউটর অফিস দ্বারা এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রেফারেল দ্বারা। আইসিসি এখতিয়ার বিমূর্ত ক্ষমতা নয়, এটি বাস্তব। এই বিবেচনায়, হাসিনার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে তাৎপর্য বহন করে।
প্রত্যর্পণ
অভিযুক্ত ব্যক্তি ভারতে আশ্রয় নিলেও ভারত সরকারের পক্ষ থেকে হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার কোনো ঘোষণা নেই। হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। মজার বিষয় হল, প্রত্যর্পণের অনুরোধটি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে দাঁড়িয়েছে। প্রথাগতভাবে, কোনো ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করার জন্য রাষ্ট্রের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
এখানে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ: দ্বৈত অপরাধ, বিশেষত্বের শাসন এবং রাজনৈতিক অপরাধের ব্যতিক্রম। দ্বৈত অপরাধ মানে এমন একটি কাজ, যে জন্য প্রত্যর্পণ চাওয়া হয় তা অবশ্যই উভয় এখতিয়ারে অপরাধ হতে হবে। বিশেষত্বের নিয়ম মানে যার প্রত্যর্পণ চাওয়া হয়েছে তার নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য অবশ্যই বিচার হবে। রাজনৈতিক অপরাধের ব্যতিক্রম মানে হলো অনুরোধকৃত রাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়া তাকে পুনরায় প্রত্যর্পণ করা যাবে না।
বিষয়টা এভাবে খোলাসা করা যায়। শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে ভারতীয় আইনের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
রাজনৈতিক অপরাধে প্রত্যর্পণ দেওয়া যাবে না বলে ভারতে সাধারণ নিয়ম রয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তি একটি নির্বাহী আইন যেখানে ভারতীয় প্রত্যর্পণ আইন (IEA) একটি সংসদীয় আইন। সুতরাং, নিয়ম হিসাবে, চুক্তিটি অবশ্যই IEA-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রয়োগ করতে হবে। IEA-এর ধারা ৩১ রাজনৈতিক অপরাধের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখাতে পারে। অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত না পাঠানোর পক্ষে ভারতের নিজস্ব (সংসদীয়) আইন রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনে প্রত্যর্পণের কোনো কনভেনশন নেই। তবে আউট ডিডেরে অট জুডিকেয়ার রয়েছে (হয় প্রত্যর্পণ করুন না হয় বিচার করুন)। এতে বলা হয়েছে, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও নির্যাতনের মতো কিছু গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি যে রাষ্ট্রের এখতিয়ারে বসবাস করছে তাকে হস্তান্তর করতে হবে বা শাস্তি দিতে হবে। অধিকন্তু, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের প্রতিরোধ ও শাস্তি-২০১৯ সংক্রান্ত খসড়া নিবন্ধের ৩ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্রের মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রতিরোধ ও শাস্তি দেওয়ার জন্য একটি সাধারণ বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
হয় প্রত্যর্পণ বা বিচার করুন
যে রাষ্ট্রের এখতিয়ারে অভিযুক্ত অপরাধী উপস্থিত থাকে সেই রাষ্ট্র যদি সেই অপরাধীকে অন্য রাষ্ট্রের কাছে বা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত বা ট্রাইব্যুনালে প্রত্যর্পণ না করে, তাহলে বিচারের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে মামলাটি জমা দিতে হবে। সেই রাষ্ট্রের আইনের অধীনে গুরুতর প্রকৃতির অন্য কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে যেভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেইভাবে সেই কর্তৃপক্ষগুলি তাদের সিদ্ধান্ত নেবে৷
২০০৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বেলজিয়াম সেনেগালে আশ্রিত চাঁদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিসেন হাব্রের বিরুদ্ধে বিচারের আবেদন করে। হাব্রে ১৯৯০ সালে সেনেগালে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বসবাস শুরু করেন। বেলজিয়াম বলেছিল, সেনেগাল হাব্রের বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং হাব্রেকে বেলজিয়ামে হস্তান্তর করার জন্য বলেছিল বেলজিয়াম।
কনভেনশনের ধারা ৬, অনুচ্ছেদ ২, এবং ধারা ৭, অনুচ্ছেদ ১-এর বিধিবিধান মেনে চলতে ব্যর্থ হয়ে সেনেগাল আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালনের পদক্ষেপ নেয়। তারা আরও বিলম্ব না করে মামলাটি বিচারের উদ্দেশ্যে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ফলস্বরূপ, এক্সট্রাঅর্ডিনারি আফ্রিকান চেম্বার ডাকারে হাব্রের বিচার শুরু হয়। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে চাঁদে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং নির্যাতনের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন হাব্রে। তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত।
ভারতের বিকল্প
ভারতকে একটা বিকল্প বেছে নিতে হবে। রোম সংবিধির ১৭ অনুচ্ছেদ বলছে, আইসিসি নির্ধারণ করবে একটি মামলার তদন্ত বা বিচার কোথায় হবে। যদি অপরাধীর বিচারে তার রাষ্ট্র অনিচ্ছুক বা অক্ষম হয় অথবা যদি এমন হয় যে অপরাধী তার নিজ দেশে সুষ্ঠু বিচার পাবেন না, তাহলে আইসিসি সিদ্ধান্ত নেবে কোথায় তার বিচার হবে।
বাংলাদেশে হাসিনার দলের উপর ব্যাপক ক্ল্যাম্পডাউন বিবেচনা করে, বিষয়টি আজ যেখানে দাঁড়িয়েছে, তাতে বিতর্কিতভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, হাসিনা বাংলাদেশে সুষ্ঠু বিচার পাবেন না। সুতরাং, অনুচ্ছেদ ১৭ নিজেই হাসিনার বিচারে বাংলাদেশের এখতিয়ারে বাধা দেয়।
তদুপরি, নির্যাতন, অবমাননাকর এবং অমানবিক আচরণের আশঙ্কার ভিত্তিতে ভারত যুক্তি দিতে পারে যে, ভারত হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অবস্থানে নয়। সাদি বনাম ইতালি (২০০৮) এবং সোয়েরিং বনাম ইউকে (১৯৮৯)-এর মতো মানবাধিকারের ইউরোপীয় আদালতের যুগান্তকারী রায়গুলিতে, আদালত বলেছে, যদি নির্যাতনের আশঙ্কা থাকে তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করা হবে না।
লকারবি মামলার প্রেক্ষাপটে ভারত সম্ভবত হাসিনাকে তৃতীয় কোনো দেশের কাছে হস্তান্তর করতে পারে অথবা হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে না বলে আশ্বাস দিয়ে তাকে আইসিসির কাছে হস্তান্তর করতে পারে। সূত্র: দ্য ওয়্যার
• আকলব্য আনন্দ: দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সহকারী অধ্যাপক।
• শৈলেশ কুমার: আইন ও অপরাধবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক, রয়্যাল হলওয়ে, লন্ডন ইউনিভার্সিটি, এবং একজন কমনওয়েলথ পণ্ডিত।