বিচারহীনতার দেশে ‘গণবিচারের’ অরাজকতা
নৈশ ভোটের মধ্য দিয়ে জনগনের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে অবৈধ সরকারের যুগ থেকে যুগান্তে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা দেশের সবগুলো প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে।রাষ্ট্রক্ষমতা অনৈতিকভাবে আঁকড়ে থাকাকে যদি কোনো প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে কল্পনা করা হয় তার সবথেকে বড় ঝাপটা যেখানে গিয়ে লেগেছে সেটা দেশের আইন ও বিচার বিভাগ।সরকারদলীয় ক্যাডারদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ, সাংবিধাকি এমনকি রাজনৈতিক পদে থেকে বিচার বিভাগকে প্রভাবিতকরণ আর রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারের রায় প্রদান বাংলাদেশের মানুষকে হতাশ করেছে।
গত এক থেকে দেড় যুগে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে সেখানে তারা কোনোভাবেই বিচার বিভাগের উপর আস্থা রাখতে পারছেন না। আমরা মুখে যত কথাই বলি, যত নৈতিকতার উপমায় মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করি, বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ে বিচার বিভাগকে কেন্দ্র করে যে অবিশ্বাস তা দূর করা কঠিন। একটি দেশে সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে সে দেশের স্বীকৃত বিচারপতিগণ যখন নিজেদের পরিচয় প্রদান করেন ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ উল্লেখ করে সেখানেই বাংলাদেশের ‘মব লিঞ্চিং’ বাস্তবতা খুঁজে নেওয়া যায়।
বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে দৃষ্টি দেওয়া যাক। ঘটনাটি আমার এলাকায় ঘটেছিল বলে ভুলতে পারিনি। ২০২২ সালের ২৬ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলো ছেপেছিল ‘পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগে করা একটি মামলায় ৩৭ কৃষকের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ২৪ নভেম্বর রাত থেকে ২৫ নভেম্বর সকাল পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। দুপুরে তাঁদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেপ্তার কৃষকদের বরাত দিয়ে ঈশ্বরদী থানা-পুলিশ বলে, বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক নামের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ওই কৃষকেরা। ঋণের টাকা পরিশোধ করার পরও তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বলে তাঁদের দাবি। …তাঁরা সবাই প্রান্তিক কৃষক।’
বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকাগুলো যারা পড়েন তারা কমবেশি এমন খবর পাবেন যার সীমা-পরিসীমা নেই। এভাবে অবিচারের শিকার হওয়া মানুষগুলো ত্যক্তবিরক্ত হয়ে যখন প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করে তখন তাদের দোষ যতটা, তার থেকে ঢের দায় দেশের নষ্ট হয়ে যাওয়া বিচারিক অবকাঠামো, দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে আদালতকে বিক্রি করে দেওয়া বিচারক কিংবা নষ্টভ্রষ্ট আইনজীবিদেরও। সাধারণ গাল-গল্প বাদ দিয়ে অপরাধবিজ্ঞান কিংবা সামাজিক ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যায়, এই ধারণাটি আরও সুস্পষ্টভাবে আমাদের সামনে এসে ধরা দেবে।
যুগের পর যুগ বঞ্চিত অবহেরিত মানুষ আইন হাতে তুলে নিলেই গণবিচার তথা মব লিঞ্চিং ঘটতে পারে। এখানে বিপন্ন অপরাগ মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়। তারা একজন ক্রমিক অপরাধীর উপর অনেকটা নিরুপায় হয়ে আক্রমণ চালায় একাধারে অপরাধের বদলা নেওয়া এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি অসহযোগিতা প্রকাশের অভিন্ন উদ্দেশ্যে। দীর্ঘদিনের ক্ষোভ প্রশমন করতে গিয়ে জনতা যখন কারও উপর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে সেই হামলা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয় সহিংস এবং প্রাণঘাতী। বারংবার বিচার চেয়ে প্রতারিত জনগণ এই ধরনের অঘটন তখন বেশি ঘটায় যখন তারা বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে।
ভয়াবহ অপরাধের ক্ষেত্রেও বিচার প্রক্রিয়ার স্থবিরতা তাদের হতাশ করে।জনগণ যখন বিচার পদ্ধতিকে অনেক ধীর মনে করে, তাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় অবিশ্বাস। তারা ভাবতে শুরু করে, বিচারব্যবস্থা চরমভাবে তাদের বিরোধী এবং এতোটাই দুর্নীতিগ্রস্ত যা কেবল অপরাধীকে রক্ষার চেষ্টা করে।ঠিক এই বিষয়টি আমলে নিলে আমরা বুঝতে পারবো কেন এই মব লিঞ্চিং বাংলাদেশে অনেকটাই পৌনঃপুনিকভাবে ঘটছে।
জনতার নিজ হাতে বিচার বাস্তবে বাংলাদেশে একটি জটিল সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে যার পেছনে একাধিক কারণ কাজ করতে পারে। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, আর্থিক এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত সবগুলো কারণের মধ্যে সবার আগে বলতে হবে বিচার ব্যবস্থার উপর সবার আস্থা হারানোর কথা। যখন জনগণ মনে করে যে আদালতের বিচার ব্যবস্থা দ্রুত ও ন্যায্য বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না, তখন তারা নিজ হাতে বিচার করার প্রবণতা দেখায়। যেখানে পুলিশের দক্ষতা যোগ্যতা ও আন্তরিকতা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে পুলিশ যখন চিহ্নিত অপরাধীদের ধরতে ব্যর্থ হয় কিংবা আর্থিক ও রাজনৈতিক সখ্যতার কারণে অপরাধীদের সঙ্গে মিলে যায় তখন জনগণ পুলিশের উপর আস্থা হারায়। তারা অনেকটা বাধ্য হয়েই অন্যায়ের বিচার নিজেরাই করতে চায়।
নানাবিধ সামাজিক অসাম্য যেমন দারিদ্র্য, বেকারত্বের মতো সমস্যাগুলিও নুষকে মব লিঞ্চিং এক্ষেত্রে উষ্কে দিতে পারে।হতাশাগ্রস্ত মানুষ আইনের বাইরে নিজের ন্যায় বিচার নিজেই করার চেষ্টা করে। তখন তারা বিবিধ গুজব ও ভুল তথ্যকেও সত্য বলে মনে করে। তারা মিথ্যা অভিযোগ বা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নিরীহ ব্যক্তির উপরেও চড়াও হতে পারে। অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিও তাদের হামলার শিকার হতে পারে। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তড়িৎ গতিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া গুজব এই ধরনের ঘটনাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
দীর্ঘদিনের অবৈধ সরকারের অধীনে থাকায় দেশে যখন সামাজিক নিয়ম ভেঙ্গে পড়ার পাশাপাশি মূল্যবোধের অভাব প্রকট হয় তখন মানুষ বিবেকের বদলে আবেগের বশবর্তী হয়ে আইন নিজ হাতে তুলে নিতে পারে। অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যও এর পরিণতির কথা চিন্তা না করে এই অঘটনকে ইন্ধন দিতে পারে। এর মাধ্যমে যে গুরুতর সমস্যা দেখা দেয় তার পরিণতি খুবই ভয়ানক হতে পারে। এতে করে বিভিন্ন নিরীহ মানুষের জীবন ও সম্পত্তি যেমন নষ্ট হতে পারে তেমনি সামাজিক স্থিতিশীলতাও পুরোপুরি বিনষ্ট হতে পারে। সার্বিকভাবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে পুরোপুরি ভঙ্গুর করে দিতে পারে এহেন অস্থিরতা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড।
হাবিব আব্দুল রউফ সালিহু এবং হোসেইন গোলামি তাদের বিখ্যাত ‘Mob justice, corrupt and unproductive justice system in Nigeria: An empirical analysis’ শীর্ষক প্রবন্ধে গণবিচারের বিভিন্ন সত্তাতাত্ত্বিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিকের পর্যালোচনা করেছেন। তারা অপরাধবিজ্ঞানের সামাজিক বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব (Social Disorganization Theory) অনুযায়ী দেখিয়েছেন, প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরের অসততা কিভাবে সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে উষ্কে দেয়। তারপর বিরাজমান অবিচার কেমন করে জনগণকে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার একটি পদ্ধতি হিসেবে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য করে। অন্যদিকে রবার্ট কে. মার্টনের স্ট্রেইন থিওরি (Strain Theory) থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি, বাংলাদেশের বাস্তবতায় কীভাবে রাজনৈতিক অসততা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং উপযুক্ত সুযোগ বঞ্চিত অবিচারের শিকার মানুষ বাধ্য হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়।
লেবেলিং থিওরি কিংবা কনফ্লিক্ট থিওরির আলোকেও এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।মার্ক্সীয় তত্ত্বজ্ঞান আমাদের যেখানে ধারণা দিচ্ছে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলাফলই অপরাধ সেখানে ক্ষমতাধর শ্রেণির অপরাধপ্রবণতা দূর করতে মব লিঞ্চিং ব্যবহার হতে পারে। তারা দুর্বলদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন করে যে অসন্তুষ্টি তৈরি করে তার চূড়ান্ত ফলাফল হতে পারে এই মব লিঞ্চিং। সেটা তাদের হিসেবে ক্ষমতার অসমতার বিরুদ্ধে নিছক একটি প্রতিক্রিয়া।
মুখে বলে কিংবা নৈতিকতার গল্প শুনিয়ে এই ভয়াবহ প্রবণতা বন্ধ করা যাবে না। এজন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি তাদের সততার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। প্রকৃত অপরাধীদের আটক করে শাস্তির সম্মুখীন করতে তথ্য-প্রযুক্তিসেবা ব্যবহার করতে হবে।পাশাপাশি বিচার বিভাগকে এমনভাবে স্বাধীন ও দক্ষ করে তুলতে হবে যাতে জনগণ ন্যায় বিচার পায়। পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে কোনো বিচারক যেনো নিজেকে ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ পরিচয় দিতে না পারে।
বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করতে হবে যা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে।মানুষকে মব লিঞ্চিংয়ের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার বিকল্প নাই।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুল তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করতে হবে। দারিদ্র্য, নেশাগ্রস্ততা ও বেকারত্বের মতো সামাজিক সমস্যাগুলির সমাধানকল্পে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। আয়গত পার্থক্যের জন্য সৃষ্ট সামাজিক অসাম্য দূর করতে হবে যেখানে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার বিকল্প নাই। পাশাপাশি মানুষকে আইন ও ন্যায়বিচার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে যা তাদের সহিষ্ণুতা এবং পরস্পরের প্রতি সম্মান করতে শেখায়। আর পুরো ব্যাপারে এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে গণমাধ্যম। সেজন্য বস্তুনিষ্ঠ, যুক্তিযুক্ত, তথ্যনির্ভর ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রকাশ করতে উৎসাহিত করতে হবে তাদের।