অন্তর্বর্তী সরকার কিভাবে অর্থনীতির মোড় পরিবর্তন করতে পারে
সেলিম রায়হান ও কুনাল সেন
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩১ পিএম
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, যা ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এসেছে, তা দেশের অর্থনীতির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে তাৎক্ষণিক প্রভাবগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে মন্থরতা। কারণ অস্থিরতা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুনষ্ট করেছে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬.৬%। মুডিস রেটিং এজেন্সি ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, এই বৃদ্ধি ২০২৫ সালের জুন নাগাদ ৬-এর নিচে নেমে আসবে।
নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে এবং দেশের অর্থনীতিকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে হবে।
সাম্প্রতিক অস্থিরতার আগেই বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। এর মধ্যে ২০২২ সাল থেকে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতির হার ১২ বছরের সর্বোচ্চ ১১.৬৬%-এ পৌঁছায়। তবে আশার কথা হলো। আগস্টে সেটি ১ দশমিক ১৭ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে।
অস্থিরতার সময় চলাচলের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। সরবরাহ চেইন ব্যাহত হয়েছিল এবং ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছিল। কোনো সন্দেহ নেই যে, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির চাপ নিম্ন আয়ের পরিবারগুলিকে বিশেষ প্রভাবিত করে৷
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ধীরগতি এবং বেকারত্ব, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী নাগরিকদের প্রায় ৪০% বর্তমানে শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণে নেই বলে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনা গড়ে প্রায় দ্বিগুণ।
দেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ, যা কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস, গত এক দশক ধরে স্থবির হয়ে আছে। চলমান অস্থিরতা বিনিয়োগের পরিবেশকে আরেকটি ধাক্কা দেবে।
একই সময়ে, বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছু সময়ের জন্য নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। এর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল যা ২০২৪ সালের মে মাসে ১৮ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। তবে আশার কথা, গত মাস থেকে রেমিট্যান্স বাড়ছে, যা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় ধীর হওয়ায় দীর্ঘায়িত অস্থিরতা আরও অবনতির কারণ হতে পারে। এগুলিই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রধান দুটি চালক, যা ২০০১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মাথাপিছু জিডিপির সামগ্রিক বৃদ্ধির দুই-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধার
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ফোকাস হবে স্থায়ী নেতৃত্বে সুশৃঙ্খল উত্তরণের ভিত্তি তৈরি করা। তবে সেখানেও চাপে থাকা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তাৎক্ষণিক কাজ হলো মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলা করা। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা এবং আইএমএফ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের আর্থিক নীতি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির চাপ সত্ত্বেও, ২০২০ সালের এপ্রিল ও ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে সুদের হার ঋণের জন্য ৯% এবং ব্যাংকে আমানতের জন্য ৬% সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল।
২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রের হতাশা মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হলে তা সাধারণত মুদ্রাস্ফীতির চাপ সৃষ্টি করে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নতুন গভর্নর, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং ব্যাংকটি তার যথাযথ ভূমিকা পালন করার বিষয়ে প্রত্যাশা অনেক বেশি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অনেক চ্যালেঞ্জই কাঠামোগত। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকিং সেক্টরে, ঋণের উপর অত্যন্ত উচ্চ খেলাপি হার, দুর্বল প্রশাসন এবং অপর্যাপ্ত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মতো সমস্যাগুলি মোকাবেলার জন্য সংস্কার প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য দেখায়, প্রায় ১১% ঋণ দেরিতে পরিশোধ করা হয় বা মোটেও পরিশোধ করা হয় না।
ব্যাংকগুলি যাতে ভাল আর্থিক অনুশীলন করে তা নিশ্চিত করার জন্য স্বচ্ছতা এবং আরও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা করেছে, তারা শিগগিরই এই সমস্যাগুলি সমাধানের জন্য একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করবে।
বাংলাদেশে কর রাজস্ব আদায় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। নতুন সরকারকে করের ভিত্তি প্রসারিত করতে হবে, কর সম্মতি উন্নত করতে হবে এবং কর সংগ্রহের দক্ষতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে সরকারি ব্যয় সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অনুরূপ দেশগুলির তুলনায় যথেষ্ট কম, জিডিপির প্রায় ১৫%।
এটি আংশিকভাবে ব্যাপক দুর্নীতির ফল। হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকালে, প্রায় ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। মার্কিন ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি দেখেছে, চুরি করা তহবিলের বেশির ভাগই এসেছে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ থেকে, মূলত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ীর মাধ্যমে।
পরিশেষে, বাংলাদেশকে তার পোশাকশিল্পের উপর বর্তমান নির্ভরতা থেকে সরে আসতে হবে। তৈরি পোশাক দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি শিল্প, যা সমস্ত রপ্তানি আয়ের ৮৫%।
কিন্তু রপ্তানির ভিত্তি বহুমুখী করা সহজ হবে না। বাংলাদেশ ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার কথা। ফলে দেশটি সম্ভবত বর্তমানে অনেক দেশ থেকে যে বাণিজ্য সুবিধা/বিকল্পগুলি পাচ্ছে তা আর পাবে না। যেমন, রপ্তানিতে শূন্য শুল্ক সুবিধা আর পাবে না।
সর্বোপরি, দেশটি খুব কম বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও আকর্ষণীয় প্রস্তাব প্রয়োজন। নতুন সরকারকে অবশ্যই বাণিজ্য উদারীকরণ, বিনিয়োগ বিধি শিথিল এবং অর্থের অ্যাক্সেসের মতো কাঠামোগত বাধাগুলি দূর করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে একটি স্থিতিশীল সরকার দরকার। এর জন্য দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং প্রতিনিধিদের একটি সংস্কারবাদী এজেন্ডা ঘিরে সমাবেশ করতে হবে। (স্ক্রল ডট ইন থেকে)
* সেলিম রায়হান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক।
* কুনাল সেন, জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স রিসার্চের অধ্যাপক ও পরিচালক।