Logo
Logo
×

বিশ্লেষণ

শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া

লজ্জার সভ্যতায় গণঅভ্যুত্থান

তারেক খান

তারেক খান

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৫২ এএম

শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া

সবাই সুখী হতে চায় কিন্তু তারা শুধু কয়জন স্বজন নিয়ে সুখী হতে চায় এবং তারা অন্যের ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে সুখী হতে চায়, যা সমাজে দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। সংঘাত হাজির করে। যেমন হাসিনা বা তার দলবল যা করেছে, যারা নতুন কিছু না ইতিহাসে। আর তাদের শত্রু যারা, তাদেরও ইতিহাস বহু পুরনো। তারা সগৌরবে অব্যাহত রেখেছে তাদের সুখ-সন্ধানী যুদ্ধ। কোটা আন্দোলন তারই একাংশ। তবে কোটা আন্দোলন থেকে উদ্ভূত গণঅভ্যুত্থান একটা গুরুতর ইস্যু—উনিশ ঊনসত্তর, একাত্তর ও একানব্বইয়ের ধারাবাহিকতায়।

উনিশ ঊনসত্তর বাঙালিকে যেমন একাত্তরের দিকে ঠেলে দিয়েছে, একাত্তর যেমন শক্ত ঝাঁকুনি দিয়ে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে, তেমনি উনিশ একানব্বই সামরিক শাসন থেকে বের হবার পথ দেখিয়েছে। আর বিশ চব্বিশ দিয়েছে সাম্যবোধের কিছুটা ধারণা। রাজনৈতিক হাতিয়ার (‘রাজাকার’ ইত্যাদি) সম্পর্কে সমাজকে দিয়েছে কিছুটা জ্ঞান, যা অতি মূল্যবান।

একটি সমাজের বেশির ভাগ মানুষ রাজনৈতিক জ্ঞান বা রাজনৈতিক হাতিয়ার চিনতে পারলে তাদের পক্ষে শোষণের বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব। বিপুলসংখ্যাক মানুষকে এই জ্ঞান-হাতিয়ার চেনাতে সেরা সহায়কের ভূমিকা পালন করে আন্দোলন-অভুত্থান। সঠিকভাবে চেনা মানে উপলব্ধি করা। অনুভবের ক্ষমতা অর্জন করা। অনুভব-উপলব্ধি করতে না পারলে সেই চেনার দাম নেই।

হাসিনা কি সুখী হতে চেয়েছেন? কেমন সেই সুখ? অথবা তিনি ঠিক কি চেয়েছেন যা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে? তিনি কি নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেন?

খুব নিশ্চিত যে তিনি খুব অসুখী। এও খুব নিশ্চিত যে তিনি বাংলাদেশকে খুব ভালবাসেন। একদিকে পরিবার হারানোর বেদনা আরেকদিকে সেই ভালবাসার বাংলাদেশে নিজেকে টিকিয়ে রাখার কঠিনতম সংগ্রাম। অসংখ্য হত্যাচেষ্টার মুখে পড়েছেন তিনি, যা তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে, যা তাকে লৌহমানবী করে তুলেছে।

অন্যদিকে তিনি একজন রাজকন্যা যে-রাজা আবার দেশের স্থপতি। সুতরাং রাজকন্যার অহঙ্কার সীমাহীন।

মর্যাদার সভ্যতায় অহংকারকে স্যালুট। মিছে অহংকার বিপজ্জনক জেনেও। কিন্তু অহঙ্কার নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। অহঙ্কার ঔদ্ধত্যে রূপ নিলে তা ট্রাজিক পরিণতি বয়ে আনতে পারে।

হাসিনার অহঙ্কার কি ঔদ্ধত্যে রূপ নিয়েছিল? তিনি কী করতে পারতেন?

তিনি জানেন নিজের দেশে তার অন্তত দুই দল শত্রু আছে। একটি দল[গোষ্ঠী] একজন নারীকে তাদের দেশের নেত্রী মানতে অপারগ। আরেকটি গোষ্ঠী তার প্রতিদ্বন্দ্বী। সব পক্ষেরই আছে ভিন্নতর মতাদর্শ। কেউ ছাড় দিতে নারাজ।

১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে এবং অন্য আরো অনেক কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ। খালেদা জিয়া সেই দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হবার গৌরব অর্জন করেন। সেই দেশের একটি বৃহৎ এবং জনপ্রিয় দলের (বিএনপি) প্রথম মহিলা চেয়ারপার্সন হবার গৌরবও তার। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে তিনি দ্বিতীয় মহিলা সরকারপ্রধান (প্রথম ছিলেন বেনজির ভুট্টো)। তার আগে তিনি ছিলেন একজন ফার্স্ট লেডি। ভবিষ্যতে তিনি একজন প্রধানমন্ত্রীর মা হবেন সেই সম্ভাবনাও জ্বাজল্যমান। 

তবু খালেদা জিয়া সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযোজন করতে চাননি এবং প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ শেষে ক্ষমতা ছাড়তে চাননি।

কেন?

সব বিরোধী দলের আপত্তির মুখে এবং বহির্বিশ্বের চাপ উপেক্ষা করে খালেদা জিয়ার দল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে। একদলীয় নির্বাচন। আওয়ামী লীগসহ সব বিরোধী দল এই নির্বাচন বর্জন করে। এই সংসদ ১৫ মাসও নয়, মাত্র ১৫ দিন স্থায়ী হয়। খালেদা জিয়া এই সংসদেরও প্রধানমন্ত্রী হন। প্রবল চাপের মুখে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান পাস হয়। খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন।

খালেদা জিয়া কেন ক্ষমতা ছাড়তে চাননি?

তবে কি তিনি মনে করেছিলেন, অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হলে দেশে খারাপ কিছু ঘটে যাবে? তাই তিনি তার সমর্থকদের অনুরোধে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন? তিনি কি আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন?

তিনি একই রকম ঘটনার জন্ম দেন তৃতীয় মেয়াদে (২০০১-০৬) প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়। ২০০৪ সালের ১৬ মে সংসদে চতুর্দশ সংশোধনী পাস করান তিনি। এই সংশোধনীতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর নেওয়ার বয়স বাড়িয়ে ৬৫ থেকে ৬৭ করা হয়। কারণ কে এম হাসানকে তিনি পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দেখতে চান।

কেন বিরোধীদের আপত্তির মুখে অবসরের বয়স বাড়ানোর দরকার হল?

আপত্তির মুখে জনাব হাসান আত্মসম্মান বোধের পরিচয় দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন নাই।

হাসানের বিকল্প না খুঁজে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ প্রধান উপদেষ্টার পদ দখল করেন, যা দেখে বিবেচকরা তাজ্জব বনে যান। তার ওপর ইয়াজউদ্দিনের কর্মকাণ্ডে বিএনপির প্রতি আনুগত্য স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।

বিরোধী জোট নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকার দাবি জানিয়ে আসছিল। তা আমলে না নিয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন ঠিক করে কমিশন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সেই নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুত হয়।

কিন্তু বিরোধী দলের কয়েকজন নেতার মনোনয়নপত্র বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিএনপি একতরফা ভোটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি আঁচ করে আওয়ামী লীগ ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয় এবং লাগাতার হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিতে থাকে।

সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ইয়াজউদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দেন। ১১ জানুয়ারির এই ঘটনার আদুরে নাম এক-এগারো। তার আগে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকের বাইরে আসতে দেখা গেছে এবং ১২ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমদ নতুন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন। সবাই বলতে শুরু করেছে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। পরে সেনাবাহিনী ভোটার তালিকা তৈরি করে আর ভোটার পরিচয়পত্র এনআইডি নামে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।

খালেদা জিয়াকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছেন সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানই তিনি তুলে দিয়েছেন। তাই নিয়ে নতুন করে আন্দোলন-সংগ্রাম।

তারা এসব কেন করেন? সুখের জন্য?

সুখের সংজ্ঞা যদি হয় এমন, যা চাই তাই পাওয়ার নামই সুখ, তাহলে তাই বৈকি।

লজ্জার সভ্যতায় সবই সম্ভব।

তবু তারা এভাবেই সুখী হতে চায়। এসব নিয়েই সভ্যতার বুদ্ধিচর্চার সমস্ত ইতিহাস।

এভাবে কি সুখী হওয়া যায়?

এভাবে সুখী হবার কোনো তত্ত্ব-সূত্র দুনিয়ায় এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। এ যুগে কেবল সবাই মিলেই সুখী হওয়া সম্ভব। তারা তা জানে, তবু বরদাশ্‌ত করে না।

কেন?

(চলবে)

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন