আওয়ামী লীগ শুধু বুদ্ধির খেলা দিয়ে জিততে চেয়েছিল। তারা হেরে গেছে।
***
সেই পুরনো কথা। সভ্যতা মানে সুখের সন্ধানে ছুটে চলা। যারা ছুটেছে তারাই সভ্যতা গড়ে তুলেছে। তাদের প্রধানতম হাতিয়ার বুদ্ধি। নিন্দুকেরা বলে চালাকি।
কিন্তু শুধু বুদ্ধি মোটেও যথেষ্ট না। আওয়ামী লীগ শুধু বুদ্ধির খেলা দিয়ে জিততে চেয়েছিল। তারা হেরে গেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের তারা ধরপাকড় শুরু করেছিল। শায়েস্তা করার হুমকি দিয়েছিল। তারা যেসব ধারালো হাতিয়ার আবিষ্কার করেছিল, ‘রাজাকার’ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ইত্যাদি, সেগুলো কাজ করেনি। কারণ তারা সত্যের মধ্যে ছিল না। বস্তুগত ছিল না। চাকরিপ্রার্থীদের যে অনুভূতি, সেই মৌলিক সত্য/বস্তুর প্রতি তারা দৃষ্টিপাত করে নাই।
‘রাজাকার’ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ইত্যাদি অনেক পুরনো। এগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর যখন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছিল তখন তরুণ ভোটাররা বিএনপির প্রতি নাখোশ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আবেগাক্রান্ত ছিল। তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু অস্ত্রগুলো আওয়ামী লীগ ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারে নাই। যত্রতত্র ব্যবহার করেছে। অপব্যবহারের একশেষ করেছে, যা মানুষকে শুধুই আহত করেছে।
এখন যারা তরুণ প্রজন্ম, এখন যারা ভোটার, যারা আবার চাকরিপ্রার্থী, তাদের চোখে আওয়ামী লীগ কেবলই এক মাফিয়া গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে হয়ত ফ্যাসিবাদী মনে করেন, যেখানে তিনি তার আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য গণতন্ত্র উৎখাত করবেন এবং প্রয়োজনীয় নির্যাতন-পরিকাঠামো গড়ে তুলবেন, যেহেতু অন্য সবাই এতটাই অজ্ঞ যে তারা তার আদর্শ না বোঝার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কিন্তু মানুষ কদাচিৎ নিজেকে অজ্ঞ মনে করে। যদিও কেউ কেউ নিজেকে বুঝতে পারে, তারা (বিশেষত শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম) কখনও ফ্যাসিজম দীর্ঘমেয়াদে কবুল করে না। ‘তুমিও মানুষ আমিও মানুষ’ এই সত্য তারা যখন বুঝতে শিখেছে তখন তাদের আর দমন করা যায়নি। উনিশ ঊনসত্তর বা উনিশ একানব্বইকে শেখ হাসিনা নিজের বেলায় সত্য মনে করেননি দেখা যাচ্ছে।
ব্যক্তিগত সুখের জন্য বা ব্যক্তিগত অর্জনের জন্য মানুষ যখন মরিয়া হয়ে ওঠে, যেমন শেখ হাসিনা, তখন তার চোখের সামনে কুয়াশা গাঢ় হয়ে ওঠে। তার চেতনা ঝাপসা হয়ে যায়। তখন সে পূর্বনির্ধারিত গন্তব্য ছাড়া আর কিছু বুঝতে পারে না। পথের বিপদ-আপদ, সবাই যে তারই মতো সুখী হতে চায়, তা সে বুঝতে পারে না। নিজেকেই শ্রেষ্ঠ মনে করার মতো অহঙ্কারের মধ্যে হারিয়ে যায়। সে মনে করতে প্রয়াস চালায়, শুধু সে-ই জিতবে, দুনিয়ার সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও শুধু সে-ই ঠিক থাকবে। এই বোধ, এই অনুভূতি তাকে হিংস্র করে তুলতে বাধ্য। হাসিনা হিংস্র হতে বাধ্য। হাজার খানেক মৃত্যু বা কয়েক হাজার আহত হওয়া সেখানে নিতান্তই তুচ্ছ।
সুতরাং বলতে হচ্ছে, আপনি বুদ্ধি বা চালাকি, যা-ই বলুন না কেন, এর সামনে রয়েছে সীমাহীন হিংস্রতা। সুখের জন্য তিনি বা তারা বা অন্যরা ইতিহাসজুড়ে যা-কিছু করেছে তার শিরায় শিরায় হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা। তারপর তার সঙ্গে তারা যোগ করেছে অশেষ বদমায়েশি, শয়তানি। মেধাবীরা বলে নলেজ অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসি।
‘আইয়ুব হেরেছে (১৯৬৯), এরশাদ হেরেছে (১৯৯১), কিন্তু আমি জিতে যাব,’ শেখ হাসিনা কি মনে মনে এমনটাই বলেন নাই? প্রায় সব মানুষ তাই করে। যা ভেবে কাজ করছে তাই ঘটবে বলে তার অগাধ বিশ্বাস। বিশ চব্বিশ পর্যন্ত এমন মানুষই প্রায় সবাই। ‘আমি যা ভাবছি তা না-ও হতে পারে’ এমন মন বিশ চব্বিশ নাগাদ গড়ে উঠেছে নিতান্তই দুই-একজনে, যারা শান্তির ভাগ্য নির্ধারণ করে। (চলবে)