সারাবিশ্বে ব্যাংক ডাকাতির ইতিহাসে এস আলমের অবস্থান কততম?
তুহিন খান
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:২৬ পিএম
ব্যাংক থেকে টাকা সরানো বা লুট করার ঘটনায় আজও সবার আগে মনে করা হয় সাদ্দাম হোসেনের নাম।
২০০৩ সালের ২০ মার্চ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের রাজধানী বাগদাদে প্রথম বোমা ফেলার কয়েক ঘণ্টা আগে, ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের দ্বিতীয় ছেলে কুশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হাজির হন। সাদ্দামের নির্দেশ দেখিয়ে তিনি এক বিলিয়ন ডলার নিয়ে যান। তিনটি লরিতে করে এই মুদ্রা নেওয়া হয়।
সে খবর সে সময় তাবৎ দুনিয়ার গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের একজন মুখপাত্র সে সময় বলেছিলেন, ইরাকের নেতারা এই অর্থ লুট করে দেশ থেকে বের করে নেওয়ার চেষ্টা করবেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
সে কালে এই ডলারের একটা অংশ বাতাসে ওড়ানো হয়েছিল। সেটা ইচ্ছাকৃত নাকি অন্য কোনো পক্ষ ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিল তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বাকি ডলারের একটা অংশ সাদ্দামের প্রাসাদে পাওয়া গেছে বলে খবর দিয়েছিল আগ্রাসী মার্কিন সেনারা।
ঘটনাটা ঠিক কে বা কারা ঘটিয়েছিল, সাদ্দাম হোসেন আদৌ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিনা বা এটা তার কোনো রাজনৈতিক পলিসি ছিল কিনা তা জানা যায়নি। তবে সেই থেকে ব্যাংক ডাকাতির ইতিহাসে একেই সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয়।
ব্যাংক ডাকাতিতে বিশ্বের ইতিহাসে দ্বিতীয় ঘটনা এর তুলনায় অনেক ছোট। সেটিও ইরাকে। বাগদাদের দার এস সালাম ব্যাংকের ব্যবস্থাপকরা ২০০৭ সালের ১১ জুলাই সকালে ভল্ট খুলে দেখেন, ২৮২ মিলিয়ন ডলার হওয়া হয়ে গেছে। এর সঙ্গে ব্যাংকটির নিরাপত্তকর্মীরা জড়িত ছিলেন বলে সহজেই শনাক্ত হয়।
দেশটির কর্মকর্তারা সে সময় বলেছিলেন, এই নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে মিলিশিয়াদের যোগাযোগ ছিল। তারা বাগদাদ থেকে সহজে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। কোনো চেকপয়েন্টে তাদের ধামানো হয়নি। তবে বেশির ভাগ অর্থ পরে উদ্ধার হয়েছিল। কিন্তু কেন একটি ব্যাংকের ভল্টে এত নগদ ছিল তা আর স্পষ্ট হয়নি।
এস আলম
বাংলাদেশে এস আলম যেটা করেছেন সেটাকেও সবাই ডাকাতি বলছেন। তিনি সাতটি ব্যাংকের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তুলে নিয়েছেন ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল নাগাদ তিনি এসব টাকা নেন। ওই সময় প্রতিটি ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকার নিচে। সেই হিসেবে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা মানে ১৩২ কোটি (১.৩২ বিলিয়ন) ডলারেরবেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘এত সুপরিকল্পিতভাবে ও বিস্তৃত আকারে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে পদ্ধতিগতভাবে ব্যাংক লুটের ঘটনা এটাই প্রথম। ব্যাংক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে জনগণের টাকা বের করে নেওয়ার এমন ঘটনা পৃথিবীর কোথাও নেই।’
কিভাবে তিনি ব্যাংকের ওপর আধিপত্য বিস্তার করলেন
প্রথম আলোয় খবর এসেছে, ‘২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি। পরীবাগের বাসায় ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মান্নান। ভোরের দিকে হঠাৎ করেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা। জানান, তাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে।
‘তবে আবদুল মান্নান একা নন। একইভাবে নিজ নিজ বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকেও। এরপর তাদের জোরপূ্র্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করানো হয়, আর ব্যাংকটি দখল করে নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। পুরো প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করেন গোয়েন্দা সংস্থাটির তৎকালীন কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা।’ এবার এসব পদে বসানো হল নিজের লোকজন।
ব্যস! এবার নিজের ব্যাংক থেকে যেমন খুশি টাকা তুলে নাও। এই টাকা সাধারণ মানুষ আমানত রেখেছিল। এটা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। সে সময় ক্ষমতায় ছিল শেখ হাসিনার সরকার। ব্যাংক রক্ষার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। সে সময় ফজলে কবীর ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
মানুষের আমানত এখন ফেরত দিতে হবে সরকারের কোষাগার থেকে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক
এস আলম গ্রুপ ২০০৪ সালে সিকদার গ্রুপের কাছ থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম নিজেই ছিলেন। এস আলম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যাংকটি শরীয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকে রূপান্তর করেন। ব্যাংকটি আমানত সংগ্রহ করেছে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা এস আলম তুলে নিয়েছেন।
ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকেই ৬৭ হাজার কোটি টাকা
বিগত ১৫ বছর ধরে আতঙ্কে ছিল দেশের ব্যাংকিং খাত। শুধু এস আলমই ৬৭ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে। অন্যান্য শাখা থেকে নিয়েছেন আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা। এস আলম তার ১২টি কোম্পানির নামে ঋণ হিসেবে নিয়েছেন এই টাকা। কিন্তু এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ হয়েছে ১২০০ কোটি টাকার চেয়ে কম।
তাহলে বাকি টাকা তিনি কী করেছেন?
এসব টাকা নিয়ে তিনি বিদেশে চলে গেছেন বলে বহুল প্রচার রয়েছে।
ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এ রকম কর্মকাণ্ডই তো বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে দুর্বল করেছে। এমন ঘটনা যেন আর না হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘পুরো ব্যাংক খাত ভেঙে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘সবকিছু বিচারের আওতায় আনা হবে। একটু সময় লাগবে।’কিন্তু তারা তো টাকা নিয়ে বিদেশে। তাদের ধরবেন কিভাবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।