১৫ আগস্ট কেন ডিজে পার্টি
বিপ্লব ও তার রূপ এবং প্রতিবিপ্লবের সিম্বল
‘মোদির বৈঠা দিয়ে বাংলাদেশে নৌকা চালানোর আশা করবেন না’—এ কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। ১৫ আগস্ট ‘রেজিস্ট্যান্স উইক’ কর্মসূচির আওতায় শাহবাগের সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশে এমন কথা বলেন তিনি।
আওয়ামীপন্থী এবং আওয়ামী লীগের প্রতি যারা সহমর্মিতা পোষণ করেন তারা জেনারেশন জেড-এর (তরুণ প্রজন্ম) ক্ষোভের জায়গাটা উপলব্ধি করতে পারেননি। তারা চিহ্নিত করতে ভুলে গেছেন, কেন এ বছর ১৫ আগস্টের বিপরীতে জেনারেশন জেড-এর ক্ষোভ। কেন তারা এর বিরোধিতা করছেন। এ বিরোধিতা কি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে, না সদ্যপতিত শাসক ও তার রেজিমের বিরুদ্ধে, এ বিষয়টা আবেগের কারণে হয়তো তাদের ভেবে ওঠা হয়নি। যারা বলছেন, ‘এক অপশাসন দূর করে কি আরেক অপশাসন আনলাম’, তারাও এ কথা বলছেন তাদের অসহিষ্ণু আবেগ থেকে। ভুলে গেছেন, শ্রদ্ধা থাকে মনে, কোনো সিম্বলে নয়। যখনই শ্রদ্ধা অতিবেশি সিম্বলিক হয়ে ওঠে তখন সেটা আর শ্রদ্ধা থাকে না, হয়ে ওঠে প্রদর্শনবাদিতা।
বলি, জেনারেশন জেড দেখেছে বিগত দিনে তাদের পিতা-মাতা, ভাই, আত্মীয় প্রতিবেশীদের উপর ঘটে যাওয়া জুলুম। তারা ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়েছে। তার পরও চুপ থেকেছে। তারা জানার চেষ্টা করেছে এবং তা সেই মোবাইল ঘেঁটেই। যারা তাদের মোবাইলে মগ্ন থাকার দোষ দেন, তাদের বলছি, জেনারেশন জেড সেই মোবাইল থেকেই জেনেছে ৭১-পূর্ববর্তী এবং ৭১-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। তারা মিলিয়ে দেখেছে, খতিয়ে দেখেছে পূর্বাপর। যারা ইউটোপিয়ায় বাস করেন, বালিতে মুখ গুঁজে ছিলেন, তারা এভাবে খতিয়ে এবং মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেননি কখনো। জেনারেশন জেড করেছে। তার পরও তারা মুখ বুজে ছিল। ব্যস্ত ছিল নিজেদের যাপিত জীবনে। কিন্তু তাদের যাপিত জীবনে যখন হস্তক্ষেপ করা হলো, তখন তারা নিজেদের পরবর্তী জেনারেশনের কথা চিন্তা করে এগিয়ে এলো। তারা বুঝল, এখনই যদি না থামানো যায় কর্তৃত্ববাদ তাহলে পরবর্তী জেনারেশন তাদের অভিশাপ দেবে। অভিশাপ দেবে কর্তৃত্ববাদকে প্রতিহত না করার জন্য। সেটা বুঝেই তারা মাঠে নেমে এসছিল এবং এখন পর্যন্ত রয়েছে। তাদের ক্ষোভ প্রতিবিপ্লবের প্রতি, ১৫ আগস্টের প্রতি নয়। অথচ বুঝে হোক কিংবা না বুঝে, কেউ কেউ ১৫ আগস্টকে প্রতিবিপ্লবের সিম্বল বানিয়ে ফেলেছেন। নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়োল মেরেছেন। ১৫ বছর ধরেই মেরে আসছেন কখনো তোষামুদির নামে, কখনো অতিআবেগের চোটে। আবেগ বেড়ে গেলে সঙ্গতই বিবেক কমে যায়।
১৫ আগস্ট বিষয়ে অনেকেই লিখছেন। তারা দাবি করেছেন, শোক প্রকাশের স্বাধীনতার। আমি তাদের সাথে পুরোপুরি একমত। কিন্তু তারা এটুকু বুঝতে পারছেন না, এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী কে কিংবা কারা। একটা বিপ্লব হয়েছে এবং সেই বিপ্লবের প্রক্রিয়া এখনো চলমান। এখনো তরুণদের যারা ৫ আগস্ট পর্যন্ত আহত হয়েছেন তাদের মৃত্যু ঘটছে। ১৪ আগস্ট আইসিউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহাদত বরণ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাজিদ, যিনি ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। ১৬ আগস্ট শাহাদত বরণ করেছেন কুমিল্লার আইনজীবী আবুল কালাম, যিনি ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে চলাকালে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলরের গুলিতে নিহত হন। একইভাবে ১৩ আগস্ট পোশাক শ্রমিক শাহজাহান চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহাদত বরণ করেছেন। রংপুরে গুলিতে শাহাদতবরণকারী ইয়ামিনের দাফনেও দুইবার বাধা দেওয়া হয়েছে। তাকে গোসল ও কাফন ছাড়াই রক্তাক্ত পোশাকে দাফন করতে হয়েছে বাধার কারণে। এ কথা জানিয়েছেন তার মা। এখনো হাসপাতালগুলোর মর্গে পড়ে আছে শিক্ষার্থীদের লাশ। এ সবই গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে নেওয়া। গুগলে সার্চ করলে যে কেউ পেয়ে যাবেন। এই লাশ মাড়িয়ে যারা ৩২ নম্বরে যেতে চেয়েছেন মোম জ্বালাতে ও ফুল দিতে, তাদের চিন্তার দীনতা নিয়ে আফসোস হয়।
জেনারেশন জেড আবেগাকুল ডগমাটিক এ-সমস্ত মানুষের দীনতা অনুভব করেছে দিনের পর দিন। তার পরও তারা চুপ ছিল। কিন্তু যখন উস্কানি এলো ১৫ আগস্ট পতিত স্বৈরাচার ফিরে আসবে এবং শত শত তরুণের মৃত্যু, মানুষের যন্ত্রণা-ক্ষোভ উপেক্ষা করে ৩২ নম্বরে জমায়েতের আহ্বান জানানো হলো, তখন স্বভাবতই তরুণ মন বিদ্রোহ করল আবার। সেই বিদ্রোহের পরিণতিই হলো ১৫ আগস্ট শুরুর প্রথম প্রহর থেকে তরুণদের ডিজে পার্টি। তরুণরা ডিজে পার্টি করেছেন ক্ষোভে, আনন্দ করতে নয়। এই আনন্দও প্রতিবাদের ধরন। যেমন প্রোফাইল পিকচার লাল হয়েছিল তথাকথিত শোকের কালোর বিপরীতে। সেই ক্ষোভের সাথেও তাদের চিন্তা ছিল, এটাকে যেন আবার ইসলামি উগ্রপন্থীদের চেষ্টা বলে অভিহিত করা না হয়। তাদের যেন ভারতীয় কুচিন্তকরা এক্সট্রিমিস্ট বানিয়ে না দেয়। সেজন্যই তারা ভারতীয় গানের সাথে ডিজে নেচেছে। এটা না হলে এতক্ষণ ভারতীয় কুচিন্তক ও বাংলাদেশে তাদের সহযোগীদের সম্মিলিত চিৎকারে থাকা যেত না। যে চিৎকার সাউন্ডবক্সের থেকেও বেশি কানে বাজত।
যারা আজকে প্রশ্ন তুলে বলছেন, ‘এই স্বাধীনতা আমরা চেয়েছিলাম’ বলে, তারা একটু চিন্তা করে দেখেন তো, এই প্রশ্ন তুলতে পারছেন কেন? কেন নির্দ্বিধায় লিখতে পারছেন সামাজিক মাধ্যমে আপনার ক্ষোভের কথাটুকু? আপনাকে হয়তো কেউ কমেন্টে গালি দিচ্ছে, ইনবক্সে ধমক দিচ্ছে। ঠিক আছে, হচ্ছে এমনটা। কিন্তু এটুকু ভাবেন তো, আপনাকে এর জন্যে কেউ আয়নাঘরে পাঠাবে কিনা? আপনি গণমাধ্যমে শোক পালনের বিরোধিতা যে সঠিক নয় তা লিখতে পারছেন আয়নাঘরের ভয় ছাড়াই। এর আগে আপনাকে লিখতে গিয়ে কতবার ব্যাকস্পেস চাপতে হয়েছে কিবোর্ডে? এখন তো চাপতে হচ্ছে না। আপনি কমেন্টের কথাতেই ভয় পাচ্ছেন। ভেবে দেখুন এর আগে যারা লিখতে গিয়েছেন তাদের অবস্থার কথা। মুশতাকের কথা মনে পড়ে, লেখার জন্য যাকে পুলিশ হেফাজতে মেরে ফেলা হয়েছিল। কার্টুনিস্ট কিশোরের কথা মনে পড়ে। তাকে নিয়ে কী করা হয়েছিল তাও কি ভুলে গেছেন? এখন কার্টুনিস্ট মেহেদি নির্দ্বিধায় বিএনপির সুপ্রিমো তারেক রহমানকে নিয়ে কার্টুন আঁকছেন। তাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে আরো কার্টুন আঁকার জন্য। কিন্তু তারেক রহমানের বিপরীত সুপ্রিমোকে নিয়ে মেহেদি কি কার্টুন আঁকতে পেরেছিলেন? এখনো মানুষ ভয় পায় হাসিনার বিরুদ্ধে আঁকতে, লিখতে। অনেকে তাদের ভয়ের কথাই সামাজিক মাধ্যমে জানিয়েছেন। ১৫ আগস্ট পতিত স্বৈরাচার ফিরে আসার কথায় তারা লিখেছেন, সে ফিরে এলে এতদিন যে পোস্ট দিয়েছে তার জন্য তাদের আয়নাঘরে যেতে হবে। ভাই, মানুষের ক্ষোভের জায়গাটাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। কেন এমন পরিণতি তা ভাবতে চেষ্টা করুন। আত্মোপলব্ধিটা খুব জরুরি।
যারা আফসোস করছেন এবং যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী ও চিন্তক বলে দাবি করেন তাদের বলি, বলশেভিক বিপ্লবের আগে ও পরের বিষয়গুলি আপনারা বিস্মৃত হয়েছেন। না হয়ে থাকলে নিজেদের মুক্তচিন্তক বলার আগে তা পড়ে জেনে নিন। জেনারেশন জেড-কে যারা মোবাইলে মগ্ন জেনারেশন বলতেন, তারা কিন্তু জানেন। কিন্তু আপনারা মোবাইলে তা জানার চেষ্টা করেননি কিংবা মোবাইল ব্যবহার করেছেন ডিবি হারুন যে কাজে মোবাইল ব্যবহার করত সেই কাজে। আর যাদের পড়াশোনা আছে তারাও বিস্মৃত হয়েছেন সে সম্পর্কে। বিপ্লবের মানেই হলো শাসক-শোষকের সমস্ত সিম্বলকে ধ্বংস করে দেওয়া। বলশেভিক বিপ্লবের পরেও তাই হয়েছিল। প্রতিটা বিপ্লবেই তাই হয়। শাসক-শোষকের সকল চিহ্নের উপর ক্ষোভ ঝাড়ে মানুষ। আর সেই সাথে যদি প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে, সেই ক্ষোভ হয়ে যায় দ্বিগুণ।
শেষ কথা : অনেকে আফসোস করে বলছেন, শোক দিবসে ডিজে এবং আরো কিছু ঘটনায় নাকি বিপ্লবীদের ঐক্য নষ্ট হচ্ছে। এসব যারা বলছেন, তাদের কেউ আসলে গত ১৬ বছরে নির্যাতিত হন নাই। তাদের যন্ত্রণার কোনো স্মৃতি নেই। কিংবা থাকলেও তা বেচে দিয়েছেন মূল্য নিয়ে। না হলে এমন কথা বলতেন না। তারা বিপ্লবের মূল কথাই জানেন না, বিপ্লবে ঐক্য হয় নির্যাতিতদের মধ্যে। এর বাইরে যারা তারা বাংলাদেশের বিপ্লবী তরুণদের দেওয়া সেই ‘ভুয়া-ভুয়া’ স্লোগানের মতো।
আরেকটা কথা। আপনারা প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে গিয়ে বিপ্লবে শহীদ এবং যারা আহত, এখনো হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন, তাদের কথা ভুলে যাবেন না। বিপ্লবীদের বলছি, শহীদ এবং আহত এবং যারা বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের অবদান এবং বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও ভুলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাতেই এই প্রতিবিপ্লব। যেন মানুষ এসব নিয়েই মেতে থাকে। এর পেছনে মদদ রয়েছে দেশের কিছু গণমাধ্যমেরও। তারাও এসব নিয়ে মেতে আছে। আড়াল করতে চাচ্ছে বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের কথা। এদিকে হাসপাতালের আইসিইউতে যারা আছেন তাদের অনেকেরই চিকিৎসার ব্যয়ভার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। যদিও রাষ্ট্রের পক্ষে বলা হয়েছে, তাদের চিকিৎসার খরচ রাষ্ট্র বহন করবে, কিন্তু সে আশায় বসে থাকার সময় নেই। তাদের চিকিৎসা চালিয়ে নেবার ব্যবস্থা করুন। শহীদদের আত্মদানের কথা জানান। তাদের পরিবারকে সহায়তার কথা বলুন। সাথে গণমাধ্যমকে তা জানাতে ও বলতে বাধ্য করুন।
ফুটনোট : ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এক ভাষণে ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আজকে যা ঘটছে, তা পরিষ্কারভাবে আমাদের জন্য স্বাধীনতা যে কতটা মূল্যবান, তা মনে করিয়ে দিচ্ছে’। জুলাই ম্যাসাকার ও আগস্ট বিপ্লব ভারতকেও শেখাচ্ছে, ভাবাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের একটা শ্রেণি পুরোপুরি অন্ধ, মতান্ধ।